আগের পর্বে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েও একটু পিছতে হচ্ছে। কারণ অপর্ণাদির কথা বলব। মাথায় যখন দুষ্টু বুদ্ধি খেলছে ততদিনে অপর্ণাদি হোস্টেল ছেরে চলে গেছে...শেলীদিও। ক্লাস ফোর স্কুল যেমন হোস্টেলও তেমনি সুন্দর ছিল।
অপর্ণাদির কাছে যে কত কিছু শিখেছি! অথচ ও ক্লাস ফাইভে পড়ত, আমার চেয়ে এক বছরেরই বড়।
হোস্টেলের বাইরে একটা ছোট্ট ফাঁকা জায়গায় অপর্ণাদি আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাগান বানায়। নিজেরাই মাটি খুরি। ইট দিয়ে বর্ডারও দেওয়া হয়। ভিতরে দোপাটি, গ্যাদা-এসব গাছ লাগান হয়। দু’বেলা সবাই জলও দিতাম।
বড়রা মজা করত। তবু সবাই অপর্ণাদিকে খুব ভালবাসতো। অপর্ণাদি নিজে হাতে কোথা থেকে একটা জবার ভাঙ্গা ডাল তুলে আনে, পরম মমতায় সেটা ঐ বাগানে দেওয়ালের ধারে পোঁতে। সবিতাদি পর্যন্ত দুঃখ করেছিলেন-“আহাঃ, মেয়েটা এত ভালবেসে মরা ডালটা পুঁতছে!” আশ্চর্য! সেই ডালেও অপর্ণাদির ভালবাসায় কচি কচি পাতা এলো!
অপর্ণাদি চলে যেতে আস্তে আস্তে বাগানটাও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এত বছর পর গিয়েও সেই জবা গাছটাকে দেখি কত্তো বড় হয়েছে! বেশ ফুলও ধরেছে।
দেখে কি যে আপন মনে হল! কারণ আমরা দু’জনেই যে অপর্ণাদিকে চিনি, আর তখন দু’জনেই যেন একবার অপর্ণাদিকে ভেবে আনন্দও পেলাম।
অপর্ণাদি ফাংশানে দু-তিন দিন, দু-তিনটে নাটকও করেছিল। প্রাইজও পায়।
অপর্ণাদির বাবা ছিল না। কিন্তু ও প্রতিদিন সকালে আমাদের টিফিনে যে রুটি-তরকারি দিত, সেই খাবার থেকে আগে রুটি ছিঁড়ে কাককে খাওয়াত।
একবার বলেছিল বাবা মারা যাবার কিছুদিন পর বাড়িতে একটা কাক এসে খুব ডাকছিল। তখন দুপুরবেলা, অপর্ণাদির মাকে বোধ হয় চাকরি করতে হত, বাড়িতে অপর্ণাদি বোধ হয় একা ছিল। সবে খেতে বসেছিল। কি ভেবে ভাত-ডাল মেখে বারান্দায় দেয়। কাকটা সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করে।
মৌরী-আদা দিয়ে বিঊলীর ডাল আর আলু-পোস্ত অপর্ণাদির বাবা খুব ভালবাসতেন। সেদিন অপর্ণাদি ঠিক তাই খাচ্ছিল। কাকটা খেতে অপর্ণাদির ধারনা হয় তার বাবাই এসেছিলেন। এই স্নেহে প্রতিদিন আগে কাককে খাওয়াত। অপর্ণাদির দেখে আমারও তখন থেকে সেই অভ্যেস হয়েছে।
এছাড়া, অপর্ণাদি অনেক ছোট ছোট গল্প বলত, শুয়ে শুয়ে। আমরা ছোটরা যারা সবিতাদির একটু প্রিয় ছিলাম, তারা ঠিক সবিতাদির সামনে থাকতাম। উনি হলের সামনের দিকে দুটো ছোট্ট আলমারি আর মিটসেফ রেখে নিজের একটা বাউন্ডারী করে নেন। তার ভিতরেই স্টোভ জ্বেলে উনি চা খেতেন, ওনার চায়ের নেশা ছিল। উনি দিদুকে ভিষণ ভালবাস্তেন, একটা লজেন্সও ভাগ করে দিতেন।
তো, ওনার সামনেই দু-তিনটে চৌকি জোড়া দিয়ে আমরা ৫-৬জন বাচ্চা থাকতাম। মাঝে অপর্ণাদি শুত। ও সুন্দর সুন্দর গল্প বলব। আমরা হাঁ করে শুনতাম।
অপর্ণাদি ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীদেরও খুব ভালবাসতো।
কোথাও প্রজাপতি বা টিক্টিকি মরেছে-শেলীদি, আমি, সীমা এসে অপর্ণাদিকে খবর দিতাম। অপর্ণাদি তাকে নিয়ে যেত বড় স্কুলের মাঠে-বকুলতলায়। পিছন পিছন আমরা যেতাম। ছোট্ট কাগজে ঐ প্রাণীটির দেহ অপর্ণাদিই নিয়ে যেত। আমরাও পেছনে কিছু ফুল নিয়ে চলতাম।
আমাদের আশ্রমে ছোট্ট ছোট্ট সুগন্ধি বেল ফুলের অভাব ছিল না। এছাড়া বকুলতলায় অজস্র বকুলফুল পড়ে থাকত। ভাল জায়গায়, যেখানে চট্ করে কারো পা পরবে না, সেখানে গর্ত খুঁড়ে প্রাণিটিকে সমাধি দেওয়া হত। অপর্ণাদি তার উপর কোন চারাগাছ লাগিয়ে দিত। আমরা ফুল ছরিয়ে দিতাম।
অপর্ণাদিকে সবিতাদিও খুব স্নেহ করতেন। সবিতাদিকে দেখতে আগেকার বাংলা অভিনেত্রী মঞ্জু দের মত ছিল, যিনি তপন সিন্হার ‘কাবুলিওয়ালা’য় মিনির মা সাজেন। হোস্টেল ছাড়ার পর যখনই মঞ্জু দের সিনেমা দেখতাম তখনই সবিতাদিকে মনে পড়ত, মঞ্জু দে সে কারণেও আমার খুব প্রিয়। তবে আমাদের সবিতাদিকে সচরাচর হাসতে দেখা যেত না। কিন্তু অপর্ণাদি ঠিক ওনাকে হাসাতে পারত।
অপর্ণাদির মার সারা গায়ে ছোট ছোট আমের মত কি যেন ছিল। অপর্ণাদি খুব সুন্দরী ছিল, কিন্তু মাকে চেনাই যেত না। ওদের অবস্থা তখন বোধ হয় ভাল ছিলনা। বরাবর দেখতাম অপর্ণাদি রঙ চটা, কটা জামা পরত। কিন্তু তখনতো ছোট! অপর্ণাদি যা পরত, যা করত তাই আমার ভাল লাগত।
আমার কাছে অপর্ণাদি রূপকথার রাজকন্যা ছিল। সেই অপর্ণাদি যেই হোস্টেল ছারল আমিও গড্ডালিকায় পরলাম।
এবার যখন হোস্টেলে যাই, তখন সবিতাদিকে পুরনো সবার কথা জিজ্ঞেস করতে করতে অপর্ণাদির কথাও উঠল। উনি একবার কোন কাজে নরেন্দ্রপুর গেছিলেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন হঠাৎ একটা লম্বা মত সুন্দর মেয়ে হেঁট হয়ে ওনাকে প্রণাম করলে উনি অবাক হন।
মেয়েটি পরিচয় দেয়। এই আমাদের অপর্ণাদি। হাসিটা দেখে সবিতাদিও চিনতে পারেন। এই ঘটনা বলতে বলতে সবিতাদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।