আমি অবাক চোখে বিশ্ব দেখি, দৃশ্য সাজাই চোখের তারায়......
গত কয়েকদিনের বিরতিহীন বৃষ্টির সুবাদে পূর্ণেন্দু পত্রীর একটা কবিতার একটা অংশের কথা হঠাৎ করে মনে পড়ল। বিরতিহীন বর্ষণ নিয়ে পত্রীর কথোপকথন সিরিজের একটা কবিতার অংশ ছিল এমন, ‘আকশের বোধহয় পেচ্ছাবের দোষ হয়েছে!’ সে সময় এই অংশটুকু খুব একটা অর্থবোধক মনে হয়নি। কিন্তু আজ হচ্ছে। আকাশের সাম্প্রতিক আচরণ দেখে পত্রীর ধারণাকে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সত্যি বলে মনেই হচ্ছে। কিন্তু আমার মত নগণ্য কারো কিছু মনে হওয়া হওয়িতে তো আর আকাশের কিছু যায় আসেনা।
সেহেতু আমি ছিলাম আমার মন নিয়ে। আকাশ ছিল তার কাজ, বৃষ্টি ঝরানো নিয়ে।
বুধবার দিন আমাদের পত্রিকা বাজারে যায়। এদিন তেমন একটা কাজ থাকে না অফিসে। কিন্তু এই দিনটাতেই কেন যেন আমার সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটে।
বেকাররাই নাকি পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষ। এদিনটায় এক অর্থে যেহেতু আমিও বেকার হয়ে যাই সেহেতু এইদিনে আমার কাজ থাকে অন্যদিনের চেয়েও অনেক অনেক বেশী। তবে সেইসব কাজ কখনও নির্ধারিত থাকে না আগে থেকে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠলাম সাড়ে দশটার দিকে। তারপর খাওয়া- দাওয়া সেরে যখন বের হলাম ঘড়ি তখন ছাড়িয়ে গেছে বারোটার কাঁটা।
টিপ টিপ বৃষ্টি। কোথায় যাওয়া যায়, কী করা যায় ভাবতে লাগলাম। ভেবে পেলাম না কিছুই। রাস্তায় দাড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল আধা ঘন্টা। ভেবে কিছু না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম অফিসে যাই।
হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল পাগলামি। বৃষ্টির মধ্যে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছে হল। ইচ্ছে যখন হয়েই গেছে, কি আর করা! শুরু করলাম হাঁটা। আমার বাসা রামপুরাতে। সেখান থেকে যাবো অফিসে, ইস্কাটনে।
হেঁটে হেঁটে চৌধুরীপাড়া পর্যন্ত আসার পর আবার কোন পাগলামি মাথায় চাপলো কে জানে? মেইন রাস্তায় না থেকে ঢুকে পড়লাম মীরবাগের গলিতে। ওখান দিয়ে রাস্তা ভাঙা বেশ কিছুদিন ধরে। এমনিতেই সরু রাস্তা। তার একপাশে গর্ত করে রাখা হয়েছে। অন্যপাশে কতগুলো পাইপ টাইপ ফেলা।
আর মাঝখানে একটা মূমুর্ষ সাইনবোর্ড দাড় করিয়ে রাখা, সেখানে হলদেটে কালিতে লেখা- সংষ্কার কাজ চলিতেছে!
শুকনো দিনেও প্রায়ই ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলের প্রয়োজন পড়লেও এড়িয়ে গেছি সযতেœ। কিন্তু আজকে যে এই বৃষ্টির মধ্যে কেন ঢুকলাম নিজেও বুঝলাম না। রাস্তায় ঢুকলাম এবং যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো বলে আশা করেছিলাম, তারই মুখোমুখি হলাম। একে তো ভাঙা রাস্তা তারওপর আবার এই রাস্তায় চলছে গাড়ি। সঙ্গে আছে মানুষজন।
বৃষ্টির কল্যাণে রাস্তার কাদার প্রলেপ। সে প্রলেপ ঈষৎ পিচ্ছিল হওয়াতে কয়েকবার হালকা পিছল খেলাম, কিন্তু পিছালাম না। এসে যখন পড়েছি তাহলে যাবোই। গেলাম। এখান দিয়ে হেঁটেই পৌছুলাম মগবাজার।
কিন্তু পৌছাবার পর নিজেকে ভদ্রসমাজের বাসিন্দা বলে নিজেরই মনে হল না। পায়ের গন্ডি ছাড়িয়ে নিচের দিকে ঝুলন্ত প্যান্টের বর্ধিতাংশ কাদায় একেবারে কদাকার হয়ে আছে। পায়ের জুতোর তো আরো খারাপ অবস্থা। সারা শরীর ভেজা। অবাধ্য চুলগুলো থেকে জলধারা এসে পড়ছে চোখের ওপর।
পিছল খেয়ে সামলানোর জন্য কোথায় হাত দিয়েছিলাম কে জানে হাতে লেগেছিল কালো কী যেন। বারবার হাত দিয়ে চোখের ওপরের পানি সরাচ্ছিলাম। আর তাতে মুখে সেই কালো রঙ লেগে গেছে তা টেরই পাই নি। বৃষ্টিতে ভিজে ময়লা লেগে টি-শার্টের অবস্থা আরো যাচ্ছেতাই। এসব আমি জেনেছি আরো পরে।
তাই এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আমি ভজঙ্গলা পরিচ্ছেদ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি খুব ভাব নিয়ে। রাস্তার সবাই দেখলাম আমার দিকে কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে। তখন ভাবলাম বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় এক তরুণকে হেঁটে যেতে দেখে বোধহয় সবাই মুগ্ধ হচ্ছে। তা দেখে আমিও আপ্লুত হয়ে হাঁটতে লাগলাম।
বৃষ্টির কারণে কিছুটা ফাঁকা রাস্তায়, সবার ‘কেমন কেমন’ দৃষ্টির সামনে দিয়ে হেঁটে এসে পৌছুলাম অফিসে। গেট দিয়ে ঢুকতেই দারোয়ান সালাম দিতে গিয়ে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম না। পাত্তাও দিলাম না। সোজা এসে ঢুকলাম রিপোর্টিং রুমে।
ঢোকামাত্রই রুমের সবাই যেন কিছুক্ষণের জন্য পাথরের মূর্তি হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে রইল বজ্রাহতের মত। তারপরই সবার হাসির রোল পরে গেল। কিন্তু কেন? সে কথা বলার সময় কোথায়? সবাই হেসেই কূল পায় না! একটু যখন হাসির দমক থামল, তখন একজন বলল আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখে আসতে। শুনেই ছুটে গেলাম বেসিনের সামনে।
দেখলাম এবং নিজেই বজ্রাহত হয়ে গেলাম। এই সাজসজ্জা নিয়ে এতক্ষণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছি ভাবতেই গা শিউরে উঠল। এবার সবার ‘কেমন কেমন’ দৃষ্টির মানে পরিষ্কার হল, সেটা আসলে কৌতুক মাখা দৃষ্টি! লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। নিজের মেজাজটা নিজের ওপরেই খারাপ হয়ে গেল। অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়েটুয়ে নিজেকে যতটুকু সম্ভব সভ্য করে তুললাম।
তারপর এসে বসলাম নিজের ডেষ্কে। সহকর্মীরা সবাই মৃদু টিপ্পনী কাটতে লাগল! খারাপ করা মেজাজ নিয়ে আমার ডেষ্কের সামনের গ্লাসের বেড়া ডিঙিয়ে তাকালাম আকাশের দিকে, বৃষ্টির দিকে। তারপর অনেকটা সময় কেটে গেল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকেই। আর হঠাৎ করেই কেন যেন মনটা ভাল হয়ে গেল। নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেরই হাসি পেতে লাগল।
মনে হল বৃষ্টিটা তো ভালই। যত যাই হোক কিছুৃটা মজা তো হয়েছে!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হল। অফিসের সবার ঘরে ফেরার তাড়া বাড়তে লাগল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য কেউ বের হতে পারছে না। আমার কখনওই ঘরে ফেরার তাড়া নেই।
তাই এখন আমি দর্শক। দেখতে লাগলাম ভুক্তভোগীদের! আর বৃষ্টিকে। আহা কি অপরূপ বৃষ্টি! কিন্তু আমি ছাড়া আর কাউকেই বৃষ্টির সৌন্দর্য্য দেখে খুব একটা প্রীত হতে দেখলাম না। ঘরে ফিরতে না পেরে সবার মধ্যে দেখলাম এক ধরণের ক্রোধ সঞ্চার হচ্ছে। আর তার বশেই সবাই একসময় বৃষ্টিকে গালাগাল শুরু করে দিল।
সেই গালাগাল শুনে বৃষ্টির মন খারাপ হল কীনা জানি না। তবে আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
হায়! জীবন যাপনের দায় আমাদের এতটাই রুক্ষ করে তুলেছে যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি সুন্দরকে উপভোগ করার মানসিকতা। শুধু বৃষ্টি না আরো সুন্দর অনেক কিছুই এখন আর কাঁপন তুলতে পারে না আমাদের মানসে। ব্যস্ত জীবনের বিভৎস নাগরিকতা আমাদের করে তুলেছে আবেগহীন রক্ত মাংসের পুতুলে।
আহা রে! মনটা খারাপ হয়ে গেল! খুব খারাপ! বৃষ্টির চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে করতে বাধ্য হয়ে বৃষ্টির মাঝেই রওনা দিল ঘরের পথে একজন... দুইজন.... একে একে সবাই। শুধু বসে রইলাম আমি। ফিরুক সবাই ঘরে। আমি বৃষ্টিই দেখবো। সবাইকে তো আর এক হলে চলে না।
আমি না হয় অন্য মানুষ হয়েই রইলাম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।