অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
[সিরাজ শিকদার বাংলার রাজনীতিতে একজন কিংবদন্তী। কারো মতে বাংলার চে গুয়েভারা। আবার কেউ তার মধ্যে একজন সন্ত্রাসবাদী ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাননি। তার অনেক কমরেডই তাকে একনায়ক হিসেবে আখ্যা করে দল ছেড়েছেন। অনেক প্রবীন নেতা তার কাজকর্মকে এডভেন্চারিস্টের তকমা দিয়েছেন, বলেছেন হঠকারী, বলেছেন সিআইএর দালাল।
তারপরও লাল বই পড়ে বিপ্লবী হতে ইচ্ছুকদের কাছে সিরাজ শিকদার নমস্যই রয়ে গেছেন। সর্বহারা তথা প্রলেতারিয়েতের এত সুন্দর বাংলা এর আগে কোন বিপ্লবী নেতাই করতে পেরেছেন, কোন বাংলায়! এই বাংলাদেশে যেখানে চালটা-ডালটা-নুনটার সঙ্গে জঙ্গীটা এবং কমরেডশিপ ও তাদের থিসিসটাও আমদানী হয় ভারত থেকে, সেখানে সিরাজ শিকদার তার সর্বহারা তত্ব লিখেছিলেন এই বাংলাকে মাথায় রেখেই। এইখানেই তিনি আলাদা। বিপ্লবী কিংবা সন্ত্রাসী যাই হোন- এই একটা জায়গায় তিনি খাঁটি বাঙালী। পূর্ব বাংলার বাঙালী।
এই পোস্টটি তাকে হেয় করতে কিংবা তাকে আকাশে তুলতে লেখা হচ্ছে না। প্রচলিত মিথের বাইরে কিছু চমকপ্রদ ব্যাপার নজরে এসেছে লেখকের। সেটা তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু অবান্তর বিতর্ক খন্ডনের চেষ্টা থাকবে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই ইতিহাস থেকে বিচ্যুতির কোনো চেষ্টা নেই- এ ব্যাপারে লেখক নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকার চেষ্টা করেছেন। তারপরও বক্তব্য পাতি বুর্জোয়াসুলভ হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
]
ষাটের দশকের শেষার্ধে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসাধারণ কিছু ঘটনা ঘটে যায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফাসানো হয় লে.কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তার সঙ্গীদের। এ নিয়ে স্বাধীনতার আগে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা নামে সিরিজ লেখা হয়েছে আমার ব্লগে। এই মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় শেখ মুজিবর রহমানকেও। তিনি সেই মুহূর্তে বেশ আলোচিত তার ৬-দফা নিয়ে।
এই মামলা দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের কিংবা স্বাধীনতার সামরিক ও রাজনৈতিক অভিপ্রায় কিংবা যড়যন্ত্র প্রকাশ্যে চলে আসে।
বামপন্থীদের মধ্যে সে সময় দুটো ধারা-রুশ ও চীনাপন্থী। মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যেই তা প্রবল ছিলো। নেতা পর্যায়ে তা ছিলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ব্যানারে। কারণ পাকিস্তানে তখন কম্যুনিস্ট পার্টি ছিলো নিষিদ্ধ, অতএব গোপন।
রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চুক্তিতে লেনিন এবং মাও সেতুংয়ের রচনাবলী তখন সহজপ্রাপ্য। সুবাদেই দলের প্রবীন নেতারা বিপাকে। এদের বেশীভাগই স্বদেশী করা আন্দামান ফেরত সন্ত্রাসী। নতুন পড়ুয়ারা বিভিন্ন তত্ব নিয়ে তর্ক করে তাদের নাজেহাল করে। রুশপন্থীদের ঝামেলা কম।
তারা কর্মীদের নানা ধরণের অসাম্প্রদায়িক গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত রাখে। তিন জনের সেল পদ্ধতিতে (যেখানে কর্মীরা একাধিক সেলের সদস্য) পার্টি ম্যানিফেস্টোর প্রচারণা চলে। সমাজতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরে বার্মা তাদের কাছে মডেল। শৃংখলা ভাঙ্গার সুযোগ তাই নেই। অন্যদিকে চীনাপন্থীরা সোভিয়েত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কে বেশী সাম্রাজ্যবাদী, কাকে শ্রেনীশত্রু ও সংস্কারবাদী ধরা হবে এই নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে লড়াইয়ে তাদের মন খারাপ হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী উন্মেষ তাদের চোখ এড়ায়। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে গলা মেলায় বটে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থের পক্ষে তাদের রা সরে না।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ই তাদের এই রূপটা অবশ্য পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। চীন পাকিস্তানের বন্ধু বলে তারা পাকিস্তানের পক্ষে গলা মিলিয়েছে।
শোনা যায় ভাসানী কয় দিনের জন্য নিখোজ হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন পিকিংয়ে (বেইজিং) আইউব খানের জন্য সামরিক সাহায্যের দেনদরবার করতে। যদিও এই দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি কেউ। এই দশকের শেষ দিকে পশ্চিম বঙ্গ কাঁপিয়ে দিলেন চারু মজুমদার। নকশাল বাড়ি আন্দোলনের সেই জোয়ার পিকিং রিভিউর সৌজন্যে রোমাঞ্চিত করে তুললো চীনাপন্থী তরুণ তুর্কীদের। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র সিরাজ শিকদার তাদের একজন।
ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) লিয়াকত হল শাখার সভাপতি তিনি। মার্কসবাদ সম্পর্কে তার প্রচুর জ্ঞান। পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির (মার্কস-লেনিন) সদস্যপদও পেয়েছেন। নকশালবাড়ির আন্দোলনকে পার্টির নেতারা হঠকারিতা বলে রায় দিয়েছেন। আর এর প্রতিবাদে তরুণদের একটা দল বেরিয়ে এসে গঠন করলেন রেডগার্ড।
ঢাকা শহরে চিকা পড়লো- বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস/ নকশালবাড়ী জিন্দাবাদ।
সিরাজ শিকদার তাদের অন্যতম। তার চোখে তখন মাও সেতুং হওয়ার স্বপ্ন জেঁকে বেসেছে। এমনিতে তার খুব বেশী বিলাসিতা নেই সানগ্লাসটা ছাড়া। প্রিয় খাবার বলতে মশুরের ডালে বিস্কিট ডুবিয়ে খাওয়া।
ধুমপানের বদভ্যাস নেই। বিপ্লবী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণে এ যাবত তোলা যত ছবি সব পুড়িয়ে ফেললেন। তারপর তখনকার ফ্যাশন মেনে কৃষকদের জাগিয়ে তোলার জন্য গেলেন নিজের এলাকা মাদারীপুরের ডামুড্যায়। কিন্তু শ্রেনী সংগ্রামের বিভেদ বোঝাতে গিয়ে বিপাকে পড়লেন। সার্কেল অফিসারের ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার, পাত্রের বাজারে দাম লাখ টাকা।
এক কৃষক তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন গরীবের প্রতি তার দরদ পরীক্ষায়। চ্যালেঞ্জ মেনে কৃষকের মেয়ে হাসিনাকে বিয়ে করলেন। স্বভাবতই পরিবার সেটা মেনে নিলো না। তাতে থোড়াই বয়ে গেছে শিকদারের। এবং হঠকারিতা অর্থে এটিই তার প্রথম নয়।
বিপ্লবের আরো প্রস্ততি হিসেবে মার্শাল আর্ট শেখা ধরলেন। এরপর ৭ সঙ্গী নিয়ে টেকনাফ হয়ে গেলেন বার্মা (মায়ানমার)। সেখানকার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা থান-কিন-থাউর সঙ্গে দেখা করলেন নে-উইনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের স্বরূপ জানতে। রেডগার্ডের মাহবুবুল করিমকে চিঠি দিয়ে জানালেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় তিনি বিপ্লবীদের মূল ঘাটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আরো সদস্য পাঠাতে। আর বাকী কমরেডদের নিয়ে লেগে গেলেন পাহাড় কেটে সুরঙ্গ তৈরিতে।
চীনা দুতাবাসে এর আগে টানেল ওয়ারফেয়ার নামে একটা তথ্যচিত্র দেখেছেন তারা। সে ধাচেই তৈরি হবে বিপ্লবী সদর। সঙ্গীরা সব অল্প বয়সী, কেউ ২০ পেরোয়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের আদুরে সন্তান। পাহাড়ের খাদে ওই খেয়ে না খেয়ে ঝড় বৃষ্টিতে মশার কামড় খাওয়া আর সাপের সঙ্গে শোয়া বিপ্লব তাদের সইলো না।
৭ জনের মধ্যে ৫ জন পালালেন। রেডগার্ড নেতা মাহবুবের ভাই মাহফুজ তাদের একজন। রয়ে গেলেন বিহারী দুই ভাই। এদের মধ্যে কায়েদ-ই আযম কলেজের বিএসসির ছাত্র সাইফুল্লাহ আজমী সিরাজ শিকদার অন্তপ্রাণ। তার স্বপ্ন লিন বিয়াও হওয়া।
ক্ষুব্ধ সিরাজ তাকে ছেড়ে আসা ৫ জনের বিশ্বাসঘাতকতায় মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন। মাহবুব তার ভাইর পক্ষ নিলেন। সিরাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো রেডগার্ড। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।