সরকারের ঋণের বোঝা কমবে?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য পিপিপি চালু করার যুক্তি হিসাবে যে কথাটি সবচেয়ে বেশী বলা হয় তা হলো: বিনিয়োগের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তা সরকারের নেই আর ঋণ করে তা জোগাড় করতে গেলে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। ফলে পিপিপির মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ-ঋণের ঝামেলা থেকে সরকার বেচে যেতে পারে (আমাদের বাজেটেও ঠিক এই যুক্তিটিই দেয়া হয়েছে)। এই কথা শুনে মনে হতে পারে গভীর সমুদ্র বন্দর বা পাতাল রেল ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন তা যেন বেসরকারী খাত পকেটে নিয়ে বসে আছে, সরকার বললেই পকেট থেকে টাকা বেরকরে কাজে ঝাপিয়ে পড়বে। এর মধ্যে মস্তবড় একটা ফাকি আছে কেননা বাস্তবে সরকারী খাতের মতো বেসরকারী খাতও এই হাজার কোটি টাকা দেশী-বিদেশী ঋণের মাধ্যমে কিংবা জয়েন্ট ভেঞ্চার করে শেয়ার বাজারে বন্ড ছাড়ার মাধ্যমেই করে থাকে। আর বিষয়টা এরকম নয় যে এই ঋণের দায়ভার সরকারের উপর বর্তায়না।
হ্যা যদি সরকার আর জনগণকে আপনি আলাদা দুটি সত্ত্বা হিসেবে ধরেন তাহলে সে ঋণের খরচ (সেই সাথে বেসরকারী কোম্পানির মুনাফার জোগান) বাড়তি ভাড়া, টোল কিংবা ট্যাক্স-ভ্যাটের মাধ্যমে জনগণ কড়ায় গন্ডায় পরিশোধ করলেও বলতে পারবেন যাক সরকারকে তো কিছু দিতে হলো না! সরকার ঋণ করে সেই ঋণের টাকা পাবলিকের কাছ থেকে ট্যাক্সের মাধ্যমে নিয়ে কিস্তিতে পরিশোধ করা যদি রিয়েল বা বাস্তব হয় তবে বেসরকারী কম্পানীকে দেয়া সরকারের ভর্তকীর টাকার পাশাপাশি সরাসরি জনগণের কাছ থেকে ভাড়া বা টোলের মাধ্যমে বেসরকারী কোম্পানী তার ঋণের কিস্তি আর লাভের অর্থ তুলে নেয়া আরও বেশী বাস্তব কেননা দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোম্পানীর মুনাফার জন্য জনগণকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে!
পিপিপি'র ফলে নির্মান খরচ কমবে?
পিপিপি'র পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো যেহেতু বেসরকারী খাতে দুনীতি নাই(!) এবং বেসরকারী খাত অধিক দক্ষ সেহেতু পিপিপি পদ্ধতি কোন অবকাঠামো নির্মান কাজের খরচ সরকারী পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম হয়। বেসরকারীখাতের দক্ষতা এবং দুর্নীতিহীনতার দাবীটি যদি সত্যি বলে ধরেও নেই তাহলেও দেখা যায় নিম্নোক্ত কারণে বাস্তবে পিপিপি পদ্ধতিতে নির্মাণ খরচ বেশী:
এক. বেসরকারী খাতে ঋণের খরচ বেশী। যেহেতু বেসরকারী খাতের ডিফল্টার হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে তাই বেসরকারী খাতকে ঋণদেয়ার সময় ঋণদাতা ব্যাংক বা সংস্থা একটা বাড়তি ঝুকি চার্জ আরোপ করে ফলে সরকারী খাতের তুলনায় বেসরকারী খাতের ঋণের খরচ এমনকি ৩০% থেকে ৫০% বেশী হয়।
দুই. কয়েকটি পক্ষ একত্রিত হয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা, যাচাই বাছাই, বেসরকারী খাতের উপর আবার সরকারের বাড়তি তদারকী ইত্যাদির কারণে নির্মাণ এবং পরিচালনা খরচ বেড়ে যায়।
তিন. পিপিপির খরচ বাড়লে যেহেতু সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি এবং অবকাঠামো ব্যাবহার কারী জনগণের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা যায়, সেকারণে পিপিপির খরচ বাড়তি দেখানোরও প্রবণতা থাকে।
চার. পিপিপির খরচ হিসাব করার সময় ভ্যালু ফর মানি পদ্ধতিতে কথিত ঝুকি বহনের একটা ফি বেসরকারী কোম্পনী আগাম ধার্য করে নেয়। তার ফলেও সরকার তথা জনগণের সার্বিক ব্যায় বেড়ে যায়।
পিপিপি'র ভ্যালু ফর মানি এনালাইসিস
পিপিপি পদ্ধতিতে কোন একটি প্রজেক্ট সরকারের জন্য লাভজনক কিনা তা হিসেব করা হয় ভ্যালু ফর মানি বা টাকার বিনিময়ে মূল্য পদ্ধতি তে। এ পদ্ধতিতে দেখা হয় উক্ত প্রকল্পটি যদি সরকারের ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ব্যায়কৃত টাকা থেকে সরকার কি পরিমাণ ভ্যালু বা মূল্য(সার্ভিস) পাবে আর যদি পিপিপি তে করা হয় তাহলে কত ভ্যালু পাবে। এ পদ্ধতিতে দেখা হয় মোট ব্যয়কৃত টাকার ডিসকাউনন্ট রেট মোট ভ্যালু অব পেমেন্ট এর উপর কি প্রভাব ফেলছে এবং কথিত রিস্ক ট্রান্সফার বা ঝুকি স্থানান্তরের ভ্যালু কত।
ডিসকাউন্ট রেট এর প্রভাব:
এ পদ্ধতির সরমর্ম হলো আজকে ১০০ টাকার নোটের যে মূল্য আজ থেকে ১০ বছর পর মুদ্রাস্ফীতি, সূদের হার ও বাজার অর্থনীতির অন্যান্য ফ্যাক্টরের কারণে তার মূল্য অনেক কম হবে। মুদ্রাস্ফীতি সহ অন্যান্য সব ফ্যক্টরকে হিসেবে নিয়ে এই ডিসকাউন্ট বা মূল্য কম হওয়ার একটা হিসেব করা হয়। ডিসকাউন্ট রেট যত বেশী হবে ভবিষ্যত খরচের বর্তমান মূল্য তত কম হবে। যেমন: ডিসকাউন্ট রেট যদি ৪.৭ % হয় তবে ১০ বছর ধরে ১০০০ টাকা খরচের বর্তমান মূল্য (নেট প্রেসেন্ট ভ্যালু) হবে ৬৩২ টাকা আর যদি ৫.৭% হয় তবে নেট প্রেসেন্ট ভ্যালু হবে ৫৭৪ টাকা অর্থাত সরকার ১০ বছর ধরে মোট ১০০০ টাকা খরচ করলেও বর্তমানের হিসেবে সরকার আসলে খরচ করছে যথাক্রমে ৬৩২ টাকা এবং ৫৭৪ টাকা। পিপিপির ক্ষেত্রে এই ডিসকাউন্ট রেট এর হিসেব কষে সরকারকে বোঝানো হয় দীর্ঘমেয়াদে সরকারকে আপাত অর্থে বেশী খরচ করতে হচ্ছে বলে মনে হলেও বাস্তবে সে খরচের বর্তমান মূল্য তত বেশী নয় ফলে আখেরে সরকারেরই লাভ।
এখন এ পদ্ধতির দুইটা ঘাপলা আছে। এক. এ পদ্ধতিতে ধরেই নেয়া হচ্ছে যে সরকার তার ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে কোন কিছু নির্মান করলে তাকে পুরোখরচের টাকাটা একবারেই দিয়ে দিতে হবে যা বাস্তবে সঠিক নয়। বরং সরকার বেসরকারী কোম্পানীর চেয়ে আরো দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে থাকে। ফলে ভ্যালু ফর মানি পদ্ধতিতে ডিসকাউন্ট রেট এর যে সুবিধা দেখানো হয় তা পিপিপির কোন বিশেষ সুবিধা নয়, সরকার ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতেই এ সুবিধা ভোগ করতে পারে। দুই. ডিসকাউন্ট রেট বাড়িয়ে দেখানো।
দেখা যায় একই দেশের বিভিন্ন প্রজেক্টে বিভিন্ন ধরনের ডিসকাউন্ট রেট ধরে হিসাব করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে এ ধরনের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কথিত ঝুকি স্থানান্তরের মুল্য:
যেকোন নির্মাণ কাজ বা বিনিয়োগের কিছু ঝুকি থাকে যেমন: নির্মাণ সামগ্রীর মুল্য বেড়ে যাওয়া, নির্মাণ স্থানের ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তন, কাচামাল দুস্প্রাপ্য হয়ে যাওয়া, নির্মিত সেবার বিকল্প উদ্ভাবিত হওয়ার ফলে চাহিদা কমে যাওয়া, শ্রমের মূল বেড়ে যাওয়া, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি। বলা হয়, পুরোসরকারী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই সব ঝুকিই সরকারকেই বহন করতে হয় কিন্তু পিপিপিতে যেহেতু বেসরকারী নির্মাতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি খরচের বিনিময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে চুক্তি বদ্ধ ফলে এসমস্ত সরকারী ঝুকি কিছু বেশী পয়সা খরচ করতে হলেও পিপিপির মাধ্যমে বেসরকারী খাতের ঘাড়ে দিয়ে দেয়া যায়।
এখানেও দুটি বড় ঘাপলা আছে:
এক. দুর্ঘটনা ঘটলে বা নির্মান সামগ্রীর মূল্য বেড়ে গেলে যে বাড়তি খরচ সরকারের হতো সেটা তো সরকারকে ঠিকই বহন করতে হচ্ছে কেননা বেসরকারী খাতকে সেই ঝুকি বহনের বিনিময়ে বেশী টাকা দিতে হচ্ছে; উপরন্তু ঘটনা ঘটার আগেই এমনকি ঘটনা না ঘটলেও সরকার তথা জনগণকে ঐ সব কথিত ঝুকির খরচ বহন করতে হচ্ছে।
ফলে বাস্তবে এটা ঝুকি স্থানান্তর না হয়ে হচ্ছে অনিশ্চিত ঝুকির নিশ্চিত ব্যয়ভার বহন।
দুই. ঐসব কথিব ঝুকির খরচের হিসেব নিকেশ বড়ই বায়বায়ী। আপনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন নির্মান সামগ্রী-কাচামাল-শ্রমের মূল্য বাড়লে ঠিক কত বাড়বে কিংবা প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা হবে কি হবে না আর হলে সেটার কস্ট কত হবে? আজ পর্যন্ত এর কোন ষ্টান্ডার্ড পদ্ধতি দাড় করানো যায়নি। ফলে এই কথিত ঝুকি স্থানান্তর আসলে সরকারী গাভী দুইয়ে নেয়ার আরেকটি সুযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ বিষয়ে ২০০২ সালের ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল লিখেছে: ঝুকি সনাক্তকরণ এবং পরিমাপের কোন স্টান্ডার্ড পদ্ধতি নেই আর ব্রিটিশ সরকারও এরকম কোনটি জনসমুক্ষে প্রকাশ করতে পারেনি.... সরকারী বেসরকারী অংশীদ্বারিত্বের মাধ্যমে যেসব হাসপাতাল নির্মান করা হয়েছে তার দুই তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রেই কোন ঝুকির বাস্তবতা পাওয়া যায় নি।
আবার বাস্তবে যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন বেসরকারী কম্পানিটি স্রেফ দেউলিয়া ঘোষনা করে কিংবা প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে কেটে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে তখন সরকারকেই তার দায়ভার গ্রহন করতে হয়। আমরা উপরে ব্রিটেনের জার্ভিস প্রা.লি.কোম্পানরি ক্ষেত্রে দেখছি কেমন করে রেলওয়ে খাতে লোকসানের মুখে পড়ে তার স্কুলের প্রজেক্টের দায়ভার সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। পিপিপির ক্ষেত্রে এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সরকারকেই সমস্ত ঝুকি বহন করতে হয়েছে যেমন অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব এবং মডব্যারি হাসপাতালের নির্মাণ কাজের কথা বলা যায় কিংবা ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে হেমিলটন/ওয়েন্টওয়ার্থ এ ফিলিপ ইউটিলিটি ম্যানেজম্যান্ট কর্পরেশন সাথে সরকারের যে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের চুক্তি হয় সেখানে নির্মাণ শেষে কোম্পানীটি বিভিন্ন সময়ের সুয়ারেজ লাইনের ফাটল এবং ময়লা বেড়িয়ে পড়ার কোন দ্বায়িত্ব না নেয়ার ফলে সরকারী খরচে তা সম্পন্ন হওয়ার কথাও বলা যায়।
(সূত্র: পিপিপি এবং ভ্যালু ফর মানি অ্যানালাইসিস বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে জুন ২০০৬ এ কানাডিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভ প্রকাশিত VALUE FOR MONEY? By Stuart Murray এর গবেষণা পত্রটিতে। Click This Link
এই আলোচনার সূত্রও এই গবেষণাপত্রটি )
কাজের গতি বৃদ্ধি প্রসংগে
পিপিপির পক্ষের আরেকটি যুক্তি হলো এর মাধ্যমে যে কোন নির্মান কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যমে সম্পন্ন হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রকল্প উত্থাপন, যাচাই-বাছাই, অর্থসংস্থান, সরকার ও বেসরকারী বিনিয়োগকারীর মধ্যকার আইনি চুক্তি ইত্যাদি কাজে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যকার দরকষাকষি করতে গিয়ে পিপিপির কাজে বরং সরকারী কাজের তুলনায় দেরী হয়ে যায়। বেসরকারী বিনিয়োগকারী অনেক সময়ই নির্মান কাজ শুরু হওয়ার আগের সময়টুকুকে হিসেবের বাইরে ধরে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হওয়ার দাবী করে জরিমাণা এড়িয়ে যায়। আবার প্রকল্প ঠিক ঠিক সময়মত সম্পন্ন করার জন্যও তাদেরকে বাড়তি চার্জ প্রদান করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এসোসিয়েশন অব চার্টার্ড সার্টিফায়েড একাউন্টেন্টস কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে সরকারী স্বাস্থ্য খাতকে পিপিপির মাধ্যম স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সঠিক সময়ে সম্পন্ন করার খেসারত হিসেবে নির্মাণকারীকে ৩০% বাড়তি চার্জ প্রদান করতে হচ্ছে। এভাবে ৩০ শতাংশ বাড়তি চার্জ প্রদান করে নির্ধারিত সময়ে এবং নির্ধারিত বাজেটের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার উপকারীতা বুঝতে আমরা অপারগ।
বেসরকারী মুনাফা,জনগণের খেসারত:
পিপিপির প্রকল্পের নির্মাণ পর্যায়ে নির্মাতাকে একবার মুনাফা দিতে হয় এবং নির্মান শেষে পরিচালনা পর্যায়ে আরেকবার মুনাফা দিতে হয়। সাধারণ ভাবে সরকারী যে কোন নির্মান কাজে কন্ট্রাক্টর কম্পানিকে নির্মাণ কাজের জন্য একটা মুনাফা দিতেই হয়। কিন্তু এই যে পরিচালনা পর্যায়ে বেসরকারী কোম্পানীকে মুনাফাটি দেয়া হচ্ছে তা একেবারেই বাড়তি। ফলে সরকারী মালিকানায় থাকা রেলওয়েতে যে ভাড়া ধরা হয়, পিপিপির মাধ্যমে সরকার ভর্তূকী দেয়ার পরও ভাড়ার হার তার চেয়ে বেশীই হবে। বিদ্যুত উতপাদনের বেলায় পিপিপির আওতায় গ্রাহকেরা যে দামে বিদ্যুত কিনতে পারবে, সরকার তার চেয়ে বেশি দামে বিদ্যুত কিনে জনগনের কাছে সরবরাহ করবে।
এ দুইয়ের মধ্যে যে দামের পার্থক্য তা পিপিপি বাজেট থেকে যাবে। বর্তমানে পিপিপি বাজেট না থাকলেও বেশকিছু আইপিপি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্লান্ট থেকে সরকার এভাবেই বেশী দামে বিদ্যুত কিনে ভর্তুকী দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। ফলে পিপিপির মাধ্যমে রেলপথ, সেতু, বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতাল যা কিছুই নির্মিত হোক না কেন তা বিদ্যমান সরকারী খাতের আওতায় থাকা সেবার তুলনায় বেশী মূল্যদিয়ে কিনতে হবে। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ভাবেই জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হবে- প্রত্যক্ষ ভাবে তাকে বেশী ভাড়া বা টোল প্রদান করতে হবে আর পরোক্ষভাবে বেসরকারীখাতকে দেয়া সরকারী ভর্তুকীর টাকাটাও তো তাকে ট্যাক্স বা ভ্যাটের মাধ্যমে দিতে হবে।
পিপিপি ও সেবাখাত বেসরকারীকরণ:
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপর জনগনের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিতসা ইত্যাদি নিশ্চিত করার যে দ্বায়িত্ব বর্তায় তার ব্যতয় করে ঐ সকল খাতকে দেশী-বিদেশী লগ্নীপুজির মালিকদের বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করার লক্ষে নয়াউদারনৈতিক অর্থ ব্যাবস্থায় বেসরকারীকরণের যে মডেল বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে দেশে দেশে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারীকরণকে প্রাইভেট-পাবলিক অংশীদ্বারিত্বের মোড়কে আবারও হাজির করা হচ্ছে।
প্রথমে অবকাঠামো খাতে সরকারীভাবে বিপুল পুজি বিনিয়োগের অসম্ভবতার কথা বলে বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট নির্মাণ কাজ করা হলেও চূড়ান্ত ভাবে এর লক্ষ হলো শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি যেসব খাত এখনও পুজিলগ্নীকারীর খপ্পরের বাইরে রয়েছে সেগুলোকে তার আওতায় আনা। দক্ষিন কোরিয়ায় প্রথমে পরিবহন খাতকে নিয়ে পিপিপি শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয়ম হাসপাতাল ও গৃহায়ন প্রকল্প এর আওতায় এসেছে। ইতালিতে অবকাঠামো খাত থেকে আস্তে আস্তে স্বাস্থ্য ও পানি সেবা পিপিতে এসেছে। ভারতেও একই ঘটনা ঘটছে। রেলওয়ে, বিমান বন্দর ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পর পিপিপি এবার শিক্ষা খাতেও ঢুকে পড়েছে।
প্রথমে ঢুকেছে একাডেমিক নয় এরকম কাজ প্রাইভেট সেক্টরকে দিয়ে দেয়ার মধ্যে দিয়ে। যেমন সরকারী হল-হোস্টেল ব্যবস্থাপনা, ক্লারিক্যাল কাজকর্ম, সিকিউরিটি এবং স্যানিটারী সার্ভিস এমনকি দুপুরের খাবার সর্বরাহের কাজও বেসরকারী খাতকে দিয়ে করানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম ঘটবে এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য আবাসন ইত্যাদি খাতে বেসরকারী পুজির জয়জয়কার চলছে। পিপিপি'র মাধ্যমে এসবকে আরও ত্বরান্বিত করা হবে।
এবারের বাজেটের সাথে যে পিপিপি'র অবস্থান পত্র ঘোষণা করা হয়েছে তাতেও বিষয়টি স্পষ্ট। পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন যোগ্য প্রকল্পগুলোকে যে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে তার দুটো ভাগ "জনগুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য প্রকল্প" এবং "স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রকল্প" এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে দ্রুত বাস পরিবহন, আরামদায়ক বাস সার্ভিস এবং বিভিন্ন রুটে ফ্রাঞ্চাইজ চালু। আর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু জেলার পুরো স্বাস্থ্য সেবা পিপিপির আওতায় নিয়ে আসা, হাসপাতাল নির্মাণ, মানসম্মত মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, অডিটরিয়াম ও ব্যায়ামাগার নির্মাণ, বিদ্যমান স্নাতক কলেজের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ইত্যাদি। এছাড়াও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও পয়োনিস্কাশন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিমান চলাচল ব্যবস্থা, পর্যটন ও আবাসন শিল্পে পিপিপির কথা বলা হয়েছে।
বেসরকারী করণের আর বাকি থাকল কি!
কাজেই যতই কথার ফুলঝরি ছোটানো হউক, যতই সরকারী-বেসরকারী অংশীদ্বারিত্বের কথা বলা হউক এটা স্পষ্ট যে বুর্জোয়া সরকারগুলো আসলে রাষ্ট্রীয় সেবাখাতের বেসরকারীকরণই করছে এবং বিভিন্ন ভাবে এ বেসরকারী করণ করতেই থাকবে- যতক্ষণ পর্যন্ত কার্জকর প্রতিরোধ গড়ে পুরো সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই পাল্টে ফেলা না হবে।
(সমাপ্ত)
পিপিপি নিয়ে আগের কিস্তি দিয়েছিলাম গতকাল। আগের কিস্তির জন্য এখানে দেখুন:
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।