আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপসংহারে একা একা-- -(শেষ)



গত ২৯শে জুলাই শেষ কিস্তি প্রকাশের পর অনেক সময় কেটে গেল। তার মধ্যে কত কি যে হলো-----যা হোক সার কথা এটাই যে আমি অন্তিম কিস্তিটা লিখে উঠতে পারলামনা । এর জন্য আমার সহৃদয় পাঠক পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবারে লেখার চেষ্টা করছি। ---------------------------------------------------------------------------------- অন্তত বয়সের পরিণতিতে আমি একটা জিনিস বুঝতে পারি যে আমার মাথায় গাঁথা আছে একটা আস্ত বাংলাদেশ । জৈবনিক নানা যাপনের মধ্যে তার উপস্থিতি আমি টের পাই ।

সুযোগ বুঝে কখনো সে মুখ দেখায়,বলে --কি হে ভুলে গেলে নাকি--কথা ছিলো আসার--তা কবে আসছো---ইত্যাদি । কিন্তু চাইলেই যে যাওয়া যায়না এটা তারে বোঝায় কে! উত্তরে তাই বলি যাব যাব সময় হলেই যাবো । মনে মনে জানি সেই সময় যে কবে বের করা যাবে আমি নিজেই জানিনা । ক্রমাগত এইরকম জ্বালাতনে একদিন গা'ঝাড়া দিয়ে উঠি । ভেবে ঠিক করি না একবার ঘুরেই আসি ।

সেই কবে ১৯৮৭ সনে যাতায়াত বাদে মাত্র পাঁচ দিনের একটা ঝড়ো ভ্রমণ, তাতো প্রায় ফিকে হতে চললো---সেইসময়কার নবজাতকটি আজ পূর্ণ যুবক বা যুবতী---সেইসময়কার সব কিছুরইত বয়স বেড়ে গেছে আমার মত। কিন্তু যতই ইচ্ছা হউক উপায়গুলো যে আবার নোতুন করে তৈরি করতে হবে ভেবে মনটা বেশ দমে যায়। অবশ্য এও সাময়িক। মাথার ভেতর বাংলাদেশ নামক হলুদ পাখিটির তারস্বর সহ্য করে কার সাধ্য। সবই সরকারি বিধিনিয়ম।

যা উৎরাতে এক মাসের যায়গায় লেগে গেল প্রায় আট মাস। যেহেতু মুখে মুখে অনেকেই বিষয়টা জেনে গিয়েছিলো তারা কিছুদিন পরপর জিগগেস করে --কবে গেলে বাংলাদেশ ,বা বাংলাদেশ ঘোরা কেমন হলো। উত্তরে আমি বিলম্বের নানা কারণ ব্যাখ্যা করি । করতে করতে সেইসব নানা কারণ আমার তখন মুখস্ত। অনেকসময় কেউ জিগগেস করার আগেই আমি বলতে শুরু করি।

পরে বুঝতে পেরে থেমে যাই কারণ শ্রোতা হয়তো অনেকসময় অন্যবিষয়ে আগ্রহী । এতো গেল বাইরের ব্যাপার। ঘরে তৈরি হয়েছে আরেক সমস্যা । আগের বার একা ছিলাম । স্ত্রী সম্মতি দিয়েছিলেন ।

কারণ কন্যাটি ছোট ছিলো । এবার সেসব ঝামেলা নেই । কন্যাটি বিবাহিতা,স্বাবলম্বী । এবার তিনি বলতে লাগলেন---আমারেও লইয়া যাও--বাপের ভিটা আমিও দেখতাম--আমিওতো বড় হইয়াই আইছিলাম--এইটে পড়তাম--কত বন্ধু বান্ধব আছিলো---মন চায় তারারে দেখতাম-----। বেশ ফ্যাসাদে পড়া গেল।

তারও পাসপোর্ট করতে হবে। এদিকে ছড়িয়ে থাকা আমাদের পরিবারের মধ্যে কথাটা চাউর হয়ে যাওয়াতে একদিন ব্যাংককর্মী ছোটভাইটি বলল---ছোড়দা ভাবছি আমিও যাবো। পাসপোর্ট টা করা আছে অনেকদিন। এসব শুনে সদ্য অসরপ্রাপ্ত মেজদা বলে পাঠালেন ভাবছি আমিও একবার যাব। এভাবে আরো অনেকেই রেডি হয়েছিলো কিন্তু নানাকারণে সমর্থ হয়নি।

শেষপর্যন্ত আমি সস্ত্রীক,ছোটভাই আর মেজদা--এই চারজন তৈরী হলাম । একসময় সত্যি সত্যি আমরা অনেক বিঘ্ন অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম আমাদের সেই জন্ম ভিটেয়। দুঃখ কষ্ট বেদনা আবেগের যা যা প্রকাশ সম্ভব তার সবই হলো। কিন্তু আমার মন শুধু ভেবে যায় অন্য কথা । আসলে প্রকৃত অভাগা হলে যা হয় আরকি! এত সবের মধ্যেও আমার মাথায় ঘুরছে ইতিহাসটা।

ঘুরছে অনেক প্রশ্ন। ফলে কিছুটা নিরুত্তাপই থাকি। স্ত্রী'র প্রশ্ন--কী ব্যাপার তুমি এত চুপচাপ? আসার আগে এত কথা বলতে---আর এখন যখন এসে পড়েছো তখন এত কম কথা কেন? না উত্তর দিতে পারিনি। আসলে কথা বলছিলাম ঠিকই, তবে স্বগত-। আর যাই হউক উৎসব মুখর বাড়িতে ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে কাউকে ত আর নির্বাক করা যায়না ।

স্বীকার করি এই উৎসবেরও এক আন্তরিক মূল্য আছে আমার কাছে। এই হৃদয় আবেগের বহিঃপ্রকাশ মানুষজনকে হয়তো কিছুটা স্বচ্ছ আয়ু দান করে। সদ্যআগত আমাদের নিয়ে বাড়ির লোকজন যে কে কী করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। অনেক অনেক বয়সের ব্যবধানে অনেক অনেক নবীন প্রবীন এত হারানো স্মৃতি নিয়ে বলতে চাইছেন যে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছে কখনো কখনো। কিছু বলার চেয়ে আমার দেখতেই ভালো লাগছে।

মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে দূরে পুকুর পার ছাড়িয়ে ফসল কাটা মাঠের দিকে। মনে পড়ে যাচ্ছে এক ঝলক অনেক কথা। গলার কাছে যেন কী মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভীড় এড়িয়ে একা হয়ে যাচ্ছি যেন অজান্তেই। আক্ষেপটা আবারও শুনতে পাচ্ছি ভেতরে ভেতরে---এই সর্বনাশা ভাগাভাগিটা না করলে কারও ক্ষতি হতো কি? লাভই বা কার হয়েছে।

কেন যেন মনে হয় ক্ষতি বাঙালী হিন্দুদের বেশী হলেও, লাভ বাঙালী মুসলমানেরও হয়েছে বলে মনে হয়না। সামান্য মানুষ হিসেবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় এটাই মনে যে বাঙালীরা ধর্মে যতখানি মুসলমান বা হিন্দু, তার চে অনেক বেশী তারা বাঙালী। আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা এ জায়গাটাতেই আঘাত করা হয়েছে বেশী। আর সেই সাফল্যও তারা পেয়েছে। যুগে যুগে পেয়েছে ।

জ্ঞানে অজ্ঞানে আমাদের কেউ কেউ তাদের সাহায্যও করেছি। তার ফল ভুগেছে বাঙালী। অবশেষে সেই বাঙালী জাতিসত্বাকে মুছে দেয়ার প্রয়াস ধ্বংস করে বাঙালী তার স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছে। আজ এটুকুই সান্ত্বনা । অন্ততঃ আমাদের কাছে, যারা ছিন্নমূল, যারা এই উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আজও নিশিডাকের মত বাল্যকালের ডাক শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।

কেননা বলার মত মানুষেরাও বিগতপ্রায়। আজকের প্রজন্ম হয়তো তেমন করে আর এই বেদনার অর্থ বুঝতে পারেনা। হ্যাঁ, অবধারিত ভাবেই নিজের কাছেই প্রশ্নটা এসে যায় বিগত ৬দশক জুড়ে এই উপমহাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে। রাজনীতিতে অপেশাদার হয়েও সাধারণ মানুষ রাজনীতির অভিমুখ নিয়ে ভাবে। ভাবে আর অসহায় বোধ করে।

মানুষের অস্তিত্বকে কীভাবে জাতধর্মসম্প্রদায় দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। যে কোনো দুইজনের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে যেন জীবনানন্দ কথিত সেই 'আমিষাশী তরবার' । তবুও যে কথা বলে আনন্দ পাই তা হলো এই যে বার দুই আমার বাংলাদেশ ভ্রমণ তা নিয়ে। অস্বীকার করিনা অন্ততঃ প্রথমবার একটু ভয়ই ছিলো। কারণ যে পরিচয়ের কারণে দেশটি ছাড়তে হয়েছিলো তাত নামের সংগে আজও রয়েই গেছে।

যদিও প্রথম বয়স থেকেই ধর্মাচরণের প্রতি আমার আগ্রহ রুচি বা ভয় কোনোটাই নেই। কিন্তু নামের মধ্যেই ত রয়ে গেছে জাতধর্ম । তবু সব ভয়ই অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পরেরবার আরো বেশী। আর সব বারেই সেই সব ছোটবেলাকার মানুষমুখ গুলোর কাছ থেকে পেয়েছি আত্মীয়তার দেশজ ডাক।

কোথাও একবারের জন্য মনে হয়নি আইনতঃ এটা আমার বিদেশ ভ্রমণ। এযেন নিজের দেশে, নিজের বাড়ীতে ফিরে যাচ্ছি। হ্যাঁ, একটা কথা মনে পড়ছে। আমাদের ভাইবোনদের সকলেরই প্রাথমিক ইস্কুলটির নাম ছিলো 'সমাজ ফ্রি প্রাইমারী স্কুল'। এখন তার নাম হয়েছে 'সমাজ উচ্চ বিদ্যালয়'।

আমরা তিন ভাই একদিন সেই স্কুলে যাই। আমাদের পেয়ে শিক্ষক শিক্ষিকারা খুবই আদর যত্ন করলেন । অবশেষে প্রধান শিক্ষক নিজে এসে আমাদের আপ্যায়নও করলেন। স্কুল বাড়িটা সংগে করে ঘুরে ঘুরে দেখালেনও। ফিরে আসার সময় একটা কথা বলে যেন তিনি আমাদের চৈতন্যের একটা দরজা খুলে দিলেন--বললেন,'আপনেরা চলে গেলেন---কেন গেলেন জানিনা---তবে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে গেল---'।

বলতে বলতে উনি হাত মেলালেন, বললেন আমার অবসরের আগে আবার আপনাদের এভাবে স্কুলে আসা যেন দেখতে পাই। বাড়ি ফেরার পথে তিন ভাই তারপর অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারিনি।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।