আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হোস্টেলের স্মৃতিঃ পর্ব -১



আনন্দ আশ্রম হোস্টেলের কথা এলে প্রথমেই সবিতাদির কথা বলতে হয়। উনি আমাদের দেখাশোনা করতেন। অনেক বছর পর হোস্টেলে গিয়ে ওনাকে দেখতে গেছিলাম। উনি একদম একরকম আছেন, শুধু কানের পাশে কিছু চুলে সাদা পাক ধরেছে। সবিতাদিকে প্রচন্ড ভয় পেতাম।

স্কুলে পরীক্ষার খাতা সই করাতে আমাদের কাল ঘাম ছুটে যেত। উনি বেশি চ্যাঁচামেচি করতেন না, কিন্তু খুব শাস্তি দিতেন, কান ধরে ঠাস ঠাস করে খুব মারতেন। আমি একবারই ওমন মার খেয়েছিলাম। এছাড়া ছিলেন দিদু। উনি ঠিক কেন আমাদের সাথে উপরে থাকতেন জানি না।

কারণ নিচে অনেক বৃদ্ধারা থাকতেন, মনে হয় নিচে বৃদ্ধাশ্রম ছিল। দুতলা বাড়িতে উপরে সবিতাদি ও দিদুর সাথে আমরা ত্রিশ-চল্লিশজন মেয়ে থাকতাম। বিশাল হল ঘরে দু'দিকে বেড পাতা থাকত। দেওয়ালের দিকে ট্রাঙ্ক রাখতাম। পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট ঘরে দিদু পাঁচ-ছয় জনকে নিয়ে থাকতেন।

নিচে বয়স্ক বৃদ্ধারা থাকতেন, টুকটাক কাজ করতেন। একজনকে মনে পরছে খুব লম্বা, হাত-পা কেমন বেঁকে গেছিল, চুল সব প্রায় পাকা। উনি কেবল লাল পাড় সাদা শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ পরতেন। ইনি তেমন কাজ করতে পারতেন না, সবজি এলে লঙ্কার বোঁটা ছারিয়ে ঝুড়িতে সুন্দর করে রাখতেন। বাকি কেউ আচার করে স্কুলে বিক্রী করতেন।

একজন নাম মনে হয় মুকুলদি, আমাদের স্কুলের সামনে ছোট্ট একটা ক্যান্টিন চালাতেন। দশ পয়সার বড় বড় সুজির বিস্কুট খুব খেতাম। আমাদের বিল্ডিং ছিল ছোট। ওদিকে ঠাকুরবাড়ি চারতলা আর বিশাল। চারতলাতে ঠাকুর ঘর।

রামকৃষ্ণ, সারদামা ও বিবেকানন্দের পুজো হত। সামনে বিশাল দালানের মত জায়গায় আমরা প্রায় চারশ মেয়েরা ও দিদিমনিরা বসে আরতি দেখতাম। দেওয়ালে বিবেকানন্দের বিভিন্ন সময়ের বড় বড় ছবি, সারদামা ও ভগিনী নিবেদিতার সেই বিখ্যাত ছবি- সব থাকত। ঠাকুর ঘরে বিশেষ বিশেষ দিনে খুব বড় বড় উৎসব হত। শিবরাত্রিতে হোম, হোস্টেলের দিদিরা শাড়ি পরে, রাত জাগত।

একাদশীতে রাম-নাম হত, এত ভাল লাগত! এখনও তার সুর কানে বাজে। এই বাড়ির পিছনে লাগয়া আর একটা বিল্ডিং ছিল, সামনে থেকে দেখলে বোঝাই যেত না। ওটাও বেশ বড়। এই দুই বাড়িতেই হোমের তিনশ-সাড়ে তিনশ মেয়ে থাকত। বড় বড় হলে মাটিতেই বিছানা করে শুত।

সকালে আবার হল পরিষ্কার, আমি ভাবতাম এত্ত বিছানা গেল কোথায়! এছাড়া, কদমতলা, কলাবাগানের কাছে একটা বিশাল সেড দেওয়া হলঘর ছিল। অনেকদিন বন্ধ ছিল। হোস্টেলের একশ বা একশ পঁচিশ বছর যখন হল তখন তা খুলে পরিষ্কার হয়। সে সময় অনেক ভাম বের হয়। সেগুলোকে খাঁচায় রাখা হত।

সকালে আমরা দেখতে যেতাম। দুপুরে নাকি চিড়িয়াখানা থেকে এসে নিয়ে যেত। এই হলে সে বার বেশ কিছুদিন ধরে মাইক-টাইক লাগিয়ে অনুষ্ঠান হল। অপর্ণাদি নাটক করল, খুব প্রশংসা পেল। আমিও হারমোনিয়াম নিয়ে মাইকে হল ভর্তি লোকের সামনে কি গাইলাম ভগবান যানেন! তবে স্টেজ থেকে নামতেই বাড়ি থেকে আসা মেজমা বলল সব ভুল হয়েছে, তবে সবিতাদি তার কিছুদিন পর ঠাকুর ঘরে বাইরে থেকে আসা কিছু বিদেশীর সামনে আমায় হারমোনিয়াম নিয়ে বসিয়ে দেয়।

আর এমন ভাগ্য! তখন বোধহয় ঐ একটা গানই শিখেছি। এবারতো খুব লজ্জা করছে! বিদেশীরা কি বুঝল ভগবান যানে! শেষ হতে সবাই খুব আদর করল। এতে সবিতাদি খুব গর্ব বোধ করলেন। হোস্টেলে আমার অলিখিত প্রমশন হল। সবিতাদি যখনই বাইরে যান আমাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে যান।

এবং বাচ্চা মেয়েটাকে টুকটাক খাওয়াতেনও। আমি আসলেই বাইরে কি কি হল তার খবর বন্ধুরা নিত। হোস্টেলটা তখন সবার খাঁচা লাগত। কদমতলার পিছনে, বড় পুকুর ছিল, জাল দিয়ে ঘেরা। তার সামনে একটা বাড়ি ছিল সেখানে হোমের মেয়েদের তাঁত শেখান হত।

প্রায়ই খট্‌, খট্‌ করে আওয়াজ হত। ঠাকুরবাড়ির ঠাকুর ঘরের নিচেরতলায় আশ্রম মার ঘর ছিল। ঘরটাতে গেলে এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হত। আশ্রম মা অনেক দিন মারা গেছিলেন কিন্তু ঘরে ঢুকলে মনে হবে উনি হয়ত একটু বেরিয়েছেন, এক্ষুনি আসবেন। খাটটা টান টান করে পাতা, ওনার ছবি বসান, তাতে কাপড় পরান, পাশে ছোট টেবিল, তাতে পেন, লেখার প্যাড, চশমা।

ওদিকে একটা মিডসেফ। সেখানে খাবারও রাখা হত। আশ্রম মার পায়ের ছাপ দেওয়ালে টাঙান থাকত। সে সময় হোস্টেলে টিভি ছিল না। প্রতি রবিবার ‘রামায়ণ’ সিরিয়াল হত আর ঠাকুরবাড়ি আমরা লাইন করে যেতাম।

বিশাল হলঘরে আগেকার বিশাল কালো-সাদা টিভি। দু পাশে লাইন দিয়ে কুড়ি-ত্রিশটা মোড়া পাতা, যারা বয়স্ক এবং নিচে বসতে পারতেন না তাদের জন্য। আমরা হোস্টেলের গোটা ত্রিশ-চল্লিশ মেয়ে আর হোমের তিনশ-সাড়ে তিনশ মেয়ে এবং তাদের প্রচুর দিদিমনিরা সবাই পূজো করার মত হাত জোর করে বসে ওই একটাই সিরিয়াল সপ্তাহে দেখতাম। একবার এখানে দুপুরে বাঞ্ছারামের বাগান হবে বলে রটে যায়। আর এটা নাকি না দেখলে জীবনই বৃথা।

এদিকে আমাদের স্কুল আছে! কিন্তু হোমের মেয়েগুলো বেশ স্কুল কাটতে পারত। সবিতাদি হোমের মেয়েদের সাথে আমাদের বেশি মেলামেশা পছন্দ করতেন না। আর আমরা গুটি কয় মেয়েকে তিনি হাতের তেলোর মধ্য রাখতেন। ফলে স্কুল কি করে কাটা যায় ভেবে পাচ্ছি না! তবে সবিতাদি বাচ্চাদের অসুখকে ভিষণ ভয় পেতেন। শীত পড়লেই আমাদের লাইন করিয়ে কাঁচা হলদ আর গুড় খাওয়াতেন।

পড়ে কি একটা হোমিওপাতিক মিষ্টি গুলি। শেষেরটাই কেবল ভাল লাগত। কিন্তু উনি দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াতেন তাই ফেলতেও পারতাম না। সবিতাদি কিন্তু অনেক খাবার আমায় জোর করে খাইয়ে খাইয়ে, খেতে শেখান। বাড়িতে কেউ হয়ত অত দেখত না।

আমি ডিমের কুসুম, তেতো, ফল –এসব সবিতাদির দৌলতে খেতে বাধ্য হতাম। তো, স্কুল ফাঁকির প্ল্যান হল অসুখের অযুহাতে। সে সময় দুষ্টু বুদ্ধি গজাচ্ছে মগজে। আমি ক্লাস ফাইভে, আমার সঙ্গী ফোরের পিংকি আর সীমা। ওরা দুটোই আমার চেয়ে লম্বা।

আর নাটের গুরু বেশিটাই পিংকি। ও রাজস্থানী মেয়ে। খুব লম্বা-চওড়া। তখন ও ছোট হয়েও বড়দের কাছেও খুব পাত্তা পাচ্ছে। কারণ ছুটির দিন সবিতাদি ঘরে না থাকলে আমাদের ছোটর দলকে দরজা, সিঁড়িতে পাহারায় বসিয়ে বড় দিদিরা পিংকির নাচ দেখত।

পিংকি ‘এক-দো-তিন-চার-পাঁচ-ছেয়-.........তেরা করু...’ এ সব হিন্দি নাচ নাচত। আমাদের বাড়িতে দাদু একরকম হান্টারের উপর রাখত। টিভি ছিল কিন্তু দেখতে পেতামনা, আক্ষেপও ছিলনা। কারণ আমরা আট ভাই-বোন মনের সুখে টিচার টিচার, চোর-পুলিস, বাড়ি বাড়ি-খুব খেলতাম। ফলে আমি মিঠুন-হেমামালিনীকেও চিনিনা বলে খুব হেও হতাম।

ফলে পিংকি আমাদের লিড করছে তখন। সীমাটা প্রচন্ড ভীতু ছিল। পিংকি কি করে যেন নিচ থেকে গোটা পিয়াজ নিয়ে এলো। আমরা চান করে বগলে সেই পিয়াজ কেটে দিয়ে রোদে বসে গা গরম করে কাঁচু-মাচু মুখে সবিতাদিকে বল্লাম জ্বর হয়েছে। উনি কপালে হাত দিয়ে দেখে আমাদের শুতে পাঠিয়ে, নিজে কাজে চলে গেলেন।

সারা হোস্টেল ফাঁকা। দিদু আর আমরা তিন মূর্তি। দিদু যথারীতি দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ল, হোমের মেয়েকে বলাছিল ওরা একটা নিচ থেকে আওয়াজ দিল, আমরা গুটি গুটি নিচে নেমে এলাম। নিচ ও নিস্তব্ধ। সব প্ল্যান মতই চলছিল।

এবার মেন গেটে গিয়ে দেখি সেটি সবিতাদি তালা মেরে গেছেন। তিনজন যা বোকা বনলাম! তারপর আর কি! মুখ চুন করে গুটি গুটি আবার বিছানায়! পরে রুমকি আর চৈতালী এলে আমি আর পিংকিদের পাত্তা দিতামনা। রুমকি যদিও পিংকিদের সাথে পড়ত। ও অনেক বড় ছিল। বাড়িতে কি সব গন্ডোগোলের জন্য স্কুল যেতে পারেনি।

মামার বাড়িতেই পড়ত। পরে মামারা বিয়ে করলে হোস্টেলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়। তবে ও ক্লাস নাইনের অংকও পারত। বড়দের কতবার ওর কাছে অংক দেখাতে আসতে দেখেছি! চৈতালী আমার সাথেই পড়ত। এবার আমরা তিনজন অভিন্ন আত্মা হলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।