আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কষ্টের মধ্যেও জেগে থাকছে প্রত্যয়ী শপথ

অনিকেত

কষ্টের মধ্যেও জেগে থাকছে প্রত্যয়ী শপথ অনিকেত চক্রবর্তী বাঁকুড়ার রানীবাঁধের আখখুটার মোড়ে প্রতিরোধের ওই মেজাজ দেখে কিন্তু আমাদের একটুও কষ্ট হয়নি। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় মাওবাদীরা কিছু অংশে ‘জনসাধারণের কমিটি’র নামে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে বেশ কিছুদিন ধরেই। প্রতিবাদে সি পি আই (এম) বন্‌ধ ডেকেছিলো ওই এলাকায় বৃহস্পতিবার। সেই বন্‌ধের বিরোধিতায় মাওবাদীরা তথাকথিত ওই কমিটির নামে আখখুটার মোড়ে সভা করবে বলে প্যান্ডেল বাঁধছিল। তাতেও কোনো বাধা দিচ্ছিল না সি পি আই (এম)।

দেওয়ার কথাও নয়। বন্‌ধ ডাকা হয়েছে, সমর্থন করে তাতে অংশ নেওয়া, না নেওয়া মানুষেরই বিষয়। তো, জনসাধারণের কমিটির নামে প্যান্ডেল তৈরিতে বাধা না পেয়ে মাওবাদীরা বোধহয় ভেবেছিল, সি পি আই (এম) মরে গিয়েছে! ভেবেছিল রাজত্ব বোধহয় তাদের! অতএব বিকেলের দিকে ওখানে সি পি আই (এম)-র এক কর্মীকে কাছে পেয়েই তারা তাকে ধরে মারধর শুরু করে। সেই খবর হলুদকানালীতে পৌঁছাতেই সি পি আই (এম) বুঝিয়ে দেয়, না। যা খুশি তা-ই করার অবাধ ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি কাউকে।

প্রতিরোধের আগুনে মেজাজ নিয়ে মানুষের মিছিল শুরু হয়। গন্তব্য আখখুটার মোড়। আর সেই মিছিল দেখেই ‘জনসাধারণের কমিটি’ গুলি বোমা ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু মিছিল তাতে থামেনি। এগিয়েই যায়।

তাদের দেখে অবশেষে পিছু হটে মাওবাদীরা। আখখুটার মোড়ে অবশেষে আলো হয়ে ওঠে প্রতিরোধের কাব্য। প্রতিরোধের আলো জ্বালানো আগুনের এই পরশমণি জ্বালিয়ে রাখা চাই সবার প্রাণে। সবার মনে। এখন এই পরশমণিটাই দরকার আরো বেশি করে।

একটা সময়ের পর যা ব্যবহার করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। বার করে নিয়ে আসতে হয় মনের ভিতর থেকে। এমন কথা শুনে কেউ কেউ ভ্রূ কুঁচকাতে পারেন। বলতে পারেন, দেখেছো! কী সব কথা। তাঁরাই বলবেন এমন কথা, যাঁরা কোচবিহারের শীতলকুচির ছোট মধুসূদনপুর গ্রামের বাসিন্দা সইদা মিঞার পাঁচ বছরের শিশু কছিরামের হাতে গার্ডার দিয়ে চকলেট বোমা বেঁধে তাতে আগুন দিয়ে ফাটানোর জান্তব তৃণমূলী উল্লাস দেখলেও বিচলিত হন না।

বরং উল্লসিত হন এই ভেবে যে, তৃণমূলের সি পি আই (এম)-বিরোধী অভিযানে যুক্ত হচ্ছে কত নতুন নতুন হিংসাত্মক কৌশল। তাঁরাই বলবেন এমন কথা, যাঁরা হুগলীর পোলবা দাদপুরের ওচাই গ্রামে স্বামীহারা মহিলা সরস্বতী কর্মকারকে তাঁর দেওরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান থেকে জোর করে বার করে এনে আবীর মাখানো তৃণমূলী উল্লাস দেখে রেগে যান না। বরং সন্তুষ্ট হন এই ভেবে যে, সি পি আই (এম)-কে সমর্থন করার ফল কী হতে পারে, তা তৃণমূল দলটি বোঝানোর কায়দা ভালোই রপ্ত করেছে। তাঁরাই বলবেন এমন কথা, যাঁরা এস এফ আই করার অপরাধে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র বিকাশ রায়কে ঘিরে ধরে কংগ্রেসীদের নৃশংস মার, এমনকি ভাগীরথীর জলে চুবিয়ে শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টার দৃশ্য দেখেও অসুস্থ হন না। বরং উৎসাহিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, যাক, সি পি এম-কে উৎখাত করার বীভৎসতায় কংগ্রেসী চেষ্টাও তৃণমূলীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতোই হচ্ছে।

এদের কথা ছেড়ে দিন। আমরা যারা সি পি আই (এম) কমী-সমর্থক-দরদী, তারা জানি কেন বিরোধীরা এই পথ বেছে নিচ্ছে এখন এবং কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে আমাদের। আমাদের সেই কাজ অন্য কেউ করে দেবে, এমন ভাবনা ভুল। একটা অঙ্গরাজ্যে একটা সরকার পরিচালনা করতে হচ্ছে আমাদের। তার মানে এই নয়, আমাদের কাজ সরকার করে দেবে।

এই সরকারটা থাকা‌য় ওদের বিপদ কী, তা তো জানে শ্রেণীশত্রুরা। এতদিন রয়েছে সরকারটা, শ্রেণীশত্রুদের দয়ায় নয়। মানুষের কবজির জোরে। একটা রাজ্যে এমন একটা সরকার থাকার ফলে দেশ চালাচ্ছে যারা, তারা তো জানে তাদের সমস্যা হচ্ছে। যা খুশি তাই করা যাচ্ছে না।

অতএব, এই সরকারকে সরাবার ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্র চলবেই। যেমন অতীতেও চলেছে। এখনও চলবে। এই সরকারটা যারা চালাচ্ছে, সেই বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সি পি আই (এম)-কেও আক্রমণ করার জন্য যে ষড়যন্ত্র চলবে, ষড়যন্ত্র চলে, তাও স্বাভাবিক। শুধু ঘাতকবাহিনী দিয়ে আক্রমণ নয়, এমনকি দেশের প্রশাসনকেও যে ব্যবহার করা হবে, তারও তো প্রমাণ মিলছে।

যেমন সি বি আই-কে ব্যবহার করা। হাস্যকরভাবে যেখানে যেমন, সেখানে তেমন আইনী যুক্তি ব্যবহার করেও ওরা যে পার্টিকে আক্রমণ করবে শ্রেণীশত্রুদের প্রতিনিধি হিসাবে, তার প্রমাণও আছে। উদাহরণ দিই? মেদিনীপুর আদালতে সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে সি বি আই-র ছোট আঙারিয়া ষড়যন্ত্র মামলার শুনানির সময় সি বি আই আইনজীবীর সওয়াল শুনছিলাম। তিনি দাবি করছিলেন, ছোট আঙারিয়ায় ২০০১ সালের ৪ঠা জানুয়ারির ঘটনায় ঘটনাস্থলের বাসিন্দা নীলোফার মণ্ডল নামে একটি মেয়ের ফ্রকে রক্তের দাগ ছিলো। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেইরকম কোনো ফ্রক কি আপনারা পেয়েছেন? আদালতে জমা দিয়েছেন? উত্তরে সি বি আই আইনজীবী বিস্মিত হয়ে আদালতের বিচারপতির উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ঘটনা ঘটলো জানুয়ারি মাসে।

আমরা তদন্ত করতে শুরু করি এপ্রিল মাসে। চারমাস বাদে কি কখনও কোনো ঘটনার রক্তমাখা কোনো জিনিস উদ্ধার করা যায়? তেমন কিছু কি আদালতে জমা দেওয়া সম্ভব? আদৌ বাস্তব কি? শুনে মনে পড়ছিল সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে সি বি আই-র সিঙ্গুর ষড়যন্ত্র মামলার কথা। ওই শুনানিতেও উপস্থিত থাকার সুযোগ মিলেছিল। সি বি আই আদালতে ওই মামলায় অভিযুক্ত দেবু মালিকের রক্তের দাগ লাগা তিনটে প্যান্ট পেশ করে বলেছিল, অভিযুক্তের ঘটনাস্থলে থাকা ও যুক্ত হওয়ার প্রমাণ এটা। অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী প্রশ্ন করেছিলেন, অভিযুক্ত কি একসঙ্গে তিনটে প্যান্ট পরেছিল যে তিনটেতেই রক্তের দাগ? প্রশ্ন করেছিলেন, প্যান্টগুলি সি বি আই কবে কার কাছ থেকে উদ্ধার করলো? সি বি আই বলেছিল, এপ্রিল মাসে দেবু মালিকের কাছ থেকেই ঘরে টানানো দড়িতে মেলা অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে এগুলি।

তখনই অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী বলেছিলেন, সিঙ্গুরের ঘটনা ঘটলো ডিসেম্বর মাসে (২০০৬), আর প্যান্ট উদ্ধার হলো চার মাস বাদে। অভিযুক্ত কি চারমাস ধরে ওই রক্তমাখা প্যান্ট দড়িতে মেলে দিয়ে বসেছিলেন কখন সি বি আই এসে এসব বাজেয়াপ্ত করবে বলে? সি বি আই এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। কিন্তু দেখুন, প্রায় একই বিষয় দুটো ঘটনায় সি বি আই দু’রকম যুক্তি দিয়ে কীভাবে সি পি আই (এম)-র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সাজায়। উদাহরণটা দিলাম এজন্য যে প্রশাসন কাজ করবে প্রশাসনের। একাংশ উলটো কাজও করবে।

কথা শুনবে না। যা করা উচিত তা করবে না প্রশাসনের কোনো কোনো প্রতিনিধি। কিন্তু পার্টির কাজ পার্টিকেই করে যেতে হবে। হিঙ্গলগঞ্জের প্রবীণ সি পি আই (এম) বিধায়ককে যারা হেনস্তা করলো, কাদা মাখিয়ে যারা প্রশ্ন করলো, কেমন লাগছে, তাদেরও ছবি ধরা আছে ভিডিও ফুটেজে। প্রশাসন সেটা দেখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কীনা, প্রশাসনের বিষয়।

পার্টিকে চিহ্নিত করে রাখতে হবে ওই লোকগুলিকে। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে যারা মারলো এস এফ আই কর্মীকে, তাদেরও ছবি ধরা আছে। চিহ্নিত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার কাজ কঠিন নয়। যদি প্রশাসন না করে, পার্টির নজরদারি যেন এড়াতে না পারে সেই আক্রমণকারীরা। তার মানে কি পার্টির কাজ পার্টি করছে না? করছে।

পার্টির কাজ পার্টি করছে বলেই গড়বেতার মানুষ যখন মেদিনীপুর আদালতে জড়ো হন সি বি আই-র ষড়যন্ত্রের শিকার পার্টির নেতা-কর্মীদের অভিযোগমুক্ত হওয়ার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে, তখনও গড়বেতার সীমানায় মানুষের সজাগ প্রহরা উঠে যায় না। পার্টির কাজ পার্টি করছে বলেই খানাকুলের উত্তরে মুণ্ডেশ্বরী নদীর পাড়ে গ্রামগুলিতে দিন-রাত জেগে থাকতে হয় যাতে ঘাতক শত্রুরা এসব জায়গা দিয়ে সন্ত্রাসের করিডর না বানাতে পারে। পার্টির কাজ পার্টি করছে বলেই আইলা বিধ্বস্ত সন্দেশখালির ভাঙাতুষখালিতে ভেঙে যাওয়া নদীবাঁধ আবার মেরামত করে পার্টিকেই এমনকি রাত জেগে পাহারা দিতে হয়। যাতে তৃণমূল এসে সেই বাঁধ কেটে দিয়ে ‘বাঁধ ভাঙছে কেন প্রশাসন জবাব দাও’ গোছের আওয়াজ না তুলতে পারে। পার্টির কাজ পার্টি করছে বলেই নিশ্চিত খুনের মুখে দাঁড়ানো তৃণমূলী আক্রমণের সামনে পড়েও পাঁশকুড়ার পার্টিনেতা মৃত্যুর আগেও বলতে পারেন, ‘না পার্টি ছাড়বো না’।

কষ্ট হচ্ছে আমাদের নানা কারণে। খেজুরিকে আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে দেখে কষ্ট হচ্ছে আমাদের। মার্কস এঙ্গেলসের ছবি ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে কষ্ট হচ্ছে আমাদের। কিন্তু ওই ছবি একদিন আমরা তোলাবই। তোলাবই।

পার্টিই সেই কাজ করবে। করবে, কারণ শুধু কষ্টই নেই আমাদের। তার সঙ্গে আছে শপথও। রানীবাঁধের মেজাজ,, সিজুয়ার প্রতিরোধ, গোঘাটের মিছিল, খানাকুলের পাহারা, কলকাতার জনজোয়ার সেই প্রত্যয় দেয় আমাদের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.