আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের এই দেশ : বদরুদ্দীন উমর



বাংলাদেশে এখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল পরিস্হিতি যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে এবং যেভাবে এর অবনতি হচ্ছে, এটা বড় রকম আশঙ্কাজনক ব্যাপার। চারদিকে খুনখারাবি ও সন্ত্রাস এখন এমনভাবে হচ্ছে, যাতে একে কেউ স্বাভাবিক মনে করলে তাকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। কোনো কিছু তখনই স্বাভাবিক মনে হয়, যখন সমাজ তাকে সহ্য করে, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দেখা যায় না, অন্তত কার্যকরভাবে। বাংলাদেশেও এ কারণে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে স্বাভাবিক মনে হওয়াতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কয়েকদিন আগে সকল সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা গেল যে, নবাবগঞ্জের কোনো গ্রামে আওয়ামী লীগের এক স্হানীয় নেতা তার বিরোধী একজনকে গাছে ঝুলিয়ে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনভাবে নির্যাতন করেছে, যার সঙ্গে বাংলাভাইয়ের নির্যাতনের কোনো তফাৎ নেই।

পরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও সংবাদপত্রে সেই নির্যাতন দৃশ্যের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, লোকটিকে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তার চারদিকে গ্রামের লোকজন দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। এর বিরুদ্ধে নিশ্চয় তারা ক্ষোভ বোধ করেছে কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। এভাবে অপরাধের ঘটনা ঘটতে থাকায় তাদের ক্ষোভ ক্রোধে পরিণত হয়ে তাদের সেই নির্যাতন জোরপুর্বক বন্ধ করতে প্ররোচিত করেনি। অর্থাৎ তারা নীরবে সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন বিক্ষুব্ধ হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে নীরব থেকে এই অপরাধীকে বেপরোয়া করেছে। অপরাধ করা ও অপরাধ সহ্য করা, বিশেষত সে বিষয়ে নীরব থাকার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।

কারণ এই দ্বিতীয়টির ওপরই প্রথমটি নির্ভরশীল। যদি অপরাধ সহ্য না করে সমাজের মানুষ তার বিরুদ্ধে শুধু সঙ্গে সঙ্গে সোচ্চার নয়, অপরাধ বন্ধ করার জন্য শক্তি প্রয়োগে তৈরি থাকে এবং বাস্তবত পরিস্হিতি অনুযায়ী সে শক্তি প্রয়োগ করে তাহলে অপরাধ ঘটা সহজ হয় না। অপরাধ বিস্তার লাভ করতে পারে না। বাঙালিদের একটা অভ্যাস হচ্ছে অনেক কিছু সমাজবিরোধী কাজ ও বিচারের বিরুদ্ধে ঘরোয়াভাবে সমালোচনা করা, তাকে নিন্দনীয় বলা। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তাদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায় না।

সেটা অবশ্য প্রচন্ডভাবে ও ব্যাপক আকারে দেখা যায় ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে। তখন যেভাবে সমাজে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে, সেটাও এই অঞ্চলের এক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কয়েক দশক পর পর এ ধরনের অভ্যুত্থানমুলক ঘটনা ঘটা এবং অন্য সময়ে নীরব থেকে শোষণ-নির্যাতন সহ্য করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্হিতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয় না। মৌলিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠন ধারাবাহিকভাবে শোষণ-নির্যাতন প্রতিরোধের মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে এবং যে জনগণ নিজেদের সমাজে আমুল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়, তাকেও এসবের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ও নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হয়। যদিও তা এক মাত্রায় কমানো সম্ভব নয়।

তার মধ্যে চড়াই-উতরাই অবশ্যই থাকে। যে সব সমাজে এ ধরনের পরিবর্তন বা বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। বাংলাদেশে এর নিতান্ত অভাবের জন্যই এখানে অনেক গুরুত্বপুর্ণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থান সত্ত্বেও জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা আজ পর্যন্ত আসেনি। জনগণের নিজেদের আন্দোলন জনগণের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অক্ষম হয়ে জনগণের শত্রুদেরকেই নতুন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। এটা যেমন দেখা গেছে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনে, তেমনি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর ও তাদের একের পর এক সরকারের এমনই অবস্হা যে, দুবৃত্তরা সন্ত্রাস করলে তাকে সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য করা হয় না। তবে সেই সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্য জনগণ যদি শক্তি প্রয়োগ করেও তাকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করতে তাদের অসুবিধা হয় না। নবাবগঞ্জে আওয়ামী লীগের এক পাতি নেতা তার এলাকার একজনকে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করলে সেটা সন্ত্রাস হয় না। কিন্তু উপস্হিত লোকজন যদি এই অপরাধমুলক কাজ দেখে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করতেন অথবা জোরপুর্বক তাকে ছিনিয়ে নিয়ে মুক্ত করতেন, তাহলে তাকে গণসন্ত্রাস বলতে সরকারি প্রশাসনের পক্ষে অসুবিধা হতো না। তারা সেটা বলেই স্হানীয় লোকদেরকে গ্রেফতার করে থানায় চালান দিত।

সমাজের এই ভিত্তিভুমির ওপর দাঁড়িয়েই এদেশে এখন সকল প্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই বিশৃঙ্খলার অনেক ধরন এবং অনেক রুপ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে জনগণকে যা প্রতিদিন নিয়মিতভাবে আঘাত করছে তা হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মুল্য বৃদ্ধি। এর যন্ত্রণায় সাধারণ মানুষ, নির্দিষ্ট নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ জর্জরিত। অনেকে মনে করেন, মুল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সমাজের অন্যান্য সম্পর্কের থেকে বিচ্ছিন্ন, কিছু সংখ্যক কালোবাজারি ও মুনাফাখোরই এ কাজ করছে।

এটা ঠিক যে, সরাসরি এ কাজ কালোবাজারি ও মুনাফাখোররাই করছে, কিন্তু তারা এ কাজ সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে করছে না। সমাজে সাধারণভাবে যদি সুশৃঙ্খল অবস্হা থাকত, কোনো দুর্নীতি না থাকত, তাহলে এইভাবে অনিয়ন্ত্রিত মুল্য বৃদ্ধি যে ব্যবসায়ীদের দ্বারা সম্ভব হতো না, এটা বলাই বাহুল্য। আজ দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি পরিস্হিতি যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা সমাজের সর্বত্র-অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অসততা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের পরিস্হিতি বিরাজ করছে তার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কাজেই মুল্য বৃদ্ধির সমস্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে সরকারি প্রশাসন, সরকারি ও বিরোধী দল, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনে যে বিশৃঙ্খলা আজ দেখা যাচ্ছে, তার তুল্য বিশৃঙ্খলা এই বাংলাদেশেও আগে দেখা যায়নি।

প্রশাসন ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র ও পুলিশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই শুধু নয়, আমলা ও পুলিশের পারস্পরিক দ্বন্দ্বও এখন খোলাখুলিভাবেই দেখা যাচ্ছে। ডিসি এবং এসপির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখন এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, যা আগে কোনোদিন দেখা দেয়ার তো কথাই ছিল না, কল্পনাও করা যায়নি। তাছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও আমলাদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে চলছে এখন দ্বন্দ্ব, যা গ্রামাঞ্চলে সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনাকে অল্পদিনের মধ্যে অসম্ভব করবে এবং এর ফলে সেখানে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের বৃদ্ধি ঘটবে। বিরোধী দল বিএনপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় যে দুর্নীতি ও দুবৃত্তগিরি করেছে তার ফলে তাদের দলের ভাঙন তাদের জন্য সংকটজনক হয়েছে। এই সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা তারা করছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের নানা অপকর্ম সত্ত্বেও সেটাকে পুঁজি করে আগের মতো বিএনপি নতুনভাবে দাঁড়াতে পারবে, এমন মনে হয় না।

কারণ সাধারণভাবে শাসক শ্রেণীর সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে সেই অবস্হায় তাদের কোনো দলই আর পুর্ব অবস্হায় ফিরে যেতে পারবে না। ক্ষমতায় থেকে জামায়াতে ইসলামীও যেভাবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে-সে ক্ষতি পুরণের মতো বাস্তব অবস্হা বাংলাদেশে আর নেই। ইসলামী জঙ্গিদের তৎপরতা ইত্যাদি সত্ত্বেও এটা সত্য। বর্তমান আওয়ামী লীগ সংগঠন ও সরকারের অবস্হা এদিক দিয়ে অন্য রকম নয়। উপরন্তু তাদের অবস্হা রীতিমত সংকটজনক।

২৪ জুলাই মহাসমারোহে তাদের কাউসিল হতে যাচ্ছে। এই কাউসিলকে কেন্দ্র করে যে জটিলতা ও সমস্যা ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন এখানে নেই। কিন্তু এই কাউসিলের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠন যে শক্তিশালী হবে-এমন মনে করার কারণ নেই। কোনো সংগঠনের সর্বোচ্চ ও সর্বশক্তিমান নেতৃত্ব যখন নিজের চাটুকার ও স্তাবক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে সংগঠনে গুরুত্বপুর্ণ পদে রাখতে নারাজ, তখন সে সংগঠনের অবস্হা ও ভবিষ্যৎ সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। ইতোমধ্যেই মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ আমদানি করে তাদের প্রধানমন্ত্রী যে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, তার বিরুদ্ধে তিনি নিজেই মাঝে মাঝে সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের বিরুদ্ধে সামান্য সমালোচনা সহ্য করতে অপারগ হয়ে তিনি যেভাবে স্তাবকদের দ্বারাই দল ও সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্তে অনড় আছেন, তার পরিণতি তার নিজের ও তার দলের জন্য ভয়াবহ হতে বাধ্য। (সুত্র, আমার দেশ, ২৩/০৭/২০০৯)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.