আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হোস্টেলের স্মৃতিঃ পর্ব-৩



আগের পর্বে অপর্ণাদির কথা বলেছি। এবার হোস্টেলের অন্য কথায় আসি। ক্লাস ফোর-ফাইভ এ হোস্টেলে বেশি মেয়ে ছিল না। আমি ক্লাস ফাইভে উঠতে অপর্ণাদি, শেলীদিরা চলে গেল। রুমকি, চৈতালী এলো।

এভাবে ফোর-ফাইভ এর গুটিকয় মেয়ে সবিতাদির সামনে ছোট্ট হয়েই রয়ে গেল। ৬থেকে সবাই বড়র দলে হয়ে গেল আর আমাদের একটু স্নেহ করত। ঠাকুরবাড়িতে হোমের কেউ ভোরে খুব জোরে শাঁখ বাজাত। ঠাকুরবাড়ির কাজের দায়িত্ব সব চেয়ে বড় দিদিরাই করত। আমাদের মাথার কাছে কোন দিদি ঘণ্টা বাজিয়ে যেত সেই আওয়াজে সব উঠে ঠাকুরবাড়ি যেতাম।

ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে খাবার খেয়ে পড়তে বসতাম, তারপর চান করে, ভাত খেয়ে স্কুল। স্কুল থেকে এসে আবার ভাত খেয়ে মাঠে খেলতে যেতাম। বিকেলে আবার ঠাকুরবাড়ির শঙ্খ ধ্বনি শুনে আরতিতে যেতাম। এসময় রামকৃষ্ণ মিশনের আরাত্রিকের সব গানগুলি আমরা হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনী বাজিয়ে গাইতাম। হল ঘর গম্‌ গম্‌ করত।

আরতি শেষ হলে হোস্টেলে এসে পড়তে বসতাম। শেষে রাতে রুটি খেয়ে ঘুম। এই ছিল রোজের রুটিন। আমাদের প্রতিদিনের কাজের রুটিন আগের রাতে কোন এক দিদিই করে রাখত। তাই দেখে ভোর থেকে কাজ হত।

ভোর ৫টায় আমরা উঠতাম। তার আগে ঠাকুরবাড়ি যার কাজ সে উঠে সেখানে চলে যেত। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে খেয়ে পড়তে বসার আগে যে যার কাজ করে নিত। আমাদের বড় হল ঘর ৪জন মিলে ঝাঁট দিতাম। ৮জনে মুছত।

এ ছাড়া লাইব্রেরী, দিদুর ঘরও পরিষ্কার হত। নিচে বড়দিদিরা কুটনোও কুটতে যেত। সকালের টিফিনের ও রাতের রুটি তৈরিতেও হোস্টেলের মেয়েরা সাহায্য করত। খাবার পরিবেশনের দায়িত্বও আমাদেরই ছিল। আমি যখন এলাম তখন সব চেয়ে ছোট ছিলাম তাই কোন কাজ কেউ করতে দিত না।

মাঝে মাঝে একটু ঝাঁটের কাজ পেলে খুব যত্ন নিয়ে করতাম। এত্তো নোংরা বার করে সবিতাদির দৃষ্টি আকর্সন করতাম। আমাদের হোস্টেলের সামনে সাধু-মাদের ছোট্ট বাড়ি ছিল। ক’জন সন্ন্যাসিনী সেখানে থাকতেন। তবে নিচের তলায় বড়দি কেন থাকতেন বুঝতাম না।

উনি লাল পাড় শাড়ি পড়তেন। ওনার ঘরে গেলে মন ভরে যেত। একতলাতে থাকতেন। ওনার ছোট্ট সাদা-মাটা ঘরে ৩টে জানলা, বাইরে জানলার নিচেই কত্তো বেল ফুলের গাছ, আর ভর্তি সুগন্ধি বেলফুল। গরমে ওনার ঘরের মেঝেতে বসে পড়তে খুব ভাল লাগত।

উপরে সাধু–মা থাকতেন। উনি শাড়ি খুবই কম পরতেন। ভগিনী নিবেদিতার মত গেড়ুয়া বস্ত্র পরতেন। আমাদের পৌরানিক গল্প শোনাতেন আর লজেন্স দিতেন। কখনও রাগ করতেননা বা গম্ভীর থাকতেন না।

তাই ওনাকে দেখলেই আমরা দৌড়ে গিয়ে ঘিরে ধরতাম। আমি তখন বেশ ছোট তাই যাদের কাছ থেকে দেখেছি তাদেরই মনে আছে। তবে শুনতাম ঠাকুরবাড়িতে এক দিদি থাকেন। ৯০এর উপর বয়স। তিনি মা সারদার সাথে ছিলেন।

বাইরে থেকে উৎসবের দিন ওনার কাছে বড় বড় লোকরা আশীর্বাদ নিতে আসতেন। খুব সুস্থ ছিলেন না, তাই বাচ্চাদের ওনার কাছে যেতে দেওয়া হত না। দুর থেকে কয়েকবার ওনাকে দেখেছি। ওনার কাছে নাকি মার মাথার চুলও ছিল! আমাদের হোস্টেলে দিদি-বোন পাতানোর একটা রেওয়াজ ছিল। দিদি যা বলবে তাই বোনকে শুনতে হবে।

দিদিরা অনেক উপকার করত আবার প্রচন্ড শাসনও করত যা অনেক সময় অত্যাচার মনে হত। বোন কি জামা পরবে, কার সাথে কথা বলবে সব দিদি ঠিক করত। আমারও এমন দিদি ছিল আত্রেয়ীদি। কিন্তু সে যে কি ভাল ছিল কি বলব! তাকে যদিও বেশি কাছে পেতাম না। চোখের পাতায় একটা ছোট্ট খুস্‌কুড়ি হল, কেউ গা করল না।

শেষে সেটা বড় হতে হতে পুর চোখ ফুলিয়ে দিল। আত্রেয়ীদিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। মাঝে মাঝে আসত, আবার বারাবারি হলে চলে যেত। শেষে কি হল হোস্টেল ছেরে চলে গেল। একবার হোস্টেলে কি একটা ছোঁয়াচে অসুখ হচ্ছিল তখন আমার ও খুব জ্বর হল।

সবিতাদি আমায় আলাদা রেখে দিল। তখন সারা রাত আত্রেয়ীদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সুমনাদি এসময় এলো। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মত দেখতে। সফিস্টিকেটেড, বেশ চুপচাপ, লেখাপড়ায় খুব ভাল।

ও আমায় বিবেকানন্দের উপর একটা রচনা লিখে দিয়েছিল, যা বহু দিন আমি রেখে দিই। এই সুন্দরী সুমনাদির দিদি হল মুনমুনদি। মুনমুনদি বেঁটে, একটু মোটা, খুব সাধারণ। মুনমুনদিরা ৩বোন হোস্টেলে থাকত। এদের গার্জেন বিশেষ আসত না।

লেখাপড়ায়ও খুব ভাল ছিল না। কেন যেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকত। যখন সুমনাদি এলো মুনমুনদি নিজে থেকেই ওর কত্তো কাজ করে দিত! সুমনাদিও ভাল ভাবে তার সুযোগ নিত। যদিও পরে সুমনাদিও মুনমুনদিকে ভালবেসে ফেলে। যে সুমনাদি বিকেলে মাঠে না গিয়ে বই পড়ত সেও শেষে মুনমুনদিকে নিয়ে মাঠে ঘুরত।

হোস্টেলে সবচেয়ে বড় একজনই ছিল। ১২র নন্দিনীদি। কালো, লম্বা, মুখটা সুন্দর। চায়ের নেশা ছিল। এই একজন যে বারান্দায় ছোট্ট স্টোভ জ্বেলে লিকার চা খেত, চাটা ছাঁকতও না, পাতা থিতিয়ে খেত।

কানাঘুঁসো ছিল এ এক ক্লাসে ২বার করে পড়ে। নন্দিতাদি ১০এ পড়ত। ভিষণ রোগা। একটু কাঠ কাঠ। বেশ ভয় পেতাম।

সারাদিন উল-কাঁটা বুনত। নিজের তৈরি সোয়েটার শীতে পরত। বাড়ি বিশেষ যেতনা। এর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে, খপ্‌-খপ্‌ করে মাছি ধরতে পারত।

নন্দিতাদির সঙ্গে পড়ত রেখা সিং। খুব সুন্দরী। কিন্তু সুন্দরী হলেই যে মন সুন্দর হয় না তা রেখাদিকে দেখে যেনেছি। ছোটদের উপর খুব চোটপাট করত। কখনও ছোটদের মধ্যে বেশি বন্ধুত্ব দেখলে খুব পেছনে লাগত।

ছন্দাদি বোধহয় ৮এ পড়ত। দাঁত উচু, লম্বা, ভাল মানুষ। বড়রা ‘দান্তে’ বলত, এতে খুব কষ্ট পেত। (হোস্টেলে যাদের নাম মনে আছে- সীমা, পিংকি, রুমকি, চৈতালী, সীমা দেবনাথ, অপর্ণাদি, শেলীদি, শর্মিষ্ঠাদি, দেবিকাদি, সুস্মিতাদি, সুনেত্রাদি, ইন্দ্রানীদি, শুক্লাদি, কণিকাদি, সুমনাদি, সুজাতাদি, অলোকাদি, রূপছন্দাদি, ছন্দাদি, মহুয়াদি, লক্ষ্মীদি, শিখাদি, মিতাশাদি, মঞ্জুরীদি, সুছন্দাদি, কাকলিদি, কাকলি মুখার্জিদি, বিপাশাদি, পাপিয়াদি, মঞ্জুদি, সুমিতাদি, তাপসীদি, মুনমুনদি, সম্পাদি, ছবিদি, নন্দিতাদি, নন্দিনীদি, রেখাদি, দীপান্বিতাদি, ডালিয়াদি, চয়নিকাদি, দেবজানীদি, মৌসুমী কর্মকারদি, মৌসুমী ভট্টাচার্যদি, শুভ্রাদি, আত্রেয়ীদি) এভাবে ৩০-৪০জনের কথা বলতে গেলে সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, তার চেয়ে সোজা শিখাদির কথায় আসি। শিখাদিরা ৩জন S.O.S village থেকে হোস্টেলে এলো।

শিখাদির মুখেই শুনতাম ওর ২বছর বয়সে কাজের লোক ওকে চুরি করে, বাড়ির কথা মনে থাকলেও কোন সূত্র দিতে পারেনি। ফলে S.O.S village এ স্থান হয়। এখানে কোন বিধবা বা সম্বলহীনা মহিলাকে ৩-৪টি বাচ্চা ও একটি নাকি ঘর দেওয়া হয়। শিখাদির এমন মা ও ২টি ভাই ছিল। শিখাদিরা ৯এ পড়ত।

কিন্তু বড়দের গ্রুপে হয়েও আমাদের জন্য শিখাদি খুব লড়ত। একটু খেপি ধরনের ছিল। অপর্ণাদি যাবার পর ওরা এলো। আর শিখাদির অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমার খুব ভাল লাগত। ও এক রকম আমার মন্ত্র-গুরু বলা যায়।

বড়রা শিখাদিকে এড়িয়ে চলত। সবিতাদির মুখে মুখেও শিখাদি কথা বলতে পারত। তবু শিখাদির মন কিন্তু খুব নরম ছিল। বিড়াল অসম্ভব ভালবাসত। ও আসার পর কোথা থেকে এক গাদা ছোট্ট ছোট্ট বিড়াল তুলে আনল।

তার মধ্যে একটি ধপ্‌ ধপে সাদা। এটি ওর বিশেষ প্রিয় ছিল। সবিতাদি এসব পছন্দ করতেন না। তাই ছাদের পাশে সিঁড়ির তলায় তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। শিখাদির পরিচালনায় আমরা ছোটরা বিড়ালের মাথার বালিশ, পা-বালিশ বানাতাম।

শিখাদি তার প্রিয় সাদা বিড়ালছানার গলায় লাল সার্টিনের ফিতে, রুমাল-এসব বেঁধে দিত। শিখাদির লিড করার দক্ষতা ছিল। সবিতাদির কাছে শুনেছি শিখাদি এখন শান্তিনিকেতনের টিচার। আশ্রমে কোন অনুষ্ঠান হলে, সবিতাদি হোস্টেলের বাচ্চাদের দায়িত্ব শিখাদিকে দিতেন। আমাকে আর সীমাকে ও নাচ করিয়ে ছিল।

‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে...’ সেই প্রথম আমি নাচ করি। এছাড়া প্রাইমারী স্কুলে যে কোন ছুটির আগে অনুষ্ঠান হত। মাঠে যে নাচ বা গান করত তাকে ঘিরে বাচ্চারা বসত। বড়দি আমাকে গান করতে বলতেন। শিখাদি গান শিখিয়ে দিত।

আবার অনুষ্ঠানের সময় বাচ্চাদের পিছনে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কি গাইছি শুনত, কোথায় আটকে যাব জানত, তাই মুখ নেরে কথাগুলো বলত। আমি বরাবর ভীতু প্রকৃতির, একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে গান করতাম। শিখাদির আমেরিকান বয়ফ্রেন্ড ছিল। S.O.S village এ ওর প্রকৃত অভিভাবকও বোধ হয় কোন আমেরিকানই ছিলেন। তার ছেলের সাথেই শিখাদির ভাব হয়।

শিখাদির জন্মদিনে অনেক গিফট আসে। তার সাথে বড় একটা সুন্দর কারড আসে। যেটা খুলতেই জন্মদিনের সুরটা বাজত। সেই প্রথম দেখলাম। যে কোন ছুটিতে সবাই বাড়ি যেত।

আমরা ক’জন যাদের বাড়ি দুরে তারা রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি যেতাম। ফলে ছুটির পরও আমায় হোস্টেলে থাকতে হত। বড় হলে একদিকে সব খাট ডাঁই করে তুলে রাখা থাকত। ৪-৫ জন থাকতাম। ভিতরটা খাঁ খাঁ করত।

স্কুলও থাকত না। সবিতাদি লাইব্রেরী থেকে ছোটদের জীবনীমুলক বই আমায় পড়তে দিতেন, আবার রাতে পড়া ধরতেন। তখন চাচা চৌধুরী, ফেন্টম ছাড়া কিছুই বাইরের বই পড়তে ভাল লাগত না। সে সময় শিখাদিদেরও কেউ নিতে আসত না। শিখাদি দুপুরে ছাদে বসে আমায় বই পড়ে শোনাত।

সেই শুনে রাতে পড়া দিতাম। পরে শিখাদি আমায় পড়তে বলত আর ও খুব মন দিয়ে শুনত। এই করে আমি গল্পের বই পড়তে শিখি। দুপুরে হোমের তাঁত ঘরের পিছনে বসে, পুকুরে মাছরাঙার খেলা দেখতে দেখতে তেঁতুলের আচার খেতাম। শিখাদিই কিনত।

৫টাকার এত্তো আচার। বিকেলে আমার বন্ধুরা নেই! শিখাদির সাথে ঘুরতাম। ও দেশ স্বাধীনের গল্প বলত। সেই থেকে আমার মনে হয় আমি হোস্টেলে পরাধীন আছি। তার উপর তখন ‘স্বাধীনতা হীনতা কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় হে’ কবিতাটা পড়ছি।

হোস্টেলে টিভি ঠিক হল, কিন্তু রবিবার মহাভারত ছাড়া কিছুই সবিতাদি দেখতে দেন না। একবার রাতে ‘ববি’ সিনেমা দিল। বড়রা দেখবে কিন্তু ৪-৫এর স্টুডেন্টরা টিভির দিকে পিছন করে শোবে। এসব আর ভাল লাগছিল না। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের উদ্দেশ্যে আমি তখন পাপাকে বড় বড় চিঠি পাঠাচ্ছি।

পরে পাপা সেগুলো দেখিয়ে খুব লজ্জায় ফেলত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।