আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অর্ধ বাৎসরিক খেরোখাতা - জুলাই ২০০৯

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
ব্লগিংটা এখন সাপ্তাহিক হয়ে গেছে আমার জন্য। রবি থেকে বৃহঃস্পতি পোস্টগুলোতে চোখ বুলাই, পরিচিত কারো বা অন্যরকম হেড লাইন দেখলে পোস্ট পড়া হয়। আগের মত ব্লগিং হয় শুধু শুক্রবারে। এইদিনটা শুধুই আমি আমার জন্য রাখি। টিভিও দেখি, ব্লগিংও করি, ঘুমাই, বিকেল হলে বন্ধুর সাথে দেখা করতে বের হই, এখন আর প্রতিদিন দেখা করার সুযোগ পাই না।

এই বছরটা শুরু হল খুবই ব্যস্ততার মাঝে। থিসিস নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটালাম মার্চের শেষ নাগাদ। ব্লগ থেকে একরকম উধাও ছিলাম সময়টা। মার্চে থিসিস জমা দিলাম। ঢাবি থেকে অফিসিয়ালি শেষ দিনটা বের হতে হল চোখে পানি নিয়ে।

ভালবেসে নয়, ঘৃণায়। ইচ্ছা ছিল জীবনে আর কখনও ঐ পাড়ায় পা দেব না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরপরও যেতে হয়েছে সেখানে। কিভাবে যে ছাত্রজীবনটাতে ইতি পড়ে গেল ধরতেই পারলাম না। থিসিস জমা দেবার পরেই ডিপার্টমেন্টটা কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল।

সেখানে যারা আছে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কাজ আছে, যেমন ছিল কিছু দিন পূর্বে আমারও। অথচ থিসিস জমা দেবার পর থেকেই আমি সেখানে কেমন যেন আগুন্তক হয়ে গেলাম। আমার আর সেখানে কোন কাজ নাই। জুনিয়রা জিজ্ঞাসা করে ভাই কোথায় আছেন এখন, আমি নিরুত্তর। অধিকাংশ কুলাঙ্গার, অপদার্থ, উম্মাদ শিক্ষকের মাঝে তিনচারজন পরম শ্রদ্ধেয় আছেন।

তারা জিজ্ঞাসা করে, 'কি করছ এখন"। আমি বলি, 'আপাতত কিছু না'। বুঝে গেলাম, কিছু ব্যবস্থা না করে আসা চলবে না। যখন ছাত্র ছিলাম তখন আগামী দিনটার জন্য কিছু না কিছু ফিক্সড থাকত। ছাত্রত্ব শেষ করে দেখি মহা সমুদ্রে ছোট্ট ডিঙ্গিতে ভাসছি।

কম্পাস বিহীন আমি দিকভ্রান্ত। যে সৈকত হতে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাবার সুযোগ নেই। এখন শুধু এগিয়ে যাবার পালা, কিন্তু কোথায় যাব, কোন দিকে যাব। ছোটবেলা থেকেই আমি একটির বেশি কাজ একসাথে ঠিক মত করতে পারি না। তাই ছাত্র থাকাকালীন চাকরি বাকরির ধান্ধা করা হয় নাই।

নাক উঁচা বড় ভাইদের তল্পিবাহক হতেও বাঁধত। নিজের মতই থাকতাম, অনেকটা দ্বীপের মত। চারিদিকের মহা সমুদ্রটাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ ছিলাম। প্রথম সপ্তাহ শেষে বুঝলাম, বেকার বসে থাকাটা আর সহ্য করতে পারছি না। বিডিজবস্‌ জাতীয় সাইট খুলে দেখি আমি যেসব চাকরি করতে চাই সেগুলোর কোন সার্কুলার নাই।

যা আছে সেগুলো করতে ইচ্ছা করল না। কেউ উপদেশ দিল, আগে চাকরি ধর, তারপর চয়েজ করার সময় পাবে। আমি কেন জানি না, সেই দিকে পা বাড়ালাম না। একে একে সহপাঠিরা চাকরিতে ঢুকে যাচ্ছিল। আর, আমি কাঙ্খিত চাকরির আশায় সমুদ্রের পানে চেয়ে আছি।

মানুষ জীবন বড় অদ্ভুত। মহাসমুদ্রে কম্পাস বিহীন দিকভ্রান্ত অবস্থায় ধ্রুবতারাকেই দিকনির্দেশক বানাতে পারে, অন্যদিকে কেউ বলেন ধ্রুবতারার সৃষ্টিই পথভ্রান্তর চলার সাথি হবার জন্য। আমার পরিচিত মানুষের জাল তেমন বিস্তৃত না হলেও শত্রুর সংখ্যা সীমিত বা শুন্য। আমি খুঁজে নিলাম, নাকি আমার জন্যই আবির্ভাব হলেন এক বড় ভাই। মানুষের সাথে আজাইরা খাতির গড়তে না পাড়লেও, যার সাথে একটু পরিচয় হয় তার সাথে আমি খুব ভালই জমিয়ে নিতে পারি।

এভাবেই কিছু বড় ভাইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে থিসিস করার সময়। তারাই দেখিয়ে দিলেন, "প্রোপার চ্যানেল"। কিভাবে কি হল জানি না, তবে পরের সপ্তাহেই আমার কাঙ্খিত চাকরিতে ঢুকে গেলাম। "প্রোপার চ্যানেল" শব্দটার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হয় মাস্টার্সের সময়। বিভাগের এক স্যারের ল্যাবে মাঝে মাঝে কিছু কাজে যেতে হত।

গেলেই, সেখানকার এক বড়ভাই বলতেন প্রোপার চ্যানেলে আস। চাকরি খুজতে গিয়ে, চাকরিতে ঢুকে একটা জিনিস বুঝলাম। তাহল, সবই সম্ভব যদি প্রোপার চ্যানেলে আগানো যায়। যেকোন লোক, যেকোন পোস্টে, যেকোন বেতনেই চাকরি অর্জন করতে পারে, যদি সে প্রোপার চ্যানেলে আগায়। যোগ্যতা, ভাল রেজাল্ট এগুলো সেই প্রোপার চ্যানেলের কাজকে সহজ করতে সাহায্য করে।

তবে, শুধু আমি যোগ্য এই আশা নিয়ে বসে রইলে অর্জনের খাতা শুন্যই রয়ে যায়। চাকরি পেলে তবেই যোগ্যতা দেখাবার অবসর। যাইহোক, ঢুকে গেলাম চাকরিতে। শুনেছিলাম কর্মক্ষেত্রে অনেক গ্রুপিং হয়, পক্ষপাতিত্ব হয়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ডিপার্টমেন্টের গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, একটিভ গ্রুপ, ঢিলা গ্রুপ আরো কত কি! ভাগ্যিস আওয়ামী-বিএনপি গ্রুপিং সেখানে নাই।

আমি গিয়ে দেখি, জয়েন করবার আগেই আমি একটা গ্রুপের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছি। প্রথম দুইদিন শুধু বসেই রইলাম। তারপর শুরু হল কাজ দেখা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গ্রুপিংএর কারনে এক সিনিয়র কলিগ নুন্যতম ভদ্রতা ব্যতিরেখে, যাচ্ছেতাই ব্যবহার করল। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম, মুখে হাসি নিয়ে।

আমার পাশে পেলাম আমারই কয়েকজন সিনিয়র আপু ভাইয়াদের। বড় ভাইরা বুঝাল, চাকরি জীবন এমনই, কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। আমার কপাল ভাল যে আমি তাদের সাপোর্ট পাচ্ছি। তারা সেটাও পায় নাই। বুঝলাম ব্যালেন্সের মাঝে আছি।

আমার বাবার কিছু কথা মনে হল। বাবার অফিসে তারই স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু তার ক্ষতি করে যাচ্ছিল । অথচ, অফিসের বাইরে তাদের সম্পর্কে কোন প্রকার টানাপোড়ন দেখি নাই। বাবা বলেছিল, "চাকরিতে টিকে থাকবার বা এগিয়ে যাবার এক এক জনের একএকে স্ট্রাটেজি। এগুলোকে পার্সোনালি নিতে হয় না।

একেই বলে প্রোফেসনালিজম"। বুঝলাম, প্রোফেসনাল হবার সময় হয়ে গেছে। চাকরি করছি প্রায় দুইমাস হতে চলল। এরমাঝে মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়ে গেছে। অনার্সের তুলনায় এবার রেজাল্ট ভালই খারাপ হয়েছে।

শুভাকাঙ্খিরা এমন সহানুভূতি দেখাচ্ছে যেন সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি। মনটা খারাপ হয়েছিল কিছু দিন, নিজের জন্য নয়। আমাদের কয়েকজনের পেছনের একজনকে ফার্স্ট করা হল, যোগ্য একজনকে বঞ্চিত করে। করা হল বলছি এইজন্য যে, একটা নোংরামি করেছে সোকলড শিক্ষকরা। উদ্দেশ্য একটাই, তাদের ভবিষ্যতের কলিগ সিলেকশন।

কেন যেন তারা নিজেদের সমপর্যায়ের লোকদেরই কলিগ হিসেবে পছন্দ করে। আমার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার একটা আকাঙ্খা ছিল। আপাতত, প্রোপার চ্যানেলের অভাবে আর হয়ে উঠবে না। তবে হ্যা, প্রোপার চ্যানেল ধরতে পারলে সবই সম্ভব। এক সিনিয়র বলেছিল, মনে করার কারন নাই "প্রোপার চ্যানেল" ধরাটা বাংলাদেশে অব্যবস্থাপনার ফলাফল।

এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কৌশলি হতে হবে। এটাই, সার্ভাইভালের মূল সূত্র। পেছনে ফিরে তাকাতে চাই না। তবে আশে পাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থানটাকে বিবেচনা করি। আপাতত আমি অন্য কারো চাইতে ভাল আছি, তো অন্য কারো চাইতে খারাপ।

আমার হাতে কিছু অর্জন আছে, আবার আছে কিছু ব্যর্থতা। ভাল খারাপ মিলে জীবনটাকে একটা Steady state এ রেখে দিয়েছে। এটাই জীবন, I'm loving it.
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.