আমি কিছুই লিখব না।
প্রায়শই খবরে দেখছি, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ায় নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেওয়া বিভিন্ন মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত নাইকো দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহৃত হয়েছে।
রাজনীতিক, ব্যবসায়ী যারা বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, তাদের প্রায় সবাই এখন মুক্ত। আমার জানামতে, উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে কেবল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান এবং অপর পুত্র আরাফাত রহমান কোকো অভিযোগ মাথায় নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন।
আর তারেক রহমানের বন্ধু আবদুল্লাহ আল মামুন কারাগারে আছেন।
সরকার সমর্থক রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আনীত বেশ কিছু অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এটিই আমাদের দেশের রেওয়াজ। সরকার পরিবর্তনের পর আগের সরকারের আমলে দেওয়া মামলা প্রত্যাহারের হিড়িক পড়ে যায়। এর দুটি দিক আছে।
ক্ষমতাসীনরা বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকে। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সেসব মামলা প্রত্যাহৃত হওয়া উচিত। ফৌজদারি আইনে সে সুযোগও রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই আইনের সুযোগ নিয়ে অনেক যৌক্তিক মামলাও তুলে নেওয়া হয়, যা আইনের অপব্যবহার।
বিগত জোট সরকারের আমলে যাচাই-বাছাই ছাড়াই দলীয় নেতাদের খবরদারিতে পাইকারি হারে নেতা-সমর্থকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অগণিত মামলা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে যে ব্যাপকসংখ্যক যৌক্তিক মামলা ছিল তা বলাবাহুল্য। সে বিবেচনায় এবারের মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া অনেক স্বচ্ছ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? হয়রানিমূলক মামলার সঙ্গে এমন কিছু মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে_ যা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।
মজার ব্যাপার, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা এসব মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে বিএনপির কোনো আপত্তি নেই। তবে তাদের দাবি, বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলোও প্রত্যাহার করা হোক। এটি যুক্তির কথা। এক দেশে দুই আইন কেন? দলমত নির্বিশেষে সব নেতার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা উচিত। তবে অপরাধ প্রতীয়মান হয়, এমন মামলা প্রত্যাহারযোগ্য নয়।
কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। এমন সব ব্যক্তির মামলা তোলা হয়েছে, যারা দুর্নীতিবাজ বলে বহুল আলোচিত-সমালোচিত।
এ ক্ষেত্রে ১/১১-এর পর কারাভোগকারী সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতারা সুর মিলিয়ে একটি বক্তব্য হাজির করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন ভিন্ন অন্য কিছু করার এখতিয়ার ছিল না। কেউ কেউ এও বলছেন, ওই সরকার ছিল অবৈধ। আমরা অবৈধ সরকারের পদক্ষেপ মানব কেন? দ্বিতীয়ত, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হচ্ছে, জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে, তাই আমাদের গায়ে কোনো ময়লা নেই।
এ লেখায় আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা বা অবৈধতা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না, ওই সরকারের মূল্যায়নও করতে চাই না। কেবল বলতে চাই কাঙ্ক্ষিত হোক, অনাকাঙ্ক্ষিত হোক, ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অংশ। ওই সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সব দলই অংশগ্রহণ করেছে এবং রায়ও সবাই মেনে নিয়েছে। ওই সরকারের সময়ের অনেক অর্ডিন্যান্স পার্লামেন্টে বৈধতা পেয়েছে। পরিণত হয়েছে আইনে।
এটি শাসন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। কেবল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমই নয়, জাতিকে সামরিক সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে মেনে নিয়েই অগ্রসর হতে হয়েছে নানা সময়ে। পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি বিল এনে অনেক অসাংবিধানিক কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যা গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হলেও সঙ্গত কারণেই আমাদের মেনে নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তা শুধরানোর সুযোগ আছে, কারও খেয়ালখুশিমতো নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, নির্বাচিত হোক বা অনির্বাচিত, পূর্ববর্তী সরকারের যৌক্তিক পদক্ষেপ পরবর্তী সরকারের জন্য পালনীয়।
সবকিছুর বড় বিচারক জনগণ। আমি জনগণের চোখে ১/১১-এর পটভূমিতে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি দেখতে চাই। সেই সরকারের কিছু ঘটনার বাড়াবাড়িতে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল। গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সময়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি।
তথাকথিত কিংস পার্টি গঠন বা সেনা কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে আগমনের পক্ষে জনসমর্থন ছিল না। তবে জনগণ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত নেতাদের গ্রেফতার ও বিচারের উদ্যোগকে সমর্থন করেছে, স্বাগত জানিয়েছে।
জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতামূলক দুর্নীতি-লুটপাট, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, দুঃশাসন, ক্ষমতার অপব্যবহার, হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্যে হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ। তা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনির্বাচিত সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রতি জনগণের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন, প্রত্যাশাও ছিল অনেক কিছু। এসব ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
বিগত নির্বাচনে দুর্নীতির বিষয়টি পরিণত হয়েছিল আলোচিত অন্যতম প্রধান এজেন্ডায়। বিএনপির পরাজয়ের মূলে দুর্নীতির বিষয়টি কাজ করেছে। এটি আওয়ামী লীগ পূর্বাহ্নে অনুধাবন করে নির্বাচনে আলোচিত দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন দেওয়া থেকে খানিকটা বিরত থেকেছে। তবে প্রভাব খাটিয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ নেতা মনোনয়ন বাগিয়েছিলেন। আর বিএনপির পক্ষে অত বাছবিচার সম্ভবও ছিল না, কারণ দলে দুর্নীতিবাজদেরই ছিল ব্যাপক আধিপত্য।
বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকালে দুর্নীতি-লুটপাটে অংশ নেননি এমন নেতা পাওয়া ছিল দুর্লভ। ফলে জোটে পাইকারি হারে দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের এটিই বড় কারণ। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, দেশের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত থাকায় বিভিন্ন চটকদারি স্লোগানের আড়ালে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। সে যাই হোক, জনগণের ভোট পেলেই কারও বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ হয়ে যায় না।
নির্বাচিত হলেই কেউ ধোয়া তুলসী পাতা বনে যায় না। কে দুর্নীতি করেছে আর কে করেনি_ তা নিরূপণের দায়িত্ব আদালতের। তাই যখন কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তখন তা আদালতে মোকাবেলা করাই প্রত্যাশিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সেসব মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়াটি আইনের শাসনের জন্য সহায়ক নয়।
আগেই বলেছি, মামলা প্রত্যাহারের আইনানুগ এখতিয়ার সরকারের আছে।
কিন্তু তার যথেচ্ছ ব্যবহার সরকারের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে না। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে যতটুকু সচেতনতার পরিচয় দিয়েছিল, জনগণের যে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, একচেটিয়া মামলা প্রত্যাহার করে তা রক্ষা করতে পারল না বলে মনে হয়।
আমি বিশ্বাস করতে চাই না, শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সত্য। এরপরও আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া যদি তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত করতে পারতেন, তা হতো অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমরা আইনের শাসনের কথা বলছি।
আবার কৌশলে আইন এড়িয়ে যাব, তা কী করে মানা যায়? রাজনৈতিক দলগুলো স্বীকার করুক আর না-ই করুক, রাজনীতিকদের সততা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনীতিকরা যে ব্যক্তিগত স্বার্থে বা সুখ-সম্ভোগের জন্য রাজনীতি করেন না, তা এখন অবিশ্বাস্য। অথচ মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আজাদ, নেহরু, শেরেবাংলা, ভাসানী, মণি সিংহ, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনের নাম যখনই উচ্চারিত হয় তখনই মনে হয় তারা যেন ত্যাগী মানুষের এক একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিহাস বলে শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী ক্ষমতার মোহে অনেকবার বিভ্রান্ত হয়েছেন; কিন্তু দুর্নীতি করেছেন এমন কথা ঘুণাক্ষরে শোনা যায়নি। শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী জাঁদরেল উকিল ছিলেন।
বহু টাকা কামিয়েছেন। তা বিলিয়েছেনও। রাজনীতি মানেই তখন ছিল জেল-জুলুম-নির্যাতন সওয়া আর জনস্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। সেই ধারা এখনো ভারতে খানিকটা আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দু'রুমের বাসায় থাকেন।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবাসগৃহ মাটির।
মনে করার কারণ নেই যে, আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা সব দুর্নীতিবাজ। তবে দুর্নীতিবাজদের দাপটে সৎ নেতা-নেত্রীদের অমূল্যায়ন হচ্ছে, ক্ষুণ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক ভাবমূর্তি। তা পুনরুদ্ধার করতে রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রয়োজন আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকার। এ জন্য নেতা-নেত্রীদের আদালতে দাঁড়াবার সৎসাহস চাই।
আদালতে দাঁড়ালে অগৌরব হবে না। বরং অগৌরব আদালতকে পাশ কাটিয়ে ভালো মানুষের সার্টিফিকেট পাওয়া। জানি না, মহাজোট নেতৃত্ব মামলা প্রত্যাহারের এই প্রক্রিয়া বন্ধ করে কখনও আদালতে দাঁড়াবার সাহস দেখাবেন কি-না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।