আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেঁচে থাকো সর্দিকাশি - সৈয়দ মুজতবা আলী

চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)

(কিছুদিন আগে সর্দিকাশি হয়ে এই গল্পটার কথা খুব মনে পড়ছিল। ইন্টারনেটে খুঁজে কোথাও পেলাম না। তাই এখানেই তুলে রাখছি। বিশেষ করে ব্লগার শান্তির দেবদূতের জন্য) *** *** *** *** *** *** ভয়ঙ্কর সর্দি হয়েছে। নাক দিয়ে যা জল বেরচ্ছে তা সামলানো রুমালের কর্ম নয়।

ডবল সাইজের বিছানার চাদর নিয়ে আগুনের কাছে বসেছি। হাঁচছি আর নাক ঝাড়ছি, নাক ঝাড়ছি, আর হাঁচছি। বিছানার চাদরের অর্ধেকখানা হয়ে এসেছে, এখন বেছে বেছে শুকনো জায়গা বের করতে হচ্ছে। শীতের দেশ, দোর জানালা বন্ধ, কিচ্ছু খোলার উপায় নেই। জানালা খুললে মনে হয় গৌরীশঙ্করের চূড়োটি যেন হিমালয় ত্যাগ করে আমার ঘরে নাক গলাবার তালে আছেন।

জানি, একই রুমালে বার বার নাক ঝাড়লে সর্দি বেড়েই চলে, কিন্তু উপায় কি? দেশে হলে রকে বসে বাইরে গলা বাড়িয়ে দিয়ে সশব্দে নাক ঝাড়তুম, এ নোংরামির হাত থেকে রক্ষা তো পেতুমই, নাকটাও কাপড়ের ঘষায় ছড়ে যেত না। হঠাৎ মনে পড়ল পরশু দিন এক ডাক্তারের সঙ্গে অপেরাতে আলাপ হয়েছে। ডাকসাঁইটে ডাক্তার-ম্যুনিক শহরে নাম করতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারণ জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে, 'ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়। ' তবু গেলুম তাঁর বাড়ি।

আমার চেহারা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কি। আমি শুধালুম, 'সর্দির ওষুধ আছে? আপনার প্রথম এবং খুব সম্ভব শেষ ভারতীয় রোগীর একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমার এক নাক দিয়ে বেরুচ্ছে রাইন, অন্য নাক দিয়ে ওডার। ' ডাক্তার যদিও জর্মন তবু হাত দুখানি আকাশের দিকে তুলে ধরলেন ফরাসিস্‌ কায়দায়। বললেন, 'অবাক করলেন, স্যার।

সর্দির ওষুধ নেই? কত চান? সর্দির ওষুধ হয় হাজারো রকমের। ' বলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুললেন লাল কেল্লার সদর দরজা পরিমাণ এক আলমারি। চৌকো, গোল, কোমর-মোটা, পেট-ভারী বাহান্ন রকমের বোতল-শিশিতে ভর্তি। নানা রঙের লেবেল, আর সেগুলোর উপর লেখা রয়েছে বিকট বিকট সব লাতিন নাম। এবারে খানদানী ভিয়েনীজ কায়দায় কোমরে দু'ভাঁজ হয়ে, বাও করে বাঁ হাত পেটের উপর রেখে ডান হাত দিয়ে তলোয়ার চালানোর কায়দায় দেরাজের এক প্রান্ত অবধি দেখিয়ে বললেন, 'বেছে নিন, মহারাজ (কথাটা জর্মন ভাষায় চালু আছে); সব সর্দির দাওয়াই।

' আমি সন্দিগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকালুম। ডাক্তার মুখব্যাদন করে পরিতোষের ঈষৎ হাস্য দিয়ে গালের দুটি টোল খোলতাই করে দিয়েছেন--হা-টা লেগে গিয়েছে দু'কানের ডগায়। একটা ওষুধের কটমটে লাতিন নাম অতি কষ্টে উচ্চারণ করে বললুম, 'এর মানে তো জানিনে। ' সদয় হাসি হেসে বললেন, 'আমিও জানিনে, তবে এটুকু জানি, ঠাকুরমা মার্কা কচু-ঘেঁচু মেশানো দিশী দাওয়াই মাত্রেই লম্বা লম্বা লাতিন নাম হয়। ' শুধালুম, 'খেলে সর্দি সারে?' বললেন, 'গলায় একটু আরাম বোধ হয়, নাকের সুড়সুড়িটা হয়তো একটু আধটু কমে।

আমি কখনো পরখ করে দেখিনি। সব পেটেন্ট ওষুধ - নমুনা হিসেবে বিনা পয়সায় পাওয়া। তবে সর্দি সারে না, এ কথা জানি। ' আমি শুধালুম, 'তবে যে বললেন, সর্দির ওষুধ আছে?' বললেন, 'এখনো বলছি আছে কিন্তু সর্দি সারে সে কথা তো বলিনি। ' বুঝলুম, জর্মনি কান্ট হেগেলের দেশ।

বললুম, 'অ। ' ফিসফিস করে ডাক্তার বললেন, 'আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামো ওষুধে সারে না। ' ততক্ষণে আবার আমি হাঁচ্ছো হাঁচ্ছো আরম্ভ করে দিয়েছি। নাক চোখ দিয়ে এবার আর রাইন-ওডার না, এবারে পদ্মা-মেঘনা।

ডাক্তার ডজন দুই কাগজের রুমাল আর একটা ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। ধাক্কাটা সামলে প্রাণভরে জর্মন সর্দিকে অভিসম্পাত দিলুম। দেখি ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছেন। আমার মুখে হয়তো একটু বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। বললেন, 'সর্দি-কাশির গুণও আছে।

' আমি বললুম, 'কচু-হাতী-ঘণ্টা। ' বললেন, 'তর্জমা করে বলুন। ' আমি বললুম, 'কচুর লাতিন নাম জানিনে: হাতী হল 'এলেফান্ট' আর 'ঘণ্টা' মানে 'গ্লকে'। ' 'মানে?' আর বুঝে দরকার নেই: 'এগুলো কটুবাক্য। ' আকাশপানে হানি ভুরুযুগল বললেন, 'অদ্ভুত ভাষা।

হাতী আর ঘণ্টা গালাগাল হয় কি করে! একটা গল্প শুনবেন? সঙ্গে গরম ব্রাণ্ডি?' আমি বললুম, 'প্রথমটাই চলুক। মিক্‌স করা ভালো নয়। ' ডাক্তার বললেন, 'আমি ডাক্তারি শিখেছি বার্লিনে। বছর তিনেক প্র্যাকটিস করার পর একদিন গিয়েছি স্টেশনে, বন্ধুকে বিদেয় দিতে। ফেরার সময় স্টেশন-রেস্তোরাঁয় ঢুকেছি একটা ব্রাণ্ডি খাব বলে।

ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম। দেখি, এক কোণে এক অপরূপ সুন্দরী। অত্যন্ত সাদাসিধে বেশভূষা, -গরীব বললেও চলে --আর তাই বোধ হয় সৌন্দর্যটা পেয়েছে তার চরম খোলতাই। নর্থ সী দেখেছেন? তবে বুঝতেন হব-হব সন্ধ্যায় তার জল কি রকম নীল হয়--তারই মত সুন্দরীর চোখ। দক্ষিণ ইটালিতে কখনো গিয়েছেন? না? তবে বুঝতেন সেখানে সোনালি রোদে রূপালি প্রজাপতির কি রাগিনী।

তারই মত ব্লণ্ড চুল। ডানয়ুব নদী দেখেছেন? না? তা হলে আমার সব বর্ণনাই বৃথা। ' আমি বললুম, 'বলে যান, রসগ্রহণে আমার কণামাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। ' 'না থাক। ওরকম বেয়ারিং পোস্টের বর্ণনা দিতে আমার মন মানে না।

আমরা ডাক্তার-বদ্যি মানুষ, ভাষা বাবদে মুখ্যু-সুখ্য। অনেক মেহন্নত করে যে একটি মাত্র বর্ণনা কব্জায় এনেছি সেইটেও যদি না বোঝেন তবে আমার শোকটা কোথায় রাখি বলুন তো। ' কাতর হয়ে বললুম, 'নিরাশ করবেন না। ' 'তবে চলুক ত্রিলেগেড্‌ রেস্‌। ' ডানয়ুব নদীর শান্ত-প্রশান্ত ভাবখানা তাঁর মুখের উপর।

অথচ জানেন, ডানয়ুব অগভীর নদী নয়। আর ডানয়ুবের উৎপত্তিস্থল দেখেছেন? না। তা হলে বুঝতেন সেখানে তন্বঙ্গী ডানয়ুব যে রকম লাজুক মেয়ের মত এঁকে বেঁকে আপন শরীর ঢাকতে ব্যস্ত, এ-মেয়ের মুখে তেমনি ছড়ানো রয়েছে লজ্জায় কেমন যেন আঁকুপাঁকু ভাব। 'এই লজ্জার ভাবটার উপরই আমি বিশেষ জোর দিতে চাই। কারণ আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, লজ্জা-শরম বলতে আমরা যা-কিছু বুঝি সে সব মধ্যযুগের পুরনো গল্প থেকে।

বেয়াত্রিচে দান্তেকে দেখে লাজুক হাসি হেসেছিলেন--আমরা তাই নিয়ে কল্পনার জাল বুনি, আজকের দিনে এসব তো আর বার্লিন শহরে পাওয়া যায় না। মধ্যযুগের নাইটদের শিভালরি গেছে আর যাবার সময়ে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে মেয়েদের মুখ থেকে সব লজ্জা সব ব্রীড়া। ' 'কিন্তু আপনার দেশে নিশ্চয়ই এখনো মধুর সেই জিনিসটি দেখতে পাওয়া যায়, আর তার চেয়েও নিশ্চয়, আপনার দেশে লোক এখনো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে। ' 'তাই আপনি বিশ্বাস করবেন, কিন্তু আমি নিজে এখনো করতে পারিনি, কি করে আমার তখন মনে হল, এ মেয়েকে না পেলে আমার চলবে না। ' 'হাসলেন না যে? তার থেকেই বুঝলুম, আপনি ওকীবহাল, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পেরেছেন; কিন্তু জর্মানরা আমার এ-অবস্থার কথা শুনে হাসে।

আর হাসবে নাই বা কেন? চেনা নেই, শোনা নেই, বিদ্যাবুদ্ধিতে মেয়েটা হয়ত অফিসবয়ের চেয়েও আকাট, হয়ত মাতালদের আড্ডায় বিয়ার বিক্রি করে পয়সা কামায়, কিম্বা এও তো হতে পারে যে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এ-সব কোনো কিছুর তত্ত্ব-তালাশ না করে এক ঝটকায় মনস্থির করে ফেলা, এ- মেয়ে না হলে আমার চলবে না! আমি কি খামখেয়ালির চেঙ্গিসখান না হাজারো প্রেমের ডন্‌ জুয়ান্‌? 'ভাবছি আর মাথার চুল ছিঁড়ছি--কোন্‌ অজুহাতে কোন্‌ অছিলায় এঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়। ' 'কিছুতেই কোনো হদীস পাচ্ছিনে, আমাদের মাঝে তিনখানা মাত্র ছোট্ট টেবিলের যে উত্তাল সমুদ্র সেটা পেরিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছই বা কি প্রকারে। প্রবাদ আছে, প্রেমে পড়লে বোকা নাকি বুদ্ধিমান হয়ে যায়--প্রিয়াকে পাওয়ার জন্য তখন তার ফন্দি-ফিকির আর আবিষ্কার কৌশল দেখে পাঁচজনের তাক লেগে যায় আর বুদ্ধিমান নাকি প্রেমে পড়লে হয়ে যায় একদম গবেট--এমন সব কাণ্ড করে বসে যে দশজন তাজ্জব না মেনে যায় না, এ লোকটা এসব পাগলামি করছে কি করে। ' 'এ জীবনে সেই সেদিন আমি প্রথম আবিষ্কার করলুম যে আমি বুদ্ধিমান, কারণ পূর্ণ একঘণ্টা ধরে ভেবে ভেবেও আমি সামান্যতম কৌশল আবিষ্কার করতে পারলুম না, আলাপ করি কোন্‌ কায়দায়।

কিন্তু এহেন হৃদয়াভিরাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেও মন কিছুমাত্র উল্লসিত হল না। তখন বরঞ্চ বোকা বানতে পারলেই হয়ত কোনো একটা কৌশল বেরিয়ে যেত। ' 'ফ্রলাইন উঠে দাঁড়ালেন। কি আর করি। পিছু নিলুম।

তিনি গিয়ে উঠলেন ম্যুনিকের গাড়িতে। আমিও ছুটে গিয়ে টিকিট কাটলুম ম্যুনিকের। কিন্তু এসে দেখি সে কামরার আটটা সীটই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আরো প্রমাণ হয়ে গেল, আমি বুদ্ধিমান, কারণ এ কথা সবাই জানে, বুদ্ধিমানকে ভগবান সাহায্য করলে এ-পৃথিবীতে বোকাদের আর বাঁচতে হত না। আমি ভগবানের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পেলুম না।

' আমি বললুম, 'ভগবানকে দোষ দিচ্ছেন কেন? এ তো কন্দর্প ঠাকুরের ডিপার্টমেন্ট। ' বললেন, 'তাতেই বা কি লাভ? তিনি তো অন্ধ। মেয়েটাকে বানিয়ে দিয়েছেন তাঁরই মত অন্ধ। এই যে আমি একটা এত বড় অ্যাপলো, আমার দিকে একবারের তরে ফিরেও তাকালো না। ওঁকে ডেকে হবে--' আমি বললুম, 'কচু, হাতী, ঘণ্টা।

' এবার ডাক্তার বাঙলা কটুকাটব্যের কদর বুঝলেন। বললেন, 'আহা-হা-হা। ' তারপর জর্মন উচ্চারণে বললেন,'কশু হাটী গন্টা। খাসা গালাগাল। ' আমি বললুম, 'কামরাতে আটজনের সীট ছিল তো বয়েই গেল।

প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। আপনি কোন গতিকে ধাক্কাধাক্কি করে--' বললেন, 'তাজ্জব করালেন। একি আপনার ইণ্ডিয়ান ট্রেন, না সাইবেরিয়াগামী প্রিজনার ভ্যান! চেকার পত্রপাঠ কামরা থেকে বের করে দেবে না? দাঁড়িয়ে রইলুম বাইরের করিডরে ঠায়। দেখি, মেয়েটি যদি খানা-কামরায় যায়। স্টেশনে তো খেয়েছে শুধু কফি।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটলো, কত লোক কত কামরা থেকে উঠলো নামলো কিন্তু আমার স্বর্গপুরী থেকে কোনো--(কটুবাক্য) নামলো না। সব ব্যাটা নিশ্চয়ই যাচ্ছে ম্যুনিক আর কোথাও যেতে পারে না? ম্যুনিক কি পরীস্থান না ম্যুনিকের ফুট-পাথ সোনা দিয়ে গড়া? অবাক করলে এই ইডিয়টগুলো। 'প্রেমে পড়লে নাকি ক্ষুধাতৃষ্ণা লোপ পায়। একবেলার জন্য হয়ত পায়। আমি লাঞ্চ খাইনি, ওদিকে ডিনারের সময় হয়ে গিয়েছে--আমার পেটের ভিতর হুলুধ্বনি জেগে উঠেছে।

এমন সময় মা-মেরির করুণা হল। মেয়েটি চলল খানা-কামরার দিকে। আমিও চললুম ঠিক পিছনে পিছনে। আহা, যদি একটু হোঁচট খেয়ে আমার উপর পড়ে যায়। দুত্তোর, তারও উপায় নেই--উঁচু হিলের জুতো হলে গাড়ির কাঁপুনিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে--এ পরেছে ক্রেপ-সোল্‌।

ঠিক পিছনে পিছনে গিয়ে খানা-কামরায় ঢুকলুম। ওয়েটারটা ভাবলে স্বামী-স্ত্রী। না হলে তরুণ-তরুণী মুখ গুমসো করে খানা-কামরায় ঢুকবে কেন? বসালো নিয়ে একই টেবিলে--মুখোমুখি। হে মা-মেরি, নত্র দাম্‌ গির্জেয় তোমার জন্য আমি একশ'টা মোমবাতি মানত করলুম। দয়া করো, মা, একটা কিছু ফিকির বাৎলাও আলাপ করবার।

বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমান, কোনো সন্দেহ নেই আমি বুদ্ধিমান। কোনো ফিকিরই জুটলও না, অথচ মেয়েটা বসে আছে আমার থেকে দু'হাত দূরে এবং মুখোমুখি। দু'হাত না হয়ে দুলক্ষ যোজনও হতে পারত--কোনো ফারাক হ'ত না। 'জানালা দিয়ে এক ঝটকা কয়লার গুঁড়া এসে টেবিলের উপর পড়ল। মেয়েটি ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই আমি ঝটিতি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে করে ফেললুম আরেক কাণ্ড।

ঠাস করে জানালাটা বুড়ো আঙুলের উপর এসে পড়ে সেটাকে দিল থেৎলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত। 'মা-মেরির অসীম দয়া যে কাণ্ডটা ঘটলো। মেয়েটি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, 'দাঁড়ান আমি ব্যাণ্ডেজ নিয়ে আসছি। ' 'আমি নিজে ডাক্তার, বিবেচনা করুন অবস্থাটা।

রুমাল দিয়ে চেপে ধরলুম আঙুলটাকে। মেয়েটি ছুটে নিয়ে এল কামরা থেকে ফার্স্ট এডের ব্যাণ্ডেজ। তারপর আঙুলটার তদারকি করল শাস্ত্র-সম্মত ডাক্তারি পদ্ধতিতে। বুঝলুম মেডিকেল কলেজে পড়ে। ঝানু ডাক্তার ফার্স্ট এডের ব্যাণ্ডেজ বয়ে নিয়ে বেড়ায় না আর আনাড়ি লোক এরকম ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে পারে না।

' 'আমি তো 'না, না', 'আপনি কেন মিছে মিছে', 'ধন্যবাদ, ধন্যবাদ', 'উঃ, বড্ড লাগছে', 'এতেই হবে', 'ব্যস্‌ ব্যস্‌' করেই যাচ্ছি আর সেই লিলির মত সাদা হাতের পরশ পাচ্ছি। সে কি রকম মখমলের হাত জানেন? বলছি: আপনি কখনো রাইনল্যাণ্ড গিয়েছেন? না? থাক, ভুলেই গিয়েছিলুম প্রতিজ্ঞা করেছি, আপনাকে কোনো বর্ণনা দেব না। ' 'প্রথম পরশে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে যায়, বলে না? বড় খাঁটি কথা। আমি ডাক্তার মানুষ, আমার হাতে কোনো প্রকারের স্পর্শকাতরতা থাকার কথা নয় তবু আমার যে কী অবস্থাটা হয়েছিল আপনাকে সেটা বোঝাই কি করে? মেয়েটি বোধ হয় টের পেয়েছিল, কারণ একবার চকিতের তরে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বন্ধ করে আমার দিকে মাথা তুলে তাকিয়েছিল। ' 'তাতে ছিল বিস্ময়, প্রশ্ন এবং হয়ত বা একটুখানি, অতি সামান্য খুশীর ঝিলিমিলি।

তবে কি আমার হাতের স্পর্শ--? কোন্‌ সাহসে এ বিশ্বাস মনের কোণে ঠাঁই দিই বলুন। ' আমি গুন্‌ গুন্‌ করে বললুম, 'জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না, হায় ভীরু প্রেম হায় রে' ডাক্তার বললেন, 'খাসা মেলডি তো। মানেটাও বলুন। ' বললুম, 'আফ্‌টার্‌ ইউ। আপনি গল্পটা শেষ করুন।

' বললেন, 'গল্প নয়, স্যার; জীবনমরণের কথা হচ্ছে!' আমি শুধালুম, 'কেন, সেপ্টিকের ভয় ছিল নাকি?' রাগের ভাব করে বললেন, 'ইয়োরোপে এসে আপনার কি সব রসকষ শুকিয়ে গিয়েছে? আমাকে হেনেছে প্রেমের বাণ আর আপনি বলছেন অ্যান্টি-সেপ্টিক্‌ আন্‌। ' আমি বললুম, 'অপরাধ নেবেন না। ' বললেন, 'তারপর আমি সুযোগ পেয়ে আরম্ভ করলুম নানা রকমের কথা কইতে। গোল গোল। আমি সে পরিচয় করার জন্য জানকবুল সেটা ঢেকে চেপে।

সঙ্গে সঙ্গে কখনো নুনটা এগিয়ে দি, কখনো ক্রুয়েটটা সরিয়ে নি, কখনো বা বলি, 'মাছটা খাসা ভেজেছে, আপনি একটা খান না; ওহে খানসামা, এদিকে, --ইত্যাদি। ' 'করে করে সুন্দরীর মনটা একটু মোলায়েম করতে পেরেছি বলে মনে একটু ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল। ' 'মেয়েটি লাজুক, কিন্তু ভারী ভদ্র। আমার ভ্যাজর ভ্যাজর কান পেতে শুনলো, দু'একবার ব্লাশ্‌ করলো, সে যা গোলাপি--আপনি কখনো, না, থাক। ' 'কিন্তু খেল মাত্র একটি অমলেট আর দু'স্লাইস রুটি।

নিশ্চয়ই গরীব। ক্ষীণ আশাটার গায়ে একটু গত্তি লাগল। ' এমন সময় ডাক্তারের অ্যাসিস্টেন্ট এসে জানালো রুগী এসেছে। ডাক্তার বললেন, 'এখখুনি আসছি। ' (বাকি অংশ )


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.