"আঁতুড় ঘর" এবং "ফিরে দেখা আঁতুড় ঘর" নামে পরপর দুটো ধারাবাহিক রচনা প্রকাশের পর একটি উপসংহারের প্রয়োজন বোধ করছি । রচনাটির একটা প্রেক্ষাপট আছে । যেমন আমি জন্মসুত্রে বাংলাদেশী হলেও অনেককাল পর্যন্ত দেশত্যাগের কারণ গুলো পড়ে জানার চেয়ে লোকমুখ থেকে জানার উপরই বেশী নির্ভর করতাম । যেন আমি নিজেই যেখানে ঘটনার অন্যতম পাত্র সেখানে নিজ অভিজ্ঞতার সংগে লোকমুখে শোনা অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নিলেই নিহিত সত্য আহরিত হয়ে যাবে । ফলে একটা বিচিত্র মতামতের গল্প বা তার সংগে নিজের আবেগ দিয়ে একটা বিষয়গত অভিমুখ তৈরী করা হতো ।
প্রথম ধাক্কাটা খেলাম লেখক বন্ধু সুব্রত সেন এর কাছ থেকে । তার প্রশ্নটা ছিলো--তোমার কি জানা আছে যে বাংলায় কোন্ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু দেশভাগ তথা বাংলাভাগ? বঙ্গভঙ্গ বা দেশভাগ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বড় মাপের কাজ কী কী ? প্রথম কথোপকথনটা টেলিফোনে হলেও অচিরেই তার সংগে আমার এই নিয়ে ঘন ঘন কথা হতে লাগলো । আর যত কথা হতে লাগলো আমি ততই অন্ধকার দেখতে লাগলাম । সম্পূর্ণ ভাবে বাঙালী'র দেশভাগ নিয়ে কোনো উপন্যাস বাংলাসাহিত্যে আছে কিনা জানিনা । অংশতঃ আছে ।
উপকাহিনী হিসেবে । যদি না থাকে তবে নেই কেন ? এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি বেশ বিব্রত বোধ করি । বাঙালী'র এই ভারতীয় অংশে প্রশ্নটা বিশেষ আমলও পায়না এখন আর । বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষে বাঙালী কিছুটা পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করেছে বটে, তবে তা বেদনার সমুদ্রে এক ঘটি সান্ত্বনার মতো ।
ঠিক এখান থেকেই আমার কাছে কিছু মতামত তৈরী হতে লাগলো ।
যা একান্ত ব্যাক্তিগত মত হিসেবে গ্রাহ্য করা যেতে পারে । যেমন---
১) বঙ্গভঙ্গ বা দেশ ভাগ বাঙালী মনে মনে বোধ হয় মেনে নিয়েছিলো । এই বাঙালী কোন্ বাঙালী ? এই বাঙালী মূলতঃ সমাজপতি বাঙালী । এরা রাজনীতির কর্ণধার ছিলো । ভাগাভাগির সময়ে এরা সম্মতিসূচক মতামত দিয়েছে ।
লক্ষ্য ছিলো নিজ স্বার্থ । দেশভাগে এদের শুধু সম্পত্তি স্থানান্তরের জন্য সাময়িক আরামের ঘাটতি হয়েছে । আর কিছু নয়। এরা ধর্মে হিন্দু ও মুসলমান ছিল । তবে হিন্দুরা অনেকটাই বেশী ছিলো সংখ্যায় ।
২)বাংলাদেশ এক গ্রামমাতৃক অঞ্চলের ভূখন্ড ছিলো অন্ততঃ সেই সময়। তার ছিলো এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম ব্যবস্থা । বলাবাহুল্য সামন্তপ্রভুরাই ছিলেন গ্রামজীবনের সর্বেসর্বা, অভিভাবক । এখানে আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো যে এইসব প্রভুরা অধিকাংশ ছিলেন ধর্মে হিন্দু । অর্থাৎ বাঙালীজাতির মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ।
যদিও এসব বিষয় তখনকার দিনে এতো সংজ্ঞায়িত হয়ে উঠেনি। এরা কিছু শিক্ষিত ছিলেন , রাজনীতির খবরাখবর রাখতেন, রাখতেন কলকাতা কানেকশান এবং একসময় অর্থাৎ ৩০এর দশকেই বুঝে যান যে আর এখানে নয়, সরে পড়তে হবে । আর সরে পড়লেনও । ধারাবাহিকভাবে এই শ্রেণীটা সরে পড়ে ৩০ থেকে ৪০এর শেষ পর্যন্ত। ফলে ভেঙে পড়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামজীবন একটু একটু করে ।
তৈরী হতে থাকে দেশভাগের প্রেক্ষাপট। তা এর কারণ কী? প্রথমত মুসলিম লীগের উত্থান এবং বৃটিশভারতে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনের সুযোগে বাংলায় মুসলিমলীগের টানা প্রায় দশ বছরের বাংলা শাসন ।
৩)এই অভিভাবকহীনতা যেমন একদিকে তেমনি অন্যদিকে রয়েছে বর্ণবিভক্ত হিন্দুসমাজের নিজস্ব ক্ষত। সেই ক্ষত তার মধ্যে বিভেদ তৈরি করেছিলো যা তার আন্তঃসামাজিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিলো । এর সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তৎকালীন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নেতা যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের নেতৃত্বে জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাবকে সমর্থন করে ।
শুধু সমর্থন করা নয়, রীতিমত পাকিস্তান মন্ত্রীসভায় ক্যাবিনেট পর্যায়ের মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন । নেতৃত্বের মোহ, অমরত্বের মোহ, ক্ষমতার মোহ ----তার উত্থান ও পরিণতি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রচুর রয়েছে । তবে যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের পরিণতি খুবই করুণ হয়েছিলো । এবিষয়ে তার পরবর্তীতে মন্ত্রীসভা থেকে সরে যাওয়া উপলক্ষে যে পদত্যাগপত্রটি লেখেন তা দেশভাগোত্তর পর্যায়ের একটা দলিল বিশেষ । (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।