আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুটুম (ছোট গল্প)



আজকাল চেরাগ আলীকে নিঃসঙ্গতা যখন প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে তখন প্রায়শই সে গোরস্থানের দিকে দৌঁড়ায়। জয়তুন্নেসার কবরের সামনে কয়েকমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে জীর্ণ জ্বরাগ্রস্থ দেহের সাথে দুর্বহ নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে আবার বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। মাঘের শেষের এক সন্ধ্যা। গায়ে জড়ানো চাদরের ঝুলে পড়া কোণা কাঁধের উপর টেনে নিয়ে চেরাগ আলী হাঁটছে বাড়ির পথে। মুখে বিড় বিড় করে চাদরের নিচে আঙ্গুলের কর গুনে বের করল ৭ বছর ৫ মাস।

জয়তুন্নেসা পরলোকগত হয়েছেন ৭ বছর ৫ মাস হয়ে গেল। চেরাগ আলীর ভাষায় "জয়তুন্নেসা উড়াল দি ছলি গেছে। " তার এখনো মনে পড়ে নতুন বিবাহের পর চেরাগ আলী যখন জয়তুন্নেসার সাথে প্রায়শই খুনসুঁটি করত তখন তরুণী বধু জয়তুন্নেসা বলতো "আন্নে এরুম্মা কইল্ল্যে আঁই কিন্তুক উড়াল দি ছলি যামু। " আহা সুখের দিন-ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছোঁড়ে চেরাগ আলী। গেরস্থানের রাস্তা পেরিয়ে পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটছে চেরাগ আলী।

হঠাৎ সে শুনতে পেল শুকনো পাতা ভাঙ্গা পদ শব্দ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে একটি কুকুর তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু আসছে। বিশেষ কোন গুরুত্ব না দিয়ে চেরাগ আলী হাঁটছে আপন মনে। পুকুর পাড়ের বাঁশ-ঝাড় পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে আসতেই কৌতুহলবশত আরেকবার পেছন ফিরে তাকাল চেরাগ আলী। দেখল এখনও কুকুরটি তাকে অনুসরণ করে পিছু আসছে।

আলো-আঁধরেও শীর্ণকায় কুকুরটির পৃষ্ঠদেশের বিশাল ক্ষত চিহ্নটি চেরাগ আলীর দৃষ্টিগোচর হয়। মনে মনে সে ক্ষতটির কারণ হিসেবে নিক্ষিপ্ত গরম মাড় বা গরম পানির কথাই ভাবল। এতসব ভাবতে ভাবতে নির্লিপ্ত চেরাগ আলী চলছে আপন পথে, মাঘের শীত আর মেঠো পথ ভেঙ্গে আপন আলয়ে চেরাগ জ্বালাতে। কুকুরটিকে সে তাড়িয়েও দিচ্ছেনা আবার ঘনিষ্ঠ হবার প্রশ্রয় পায় এমন কোন ভাবও প্রকাশ করছে না। এক সময় চেরাগ আলী পৌঁছে গেল এক চিলতে উঠোনকে সামনে করে দাঁড়িয়ে থাকা তার ঝুপড়ি ঘরে।

বেড়ার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে চেরাগ জ্বালল সে। চেরাগ হাতে নিয়ে দরজা লাগাতে যাবে তখনই দেখল বাইরে দাঁড়িয়ে সেই কুকুরটি। মানুষের কাছ থেকে নিত্য দুর্ব্যাবহার আর আঘাতে অভ্যস্ত কুকুরটি পথে চেরাগ আলীর মৌনতাকে তার প্রতি ভালবাসার প্রকাশ ধরে নেয়। অনাকাঙ্খিত এই ভালবাসার প্রাপ্তি তার পশু হৃদয়ে সঞ্চার করে স্পর্ধার। আর তাইতো চেরাগ আলীকে আবার দেখতে পেয়ে কুকুর সুলভ আচরণে আপন শীর্ণ লেজটি সে নাড়াতে শুরু করে।

কুকুরটির এমন আচরণে চেরাগ আলী দয়াদ্র হয়ে উঠে। জীর্ণ দেহে ছুটে গিয়ে সে এক ঘটি পান্তা এনে দরজার সামনে রাখল আর ডাকল " আয় খাই যা" আর বলল "আইজগা তুই আঁর কুটুম। " দ্বিধাগ্রস্থ মনে খানিকক্ষন দূরে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়লেও বারংবার স্নেহসিক্ত ডাকে পান্তা ঘটির কাছে আসে চেরাগ আলীর কুটুম। পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় চেরাগ আলী আর কুটুম তৃপ্তিভরে পান্তা খেয়ে যায়। মাঝে মাঝে পান্তা ঘটি থেকে মুখ তুলে চেরাগ আলীর দিকে তাকায় আর ভালবাসার বিনিময়ে লেজ নেড়ে তার প্রকাশ ঘটায়।

তখনই চেরাগ আলী বলে উঠে "খা খা, তুইতো আইজগা আঁর কুটুম। খা হেট ভরি খা। " কুটুমকে দরজার বাহিরে রাত্রিযাপনের অধিকার দিয়ে ছেঁড়া কাঁথার উষ্ণতায় মাটিতে পাতা বিছানায় গা এলিয়ে দেয় চেরাগ আলী। বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা সকালের সূর্য্যের আলো চোখে পড়লে ঘুম ভাঙ্গে তার। বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই অনুভব করল তার পিঠের বিপরীতে আরেকটি উষ্ণ শরীর।

ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে সেটি খানিকটা ফাঁক করা আর সেই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করা আলোয় দেখল তার গত রাতের কুটুম তার গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। জয়তুন্নেসার মৃত্যুর পর এই প্রথম সে নিজ ব্যাতীত অন্য কারো শরীরের উত্তাপ অনুভব করল। কুকুরটির শরীরের উষ্ণতা প্রয়োগের অভাবে জমাট বাঁধা স্নেহ, মায়া-মমতার মত গুনাবলী গুলোকে গলিয়ে তার হৃদয় অভ্যন্তরে অতি মানবিক এক ঝর্ণার ধারা বইয়ে দিল। যে দ্বিধার কারনে গত রাতে কুকুরটিকে সে শীতার্ত মাঘের রাতে গৃহে অনুপ্রবেশের অধিকার দেয়নি সেই দ্বিধা এখন তার কাছে তুচ্ছ মানবিক অহংকার বলে মনে হল। চেরাগ আলী আলতো পরশে তার কুটুমের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে মাথা তুলে সে চেরাগ আলীর দিকে একবার তাকিয়ে আবার তার প্রসারিত সম্মুখ পদযুগলের উপর মাথা রেখে বিশ্রামে নিবিষ্ট হয়।

চেরাগ আলী নিজেও জানে না কেন তার হৃদয়ে আজ এক অদ্ভূত পুলক অনুভূত হচ্ছে। অবহেলিত সকল কিছুকেই আজ তার আপনার করে নিতে ইচ্ছে করছে। ঘরের কোনে অযাচিতভাবে বেড়ে উঠা কুমড়োলতাটিও আজ তার দৃষ্টি এড়ায় না। জ্বরাগ্রস্থ হাতে কোথা হতে এক দলা মাটি আর গোবর এনে কুমড়োলতাটির গোড়ায় দিল। পেছন পেছন অনুসরন করে লেজ নেড়ে কুটুমও যেন চেরাগ আলীকে উৎসাহ দিতে এতটুকু কৃপণতা করছে না।

দুই দিন পর। চেরাগ আলী গোসল সেরে দরজা ঠেলে ঘরে ঠুকতে যাবে আর তখনই দেখল তার কুটুম মহোৎসবে তার সকল খাবার হাড়ি চেটে পুটে খাচ্ছে। মাথায় রক্ত চড়ে যায় বৃদ্ধ চেরাগ আলীর। দৌঁড়ে গিয়ে পুরু এ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারল কুটুমের দিকে। স্বশব্দে মাথায় আঘাত করে ভূমিতে পতিত হল গ্লাসটি।

আরেকবার ছোঁড়ার জন্য চেরাগ আলী সেটি আবার তুলে নিতে যাবে আর তখনই ভয়ার্ত কুটুম ভোঁ-দৌঁড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাগে চেরাগ আলী তোতলাতে তোতলাতে বলল "শুয়োরের বাইচ্চা কুত্তা! দুর হ। আদর করি জাগা দি ভুল কইচ্ছি। দুর হ। " রাগ দমে এলে দোরগোড়ায় উবু হয়ে বসল চেরাগ আলী।

নিজের অজান্তেই এদিক-ওদিক ঘুরে চোখ দু'টো যেন কাউকে খুঁজে নিল। ঘুম ঘুম অনুভূত হওয়ায় বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল চেরাগ আলী। হঠাৎ বাইরে সোরগোল শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। বিছানা ছেড়ে দরজায় এসে দাঁড়ায় সে। তাকে দেখে পাথর আর লাঠি হাতে একটি ছেলের দল ছুটে পালিয়ে গেল।

ব্যাপারটি কি দেখতে চেরাগ আলী কয়েক কদম পেরিয়ে উঠোনে নেমে আসে। হঠাৎ সে দেখল তার কুটুম রক্তাক্ত দেহে তার দিকেই দৌঁড়ে আসছে। কুটুমের ঝুলে পড়া বাঁ কান থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। চেরাগ আলীর পায়ের কাছ থেকে অর্ধহাত দূরে এসেই ধপাস করে পড়ে যায় সে। মাটিতে শুয়ে চেরাগ আলীর মুখের দিকে একবার তাকাল কুটুম আর সামনের বাঁ পা চেরাগ আলীর পায়ের দিকে এমন করে প্রসারিত করে দিল যেন তা চেরাগ আলীর পাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলল।

মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করল কুটুম। নিঃস্তব্ধ চেরাগ আলী দেখতে পেল কুটুমের কপালে তার ছুঁড়ে মারা গ্লাসের ক্ষতচিহ্ন এবং তা থেকে ক্ষরিত জমাট রক্ত বিন্দু। চেরাগ আলীর জ্বরাগ্রস্থ গন্ডদেশ বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রু ফোঁটা কুটুমের ঐ ক্ষতচিহ্নের উপর পড়ল। কুটুমের জমাট রক্তবিন্দুসিক্ত হয়ে চেরাগ আলীর অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ( লিখাটি উৎসর্গ করলাম আমার প্রিয় কুকুর DUSTY কে যে গত ১০ই জুন, ২০০৯ মৃত্যুবরণ করল।

Glad i deg DUSTY! )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।