shamseerbd@yahoo.com
কেজি ফোর এর ক্লাশ চলছে। ক্লাশ নিচ্ছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। মাঝে মাঝে তাদের এমন ক্লাশ নেবার সাধ জাগে। একটা একটা ইংরেজী শব্দ বলছেন আমরা সবাই লিখছি। খাতা দেখতে গিয়ে আমার খাতার সময় বলে উঠলেন এটা কার।
আমি দাঁড়ালাম। বললেন দশবার কান ধরে উঠবস কর। উঠবস করছি আর আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমার অপরাধ vegetable বানান ভুল লিখছি। vegeteble লিখছি।
লিখার সময় মনে হইছিল table=টেবিল। সো ভেজিটেবল এত table হতে পারেনা। তারপর থেকে এখনও ভেজিটেবল লিখতে গেলে আমার দুবার ভাবতে হয়।
ক্লাশ নিচ্ছিলেন আমার আব্বু।
ছোট বেলায় বিকালে আব্বু আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন আর একটা একটা শব্দ শিখাতেন।
সবচেয়ে প্রিয় ছিল নদীর পাড়ে হাঁটতে যাওয়া আর ফিরার পথে ফানটা / মিরিন্ডা খাওয়া। ছোটবেলার প্রিয় এই জিনিষটা শেষ কবে যে খাইছি। সেভেনআপ তখন অনেক ঝাজ লাগত।
বিকেলে খেলতে যাবার জন্য প্রতিদিন একটা কমন রুটিন ফলো করতে হত। আর তা হচ্ছে ১০টা অংক করে তারপর বের হতে হবে।
তখনযে কি পেইন ছিল ব্যাপারটা।
বাবার হাতে কতযে মার খাইছি। তবে সবচেয়ে পেথেটিক মার খাইছি তরমুজের কারনে। নরমালি তরমুজ আনা হইলে এটার পেট বরাবর কাটা থাকে। এইবার ছিলনা।
বলাহল এটা কাল কাটা হবে। তখন বাসায় ফ্রিজ ও নাই। কে শুনে কার কথা। রাতে আমি চান্সে তরমুজের পেট কেটে খেয়ে সুন্দর করে রেখে দিলাম। দুপুরে তরমুজ কাটতে গিয়ে আম্মু দেখলেন গন্ধ বের হচ্ছে।
তারপর যথারীতি .................।
প্রত্যেক ভাল ফলাফলের পর একটা গিফট ছিল অবধারিত। সেই ছোট্ট বেলায় পাওয়া উড়তে জানা বর্নিল হেলিকপ্টারের কল্যানে পাইলট হবার স্বপ্ন অনেক দিন লালন করেছিলাম। চশমার কল্যানে এই স্বপ্ন পূরন হয়নি , তবে অনেক খুশী হইছিলাম ঐ শৃংখল জীবনে প্রবেশ করতে হয়নি এই ভেবে।
ব্যাডমিন্টন আর নেট নিয়েত সবার সাথে কতনা মাস্তানি করছি।
এরপর ছিল আমাদের বাপ বেটার দিনভর ক্যারাম খেলা।
পঞ্চম শ্রেনীতে বৃত্তি পাওয়ায় আশা আরও বেড়ে গেল। নতুন নিয়ম। অষ্টম এ বৃত্তি কোচিং শুরু হবার পর ছয় মাসের জন্য আমার খেলাধূলা নিষিদ্ধ। সবার বাসার বাইরে তালা লাগানোর কড়া থাকে।
আমার বাসায় ভিতরেও তালা লাগানোর সিষ্টেম করা হল কারন আমি কয়েকদিন পালিয়েছি। তালার উদ্ভোদন হল এমন দিনে যেদিন আমার টিমের ফুটবলে সেমিফাইনাল খেলা। আমি বাসায় বসে আছি আর গোলকিপার ছাড়া দল সেমিফাইনাল খেলছে !!!
আমি কিপিং করি (বেশ ভালই করি আমার তাই ধারনা) এতেও তার আপত্তি। এতে কোন লাভ নেই দৌড়াদৌড়ি হয়না বলে। আমি যে কি অলস তা কে বুঝাবে।
দৌড়াদৌড়ি করতে হয়না বলেইত আমি কিপিং করি ।
খেলাধূলা বন্ধ করে আমি যতনা দুঃখ পেয়েছি সব ভুলে গিয়েছিলাম তার আশা পূরন করতে পেরে।
এসএসসি ফলাফলের পর পুত্র যখন পিতার অনুগামী হয়ে একই কলেজে ভর্তি হল তখন থেকেই যেন আমাদের অন্যরকম বন্ধুত্বের সূচনা। পুরা স্বাধীন জীবন আমার। সব ব্যাপারেই মত দেবার অলিখিত অধিকার তৈরী হয়ে গেল।
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের দুঃখ আমি পদার্থবিদ্যার কোন সমস্যা নিয়েই তার কাছে যাইনা। আমিও সেটা ভালই বুঝতাম। আম্মু বলে ব্যাপার কি। তুই কি সব বুঝিস নাকি। আব্বু উত্তর দেয় ঘরেই আছেত এইজন্য কোন দাম নেই ।
ইন্টার পরীক্ষ্যার আগের দিন আমার ১০৪ ডিগ্রী জ্বর। কিছুই পরতে পারছিনা। আব্বু আম্মু বসে আছেন। আম্মু কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আব্বু আশ্বস্ত করছেন এইবার পরীক্ষ্যা দিতে না পারলে জীবনে এমন কোন ক্ষতি হবেনা।
আমার বুক ফেটে কান্না আসতেছে। অন্ধকার দেখছি সব। সব স্বপ্ন যেন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। জ্বর নিয়েই পরীক্ষা দিলাম। ভাইরাস জ্বরে এত কাবু হয়েছিলাম যে প্রতিটি পরীক্ষায় লেখায় শুরু করতে অনেক সময় লেগে যেত।
প্রত্যাশিত ফলাফল নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম আব্বু অনেকক্ষন কাঁদলেন আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমিও ,আম্মুও।
বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার একমাস আগে আব্বু সিরিয়াস অসুস্হ হয়ে পড়লেন। ঢাকায় এনে হাসপাতালে ভর্তি। ছয়মাস থাকতে হয়েছিল কয়েক দফায়।
একটু সুস্হ্য হলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন তুই চিন্তা করিসনা তোকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবই যত টাকা লাগুক। আপনি এসব নিয়ে চিন্তার দরকার নেই। আমি আগামীবার পরীক্ষা দিব। অসুস্হ শরীরে মন খারাপ করে বসে থাকতেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আব্বুকে সুস্হ্য করে দিলেন।
ঢাকা চিটাগং করতে করতে কিভাবে যেন আমি শাবিপ্রবিতে টিকেও গেলাম সিএসই তে।
প্রথম ছুটিতে বাসায় গেছি। খাওয়ার টেবিলে বসে আব্বু বলছে , শোন টেকনিক্যাল বিষয়ে যারা পড়াশোনা করে তারা কিছুটা কাঠখোট্টা টাইপ হয়ে যায়। মাঝেমাঝে একটু গল্প উপন্যাস ও পড়ার দরকার আছে। খাওয়া শেষে দেখি শুয়েশুয়ে তিনি সুনীলের পূর্বপশ্চিম পড়ছেন।
বেঁচে থাকার জন্য আমার প্রথম খাদ্য হচ্ছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। মজার ব্যাপার হচ্ছে বন্ধুরা বাসায় এলে আমি বেডরূমে গিয়ে শুয়ে থাকি। তাদের আড্ডা জমে উঠে আমার বাপের সাথে।
সৎ ভাবে বেঁচে থাকা এই শিক্ষাটা অনেক যত্ন করে তিনি আজও দিয়ে চলেছেন আমাদের ভাইবোনদের। ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনার সময় অধ্যক্ষের দূর্নীতিতে বাঁধা দেয়ার কারনে তার এনুয়াল রিপোর্টে তিনি বাজে মার্কিং করার কারনে প্রমোশন পেতে অনেক দেরী হয়েছিল।
স্বপ্ন ছিল অধ্যক্ষ্য হিসেবে অবসরে যাবার। আল্লাহ তাকে বঞ্চিত করেননি। পরম আত্মতৃপ্তিতে এই কথা উল্লেখ করেন সবসময়। পরমকরুনাময়ের কাছে সবসময় প্রত্যাশা করেন আমরা ভাই বোনরা যেন সৎ ভাবেই চলি সবসময়। আল্লার কাছে আমাদের চাওয়া ও তাই।
স্বচ্ছলতা থাকলেও দুহাত খুলে খরচ করার সুযোগ কখনোই ছিলনা। এই নিয়ে তার আক্ষেপটা অনেক বড়। পরিবারের বড় হওয়াতে দায়িত্বের ও কমতি ছিলনা। অনেক হিসেব করেই আমার মাকে সংসার চালাতে হত। আমার দাদা মারা যান আমি যখন সেভেনে আর দাদী এসএসসির সময়।
দাদার বড় ভাই এখন ও জীবিত এবং সুস্হ্য। ময়মনসিংহে স্হায়ী হয়ে গেলেও প্রতিবছর রুটিন করে চিটাগং এ আসেন আমাদের বাসায়। আব্বু দুইবছর ময়মনসিংহে লেখাপড়া করেছিলেন। মজার ব্যাপার ছিল বড়ভাই যেহেতু লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তাই মোটামুটি ভাল পরিমাণেই থাকা জায়গা জমির দেখাশোনা করতে গিয়ে আমার দাদা লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। সেই জমিজমার শেষ ঠিকানা হয় বঙ্গোপ সাগর।
তবু বড় ভাই যখন একটি সরকারী মাদ্রাসার প্রধান হন তিনিও সে আলোচনায় তৃপ্তি পেতেন।
জেঠাকে কাছে পেয়ে আব্বুও আপ্লুত হয়ে উঠতেন। আফসোস করে বলতেন জেঠা আজ দেখেন। আল্লাহর রহমতে আমার কোন অভাব নেই। ইচ্ছা হলেই এটা ওটা কিনতে পারি।
ফ্রিজ খুলে দেখেন ফলমূল ভর্তি। অথচ আমার বাপ মাকে মনের শখ মিটিয়ে খাওয়াতে পারিনাই, শখ থাকলেও দুহাত খুলে খরচ করার সুযোগ ছিলনা। গলা ধরে আসে তার। পাশের রূম থেকে আমি শুনি।
দাদু তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেন -শোন আল্লাহ তোমার জন্য যে রিজিক বরাদ্দ রেখেছেন তা না খাওয়া পর্যন্ত তোমার মৃত্যু হবেনা।
আর বরাদ্দের বাইরে কোন কিছুই তুমি ভোগ করতে পারবেনা। দুঃখ করোনা শুধু দোয়া কর।
পরমকরূনাময় আল্লাহর কাছে চাওয়া আমাকে যেন এভাবে আফসোস করতে না হয়। তুমি আমার বাবা মাকে অনেক দীর্ঘজীবি করে দাও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।