চোখ খুবলে নেয়া অন্ধকার, স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দাও!
বাংলাদেশের অস্তিত্ব এবং এদেশ ও ভারতের লাখো মানুষের জীবন বিপন্নকারী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর হীন, প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র "ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প"। টিপাইমুখ বাঁধ তারই একটি অংশ মাত্র। সম্প্রসারণবাদী দেশ হিসেবে দক্ষিন এশিয়ার জনগণের উপর ভারতের যে আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় একচেটিয়া মুনাফার কাছে বিশ্বের জনগণের উপর যে শোষন তা ই আরো নগ্ন এবং নির্মমভাবে প্রকাশিত হয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আমলসিদ সীমান্ত থেকে ১শ কিলোমিটার উজানে ভারতের মনিপুরের চারুচাদপুর জেলায় টিপাইমুখের অবস্থান। সেখানে মিলিত হয়েছে বরাক ও টুইভাই নদী।
এই দুই নদীর সঙ্গমস্থলের ৫শ মিটার ভাটিতে নির্মিত হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। ৩৯০ মিটার দীর্ঘ বাঁধটির উচ্চতা হবে ১৬১ মিটার। ২৮৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বাঁধের জলাধারে মোট পানি ধারণক্ষমতা হবে ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। বাঁধে জলবিদ্যুত কেন্দ্র থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপন্ন হবে। এ বাঁধের কারনে প্রায় ২৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১৬টি গ্রাম পুরোপুরি ডুবে যাবে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৫১টি গ্রাম, বিপন্ন হবে ৪০ হাজারেরও বেশী মানুষের জীবন-জীবিকা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি।
টিপাইমুখ বাঁধের ফলে সিলেটের মরুকরণ ও জীবন-জীবিকার ব্যাপক ক্ষতি হবে
বাঁধের ফলে বরাক নদী থেকে আমলশীদ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানি প্রবাহ বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে কমে যাবে যথাক্রমে ১৬.৩% ও ১৭.৫%। সুরমা-কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুষ্ক করার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান উৎপাদনকারী সিলেট বিভাগসহ কমপক্ষে ৭টি জেলার ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে। বাঁধ নির্মাণের পর থেকে সুরমা-কুশিয়ারার উজানের ৭১% এলাকাই আর স্বাভাবিক মৌসুমে জলমগ্ন হবে না। বাঁধের ফলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার বিশাল অঞ্চল জুড়ে চাষাবাদের জমি, জমির উর্বরতা, মাটির উপরের ও মাটির নীচের পানির স্তর, পুকুর-হাওর-বাওড়, মাছ, জলজ উদ্ভিদ, গোচারণ ভূমি ও পশুখাদ্যের প্রাপ্যতা সব মিলিয়ে সমস্ত জলবায়ু, বাস্তু সংস্থান এবং জীবন-জীবিকার ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে।
বাঁধের ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে
ভারত যে জায়গায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করছে সেটা হলো সারা দুনিয়ার ছয়টা ভয়ংকর ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকার মধ্যে একটি।
গত ১৫০ বছরের মধ্যে টিপাইমুখের ১০০ কিলো মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ৭+ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে ২টি। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের একেবারে অক্ষটিই অবস্থিত হলো বহুল পরিচিত তাইথু ফল্টের উপর অবস্থিত যা সম্ভাব্য একটি ক্রিয়াশীল একটি ফল্ট এবং ভবিষ্যতের যে কোন ভূমিকম্পের এপি সেন্টার হয়ে উঠতে পারে। টিপাইমুখ এলাকায় বাঁধ হলে ভূমিকম্পের ফলে তা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বাঁধ ভাঙ্গার ফলে সিলেটের কৃষিজমি ও নিচু এলাকাসমূহকে ৮ মিটার পানির নীচে ১০ দিন বা তারচেয়েও বেশী সময় ধরে তলিয়ে রাখবে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত এ বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না।
টিপাইমুখে ভারতের একক সিদ্ধান্তে বাঁধ নির্মাণ আন্তর্জাতিক নদী আইনের লঙ্ঘন। যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হেলসিংকি (১৯৬৬) নীতিমালার ৪ ও ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ, অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এজন্য অবশ্যই যেন অন্য দেশের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
একই আইনের ২৯(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- একটি রাষ্ট্র নদী অববাহিকার যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার যেকোন প্রস্তাবিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং ইনস্টলেশনের ব্যাপারে নদী অববাহিকতায় অবস্থিত অন্য যে কোন রাষ্ট্র, এই কাজের ফলে অববাহিকায় ঘটা পরিবর্তনের কারণে যার স্বার্থহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাকে এ ব্যাপারে নোটিস দিতে হবে। নোটিশ গ্রহীতা দেশ যেন প্রস্তাবিত পরিবর্তনের সম্ভাব্য ফলাফলে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী থাকতে হবে।
তাই, আন্তর্জাতিক নদী-নীতি অনুযায়ী ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। ভারত বহু বছর ধরে টিপাইমুখ বাঁধের পরিকল্পনা করছে এমনকি ২০০৬ সালে গোপনে ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে ভারত এসব কিছুই জানায়নি। ফলে আন্তর্জাতিক নদী আইনগুলোর আওতায় বাংলাদেশ ভারতকে বাধ্য করতে পারে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী দিতে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি হতে।
সরকার ভারতীয়দের দালালী করছে
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী সরকারের হাজার হাজার বছরের গড়ে ওঠা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়ার চক্রান্ত করছে।
ভারতের শাসকগোষ্ঠীর এ রকম অন্যায় অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আমাদের শাসকগোষ্ঠী নীরব ভূমিকা পালন করছে। শুধু তাই নয় ভারত সরকার বলছে 'টিপাইমুখ বাঁধের ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না' বাংলাদেশের মন্ত্রীরাও একই কথা বলছে। বাংলাদেশের দালাল নতজানু সরকার অভ্যন্তরীন নদীপথ ব্যবহারের চুক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক দাসত্বমূলক বাণিজ্যচুক্তি নবায়ন এমনকি একের পর এক দেশের স্বার্থবিরোধী নতুন নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে। সরকারের এ ভূমিকার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে দেশের মানুষকে।
প্রয়োজন সংগ্রামের আন্তঃসংযোগ
টিপাইমুখ বাঁধ সাম্রাজ্যবাদী পুজি ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নগ্ন আগ্রাসন যা প্রতিরোধের আন্দোলন ভারতের ভেতরে ও বাইরে উভয় দিকে চলছে।
মণিপুর, মিজোরাম ও আসামে এ আন্দোলন তীব্রতায় রূপ নিয়েছে। মণিপুরের প্রায় ২০টিরও বেশি সংগঠন একযোগে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন কখনও সিলেট কেন্দ্রীক, কখনও রাজধানী কেন্দ্রীক আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করেছে। মুশকিল হলো বাংলাদেশের সংগঠনগুলোর একটা বড় অংশই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে যার যার স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় করছে ফলে ভারত এবং বাংলাদেশের ভেতরের আন্দোলনকে একসূত্রে গেথে জাতীয় পর্যায়ে নিজ নিজ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার যে সম্ভাবনা সেটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিগত সময়ে সরকারে থাকা অবস্থায় টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেয় নি অথচ বর্তমানে ভারত বিরোধী মনোভাব থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তারাও বড় গলায় কথা বলছে।
তাই, সাধারন জনগণকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রমকারী ভারত-বাংলাদেশের একটা আন্ত:সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
সকল ব্লগারের প্রতি আহবান-
গণবিচ্ছিন্ন কোন আন্দোলন বা কর্মসূচী নয়, জাতীয় ভিত্তিতে সত্যিকার গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে সংগঠিত হোন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।