নিজেকে নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা, এখোনো করে যাচ্ছি . . .
অফিস থেকে বের হলেই পান্থপথের পথটা সোজা হেঁটে তারপর বাস স্ট্যান্ড। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ১০টার উপর, এমনিতেই আজ দেরী হয়েছে তার উপর সন্ধ্যায় প্রচুর বৃষ্টিতে একটা ঠান্ডা আমেজ লেগে আছে আবহাওয়ায়।
লোডশেডিং-এর সময়টাতে ৯টা বাজতে না বাজতেই রাস্তার দু-পাশের দোকানপাটের সবগুলো প্রায় সাটার নামিয়ে ফেলে, যা দিনকাল পড়েছে আজ, অন্ধকারে পথ চলাও বিপদজনক, লেনের পাশে যে সরু জায়গাগুলো - সেখানে বেশীরভাগই উদ্বাস্তু টোকাই, পথ শিশু, বস্তিদের দখলে, প্রায় সময় মাদকাসক্ত আর যৌনকর্মীদের দেখাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বাসের জন্য অপো করছি প্রায় ২০ কি ২৫ মিনিট হবে। যে গন্তব্যে যাব সে রুটের বেশীরভাগই তাদের লাস্ট ট্রিপ ছেড়ে গিয়েছে।
ভাগ্য ভালই বলতে হবে, অনেকণ পর একটা বাস পাওয়া গেল - হাতে গোণা যে কয়েকজন যাত্রী আছে সবাই ওইদিকেই যাবে বোধহয়।
বাসের সামনের দিকে ড্রাইভার যেখানে বসেন ঠিক সেখানে মাত্র একটি লাইট জ্বলছে, পেছনে যেখানটাতে বসে আছি সেদিকটা প্রায় অন্ধকার, জানালার পাশে যে ছেলেটি বসে আছে তাকেও ভালভাবে দেখা যাচ্ছেনা, মাঝে মাঝে রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলো যখন ভেতরে আসছে আবছা আলোয় যতটুকু দেখা যায়।
বয়স কত হবে ছেলেটার ? ২৭ এর বেশী তো নয়ই, মনে হচ্ছে অফিস থেকেই ফিরছে, ইন করা শার্ট-প্যান্ট, হাতে একটা অফিস ব্যগ আর টিফিন ক্যারিয়ার। চোখের কান্তির চেয়ে মুখের মলিনতাটাই বেশী। এর মধ্যে কয়েকবার সময় দেখে নিল হাত ঘড়িটায়।
দু-একবার কথাও বলল মোবাইলে। বোধহয় তারও দেরী হয়ে গিয়েছে।
হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিল ছেলেটা, অনেকণ কোন সাড়া শব্দ নেই, শুধু ব্যস্তহীন - যটহীন পিচ রাস্থায় শো শো করে চলা গাড়ীর শব্দটাই বেশী শোনা যাচ্ছিল। আকষ্মিক খেয়ালে ল্য করলাম ছেলেটি চোখ মুছছে, একবার ভুল হলেও পরেরবার তো আর ভূল হতে পারেনা, ঠিকই কাদঁছে ছেলেটা।
বাসের যখন ভাড়া নিতে এসে লাইটগুলো জ্বেলে দিয়েছিল, ওই আলোয় যতটুকুন তাকে দেখেছি তাতে কান্নার দাগটা আরো স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছিলাম।
নিজেই আগ্রহী হয়ে ...........
- কি হয়েছে তোমার ? কোন সমস্যা ?
(অনেকন কোন উত্তর না পেয়ে)
- তুমি এভাবে কাদঁছ কেন ?
- আমাকে বল তোমার কি হয়েছে ?
- স্যার ভাড়াটা দেন - আমাকে বলল
- ছেলেটাকে বলল - ভাই ভাড়াটা দেন
= আমার কাছে টাকা নেই (স্বল্প স্বরে ছেলেটার বলল)
- এই কয়জন মাত্র যাত্রী উঠাইছি, তার মধ্যে কন ভাড়া নাই -
- আচ্ছা ঠিক আছে, দাড়াও আমি দিয়ে দিচ্ছি
- তুমি কোথায় নামবে ?
= আরিচা
- তোমার কি বাসা সেখানেই ?
.....
- এতদূর থেকে কি প্রতিদিন এভাবে অফিস কর ?
- কিছু বলছনা কেন ?
- আমি তো তোমাকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করলাম
= আমার বাসা সেখানে না
- তাহলে এই রাতে আরিচা কেন যাচ্ছ?
= আমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি
(প্রথমত, ভড়কে একটু বিস্মিত হয়ে যাই)
- কিন্তু আত্মহত্যার জন্য ওখানে যেতে হবে কেন ?
= আমার লাশ যেন কেউ কোনদিন না পায়
(কি বলব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না, আর এভাবে পাশে বসে থাকা একটা জীবন্ত মানুষ কিছুণ পর মৃত্যুর দিকে পা বাড়াবে তাকে কি বলা উচিত, তাও জানি না)
- তোমার নামটা জানতে পারি ?
=......
(বিড়বিড় করে ওর নামটা বলল, বুঝতে পারলাম না)
- তুমি কি করছ এখন
= চাকরী করছি, সাথে পড়াশোনাও
- বেশ ভাল
- কিন্তু ! ...
= আমাকে আজ মরতেই হবে
= আমি যে পাপ করেছি, আমাকেই তার শাস্তি দিতে হবে
- আচ্ছা ঠিক আছে, শোন
- তোমার বাসাতে আর কে কে থাকেন ?
= বাবা, মা আর আমার ছোট ভাই
- তারা কি জানেন তুমি এভাবে ...
= আমার মৃত্যুর পর জানবে
- ঠিক আছে
- তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ, সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার
- কিন্তু বল, তোমার বয়স কত হবে ? ২৭ ?
= ২৭ চলছে
- তোমার মত এ বয়সের ছেলেরা কি করে যান ?
- ইউনিভার্সিটি শেষ করে ভাল চাকরী খুজে, নয়ত শেষ বর্ষে
= আমার সে সৌভাগ্য হয়নি
= ইউনিভার্সিটি ভর্তি হয়েও বাদ দিতে হয়েছে
- একদিক থেকে ভাল, চাকরী করছ, পড়াশোনা শেষে কষ্ট করতে হবেনা
- এ বয়সে ছেলেপুলেরা তো আড্ডা দেয়, হৈ হুল্লোর করে
= আমার কোন বন্ধু নেই
- ঠিক আছে, বাবা - মা তো আছে, ওনারাই তো সবকিছু
= বাবা অসুস্থ, মা একাই সংসার সামলান
- বুঝছি, ছোট ভাই কি করেন
= আমি যখন একা সংসার চালাতে পারছিলাম না, তখন থেকে সেও চাকরী শুরু করে
= আজ বাবা ৭ বছর বিছানায়
= তিনি অসুস্থ হবার পর থেকেই আমাদের সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়
= তখন আমি মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি
- হুমম ! বুঝতে পারছি অনেক স্ট্রাগল করেছ লাইফে
- তোমার কষ্টগুলো কারও সাথে শেয়ার করতে পারতে
= বলেছি তো আমার কোন বন্ধু নেই
= আমি সবসময় একা থেকেছি, একা চলেছি
= আমার বাবা-মা আমাকে খুব বিশ্বাস করেন
= আমার কলেজ - অফিস সবাই খুব ভাল জানেন
= কিন্তু তারপরেও যে পাপ অনেকবার করেছি
= এ কথাতো কেউ জানে না
= যতবার নিজে ভেবেছি ততবারই পাপবোধটা আমাকে ধ্বংস করেছে
- কিন্তু তুমি আত্মহত্যার এমন সিদ্ধান্ত নিলে, অনেক সাহসের ব্যপার
- তুমি কেন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ, আমি এখনও ঠিক তা জানিনা
- হয়ত প্রচন্ড কষ্টবোধ, ােভ, জীবনের প্রতি অতৃপ্ত, বিতৃঞ্চা - কোনটাই জানিনা
= আমি তো আগেই বলেছি, আমি পাপ করেছি - তার শাস্তি দিতে যাচ্ছি
- তুমিই জান, তুমি কি পাপ করেছ, কিন্তু এমন অনেক পাপ তো আমরা প্রতিনিয়তই করছি
- তাই বলে কি, আমরা সবাই আত্মহত্যা করব ?
= আমার ভেতর প্রবল অনুশোচনাবোধ আছে, আমি সেই অনুশোচনার কাছে বারবার হেরে গিয়েছি
= প্রতিজ্ঞা করেছি, আবার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি
= এখন নিজের জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে
= জানেন ? আমি আয়নায় নিজের চেহারার দিকেও তাকাই না
= বিশ্রী লাগে, কুৎসিত মনে হয়
= নিজেকে পাপী ভাবতে আর ভাল লাগেনা
= অপরাধবোধ এতটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে
= সে কষ্ট থেকে আমি রেহাই পেতে চাই
- কিন্তু আত্মহত্যা কি সমাধান দিতে পারবে ?
- তুমি তো শুধু তোমার কথা ভাবলে, বাড়ীতে তোমার বাবা - মা, ভাই
= আমি ওদের কারো কথা ভাবতে চাই না
= আত্মহত্যা আমাকে স্বার্থপর করে তুুলেছে
= আমি আর পাপী হতে চাইনা
= আর কখনো না ...
ছেলেটি এবার অনেক শব্দ করে কাঁদছে। কাঁদুক, কেঁদে যদি ওর মনটা হালকা হয় তারপর সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে সেটাই ঢের ভাল।
আমি ভাবতে থাকি কিন্তু ভাবনার চেয়ে চলন্ত গাড়ির গতির দ্রুততা অনেক বেশী, খুব দ্রুত আমার গন্তেব্যের কাছে পৌছে যাচ্ছি।
= কোথায় নামবেন আপনি ?
(ছেলেটির আকষ্মিক প্রশ্নে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কারণ এতণে এই প্রথম সে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছে)
- কল্যাণপুর
- তুমি চাইলে ..
(ছেলেটি কোন উত্তর করেনা, মাথা নীচু করে থাকে)
আমি আমার গন্তব্যে নেমে যাই, বাসটা আবার দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করেছে, বাসের প্লেটের লাইসেন্স নম্বরটাও এবার আমার কাছে অষ্পষ্ট মনে হলে কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে, হয়ত চোখে ধুলোবালি জমেছে।
বাসটা শুধু যাত্রী-ই বহন করছে না, একজন আত্মহননকারীকেও নিয়ে যাচ্ছে তার মৃত্যুর দিকে, একথা কেউ না জানলেও শুধু জানি আমি আর আত্মহননকারী ছেলেটি।
মৃত্যুর আগে হয়ত ছেলেটির সাথে আর কারো কথা হবেনা, কেউ তাকে একবারের জন্যও ফিরে আসতে বলবেনা, তার পরিবারের কেউ কোনদিন জানতেও পারবেনা কেন কোথায় তাদের সন্তান নিরুদ্দেশ হল, শুধু জানবে সে হারিয়ে গিয়েছে। তাও চিরতরে।
.
.
.
.
.
এমনিতেই আজকাল পত্রিকাগুলোর যে হাল হয়েছে, বিজ্ঞাপণ বাণিজ্যের মাঝে যে কয়েকটা খবর থাকে তাতেই দীর্ঘশ্বাস ওঠার যোগাড়, জঙ্গি, অর্থনৈতিক মন্দা, বিদ্রোহ, আন্দোলন .................... হঠাৎ একটা কোণায় ৪ ইঞ্চি কলামের ছোট্ট নিউজে চোখ আটকে গেল ..
“অজ্ঞাতনামা এক যুবকের লাশ উদ্ধার, .............. প্রাথমিক ধারণায় যুবকটি আত্মহত্যা করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে”
চায়ের কাপের চা-টুকু অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে
ওয়ার্কস্টেশনের ডেক্সটপ পিসিতে শুধু একটা গানের সুর তখন ভেসে আসছে .....
হয়না এমন তো হয়না
নদীর বুকে বৃষ্টি ঝরে
পাহাড় তারে সয়না
সূর্য লাল বৃ সবুজ
আমি কান্দি ঘরের কোনায়
তুমি অবুঝ
বৃ আকাশ সূর্য মিলে
ঝরনার কথা কয়না
নদীর বুকে বৃষ্টি ঝড়ে
পাহাড় তারে সয়না
মেঘ কালো, আধার কালো
মৃত্যুর বুঝি মরণ হলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।