ুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুু ডাস্টবিনে ভালোমন্দ খাবার পাওয়া যায়। কোনটি খেতে বেশ মজা, আবার কোনটি একেবারেই পঁচা। খাবার গুলোতে ময়লা মিশে থাকে। ময়লা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খেতে হয়। শক্ত খাবার গুলো থেকে ময়লা ছাড়ানো সহজ।
কিন্তু নরম খাবার গুলোতে ময়লা, মাটি ইত্যাদি একেবারে মিশে থাকে। তখন ময়লা সহই খাবার খেতে হয়। বেশি ময়লা খেলে আবার পেট ব্যথা করে। তবে পেটের ক্ষুধা মেটাতে হলে বাছাবাছি না করে সবই ক্ষেতে হয়। অনেক সময় লোভে পড়েও ভালো-মন্দ জিনিস খাওয়া হয়ে যায়।
যেমন আজকে পোলাও পড়ে আছে ডাস্টবিনে। ময়লায় মাখামাখি হয়ে থাকলেও লোভ সামলানো যাচ্ছে না। তাই গোগ্রাসে পোলাও গিলছে আলেয়া বেগম। সঙ্গে তার দুই শিশুপুত্র সাহেব আলী আর এখলাস মিয়া। সাহেব আলীর বয়স তিন বৎসর আর এখলাস মিয়ার আট মাস।
আলেয়া বেগম এর আগেও পোলাও খেয়েছে ডাস্টবিন থেকে, কিন্ত সাহেব আলী আর এখলাস মিয়া জীবনে পোলাও খায় নি। আলেয়া বেগম তাই নিজে গোগ্রাসে গিলছে, আর ছেলেদের মুখে পোলাও গুজে দিচ্ছে। ছেলেরা পোলাওয়ের স্বাদ কি তা জানে না। আলেয়া বেগম বুঝতে পারছে পোলাওটা পচে গিয়ে কিছুটা টক হয়ে গেছে। তারপরও তার খেতে ভালই লাগছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই আলেয়া বেগম অবাক হয়ে দেখল একটা দামী গাড়ী এসে থামল ডাস্টবিনের পাশে। গাড়ী থেকে কালো চশমা পড়া বুড়োমতো এক সাহেব নেমে আসল। সাহেব পানির বোতল দিল আলেয়া বেগমের হাতে। খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল, তাই আলেয়া বেগম নিজে দুই পুত্র সহ পানি খেল। পানিতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল তাই একটু পরেই আলেয়া বেগম তার দুই পুত্র সহ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
আব্দুল মালেক দেখলেন এদের শরীর ডাস্টবিনের মতই নোংরা। এদেরকে এ অবস্থায় গাড়ীতে তুললে তার দামী গাড়ী নোংরা হয়ে যাবে। তাই আব্দুল মালিক তার দুই সহযোগীকে ডাকলেন। দুই সহযোগীকে আলেয়া বেগম ও তার পুত্রদের শরীর সাদা পরিষ্কার বড় কাপড় দিয়ে ভালো মত পেচিয়ে নিল। এদের গাড়ীতে তোলার পর এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে দেওয়া হলো যাতে গন্ধ না ছড়ায়।
তারপর আব্দুল মালেক তার দুই সহযোগীসহ ঘুমন্ত আলেয়া বেগম ও তার পুত্রদের ‘রাজপুরী’তে নিয়ে আসলেন।
আব্দুল মালেকের পুরো নাম আব্দুল মালেক ওরফে রাজা মিয়া। নিজের নামে বাড়ির নাম রেখেছেন ‘রাজপুরী’। চারিদিকে উঁচু দেয়াল ঘেরা তিন একর জায়গার বাড়ী দেখতে অনেকটা রাজপুরীর মতই। ঢাকা শহরের এমন আলিশান বাড়ী খুব বেশী নেই।
রাজপুরীর রানী অর্থাৎ আব্দুল মালেক ওরফে রাজামিয়া সাহেবের স্ত্রী মেরিনা নাজনীন। মেরিনা নাজনীন আলেয়া বেগম ও তার দুই শিশুপুত্রকে দেখে খুব খুশি হয়ে হলেন। আনন্দে তার চোখ ঝলমল করে উঠল। আব্দুল মালেকের চোখেও তখন শিকার শেষ করার আনন্দ। তিনি মেরিনা নাজনীনকে দায়িত্ব দিলেন আলেয়া বেগম ও তার পুত্রদের ভালোমত গোসল করানোর।
এদের শরীরের ডাস্টবিনের গন্ধ আগে দূর করতে হবে। তারপর পোষাক-আষাকের ব্যবস্থা করা যাবে। ততক্ষনে আলেয়া ও তার ছেলেদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারা অবাক দৃষ্টিতে রাজপুরীর চারদিক দেখছে। মেরিনা তাদেরকে অন্দর মহলে নিয়ে গেলেন।
আব্দুল মালিক বাড়ীর লনে বসলেন। গাছপালা ঘেরা বিশাল লন। এই আলিশান বাড়ী আর সুবিশাল লন একদিনে হয় নি। আব্দুল মালিক ফিরে গেলেন পঞ্চাশ বছর আগের অতীতে।
১৯৬২ সালের জুলাই মাস।
আব্দুল মালেক বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে ঢাকার সদর ঘাটে এসে নামলেন। এক সপ্তাহ আগে তার পিতার মৃত্যু হয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর কাজের সন্ধানে তিনি ঢাকা শহরে এসেছেন। তার বয়স তখন এগারো, পরনে একটা ময়লা গেঞ্জী আর ছেড়া হাফপেন্ট। সঙ্গে কোন টাকা পয়সা নেই।
জুলাই মাসের উত্তপ্ত দুপুরে রাজা মিয়ার পেট ক্ষুধার জ্বালায় চো চো করছে। হঠাৎ সদরঘাটের এক ময়লার ভাগাড়ে পুরনো পাউরুটি আবিষ্কার করলেন রাজামিয়া। ছাতাপড়া পাউরুটির উপর লেগে থাকা ময়লা রাজামিয়াকে আটকাতে পারল না, ক্ষুধার জ্বালায় গপাগপ সব পাউরুটি খেয়ে শেষ করলেন। ডাস্টবিনের খাবার খেতে দেখে এক পথচারী রাজা মিয়াকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। পথচারী ভদ্রলোক ছিলেন হত দরিদ্র।
তিনি এক পাঞ্জাবী লোকের অধীনে ছোট একটি কারখানায় কেরানির কাজ করতেন। ভদ্রলোক রাজামিয়াকে ঐ কারখানায় শ্রমিকের কাজ জোগাড় করে দিলেন। এরপর রাজামিয়াকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার কারনে রাজামিয়া ধীরে ধীরে কারখানার সবচেয়ে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠলেন। কারখানার মালিক রাজামিয়ার বেতন দ্বিগুন করে দিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে কারখানার মালিক খুব অল্প দামে পুরো ফ্যাক্টরি রাজামিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন। স্বাধীনতার পর রাজা মিয়া আরও কয়েকটি ফ্যাক্টরি করলেন। অল্প দামে ঢাকায় বেশ কিছু জায়গা জমি কিনে ফেললেন। বর্তমানে রাজামিয়া ঢাকা শহরে অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার কেনা জমির দাম হু হু করে বেড়েছে।
বর্তমানে সে জমিতে উঠেছে হাইরাইজ বিল্ডিং। সেই বিল্ডিংগুলোতে আছে শত শত এপার্টমেন্ট। এত সম্পদ থাকার পরও রাজামিয়া পঞ্চাশ বছর আগের সেই ডাস্টবিন থেকে পাউরুটি কুড়িয়ে খাওয়া স্মৃতি এখনো ভুলে যান নি। এখন ঢাকা শহরে বহু মানুষকে দেখা যায় ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খেতে। এসব দৃশ্য দেখে আব্দুল মালেক ওরফে রাজামিয়া কিছুটা স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েন।
মেরিনা নাজনীনের ডাকে মালেক সাহেব সম্বিত ফিরে পেলেন।
‘গোসল করিয়েছ ওদেরকে?’ মালেক সাহেব স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন।
‘ওহ, আর বোলো না। এদের গায়ে যা ময়লা। পুরো একটা সাবান শেষ করে ফেলেছি, তারপরও ময়লা যায় না।
তারপর কুসুম গরম পানিতে লিকুইড সোপ মিশিয়ে ওই পানি গায়ে ঢাললাম। ’ মালেক সাহেবের স্ত্রীর উত্তর দিলেন।
‘লিকুইড সোপ? তার মানে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট ব্যবহার করেছ?’
‘আরে না, লিকুইড বডি সোপ। ঐ যে গতবার ব্যাংকক থেকে নিয়ে আসলাম। ঐটা তো আর ব্যবহারই করা হয় না।
আজ পুরোটাই শেষ করে দিলাম। ’
‘ওহ, ভেরি গুড। থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার। এবার চলতো দেখি ওদের কি অবস্থা এখন। ’
‘অবস্থা ভালোই।
তিনজনকেই খাইয়ে-দাইয়ে নতুন পোষাক পরিয়ে দিয়েছি। ’
মালেক সাহেব স্ত্রী মেরিনাকে নিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করলেন। বিশাল ড্রইংরুমের এক কোনে দামী সোফার উপর বসে আছে আলেয়া বেগম ও তার দুই ছেলে। এদেরকে দেখে মনে হয় না কিছুক্ষন আগেও এরা আস্তাকুড়ে পড়ে ছিল। তিনজনেই বেশ হাসি খুশি।
‘কি ব্যাপার তোমরা এত হাসি খুশি কেন। ভয় করছে না তোমাদের?’ আব্দুল মালেক প্রশ্ন করলেন আলেয়াকে।
‘ডরের কি আছে, খোয়াব দেখতাছি। খোয়াব শেষ হইলেই তো ডর বেশি। ’ আলেয়া চট করে জবাব দিল।
আব্দুল মালেক উচ্চস্বরে হাসলেন। মেরিনাও হাসিতে যোগ দিলেন। তাদের হাসি দেখে আলেয়া কিছুটা ভয় পেল।
দীর্ঘ হাসি থামিয়ে আব্দুল মালেক বললেন-
‘খোয়াব নয়, সত্যি। বিশ্বাস না হলে গায়ে চিমটি কেটে দেখ…’
মালেক সাহেবের কথায় আলেয়া মোটেই আশ্বস্ত হলো না।
বরং তার ভয় আরেকটু যেন বাড়ল।
আব্দুল মালেক আবার বলা শুরু করলেন-
‘শোন আলেয়া, তোমরা যে আস্তাকুড় থেকে এখানে এসেছ, আমি তেমন এক আস্তাকুড় থেকেই আজকের এই অবস্থানে এসেছে। আজকে আমার বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদের কোন অভাব নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাকে অনেক দিয়েছেন। আমার সব সম্পদ দিয়ে তোমার মত শত আলেয়ার ভাগ্য আমি বদলে দিতে পারি।
কিন্তু আমি স্রষ্টার মতো এতটা উদার নই। আমি ক্ষুদ্র এক মানুষ। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার ক্ষুদ্র নিদর্শন হিসেবে আমি আজ তোমার ভাগ্য বদলে দিতে চাই। অবশ্য আমি ভাগ্য বদলে দেওয়ার কেউ নই। আল্লাহই তোমার ভাগ্য বদলে দেবেন আমার ওছিলায়।
ঢাকা শহরে আমার শত শত এপার্টমেন্ট রয়েছে। তা থেকে দুটি এপার্টমেন্ট আমি তোমার নামে লিখে দিলাম। একটিতে তুমি থাকবে। আরেকটি ভাড়া দিয়ে তোমার সংসার চালাবে, সন্তানদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করবে। তোমাকে আর কিছু দিতে পারবনা আমি।
তবে আমি ও আমার স্ত্রী সবসময় তোমাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করব। ’
এটুকু বলে একটু থামলেন আব্দুল মালেক। আলেয়ার ভয় মোটেই কাটেনি। সে শুধু নিজের গায়ে চিমটি কাটছে।
আব্দুল মালেক আবার বলা শুরু করলেন, ‘চিমিটি কেটে লাভ নেই।
তোমার এই সুন্দর স্বপ্ন কোনদিন ভাঙ্গবে না। তুমি এখন তোমার ফ্লাটে চলে যেতে পার। আমার সহযোগিরা তোমাকে তোমার ফ্ল্যাটে পৌছে দেবে। অন্য ফ্ল্যাটটি ভাড়ার অগ্রিম টাকাও ওরা তোমার হাতে তুলে দেবে। ’
আব্দুল মালেকের ফ্ল্যাটের হিসেব-নিকেশ আলেয়ার কানে ঢুকছে না মোটেই।
সে শুধু নিজের গায়ে চিমটি কেটেই চলছে…।
পুনশ্চঃ গল্পটি অর্ধ-সত্য। ইস! যদি পুরো গল্পটাই সত্য হত!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।