কতো কী করার আছে বাকি..................
এদের কেউ নির্মাণ শ্রমিক, রিক্সা চালায়, সব্জি বিক্রেতা। সবাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের উন্মুল মানুষ। এখানে শহর সংলগ্ন তাদের জীবন নিরাশ্রয়ীর অনুভূতিমাখা। তুবও সকাল আসে-শেষ জৈষ্ঠ্যের আকাশে চাঁদ এবং দূর দিগন্তের বিজলী চমকানো রাতে তারা ফিরিয়ে আনে নিজের ভূমিজল আর সুরকে। বাতাসে ভেসে চলা তাদের কন্ঠের কুহুতানের আবেশ শহরের ওপর অস্পৃশ্য মায়াময় জোছনার ইন্দ্রজাল তৈরি কর।
হারমোনিয়াম, ছাগ চর্মে তৈরি ডুবি করতাল আর নিমীলিত কন্ঠে বান ডেকে যাওয়া সুর গেয়ে ওঠে-
রাসেদের আর কিছুই নাই মাটির নীচে দেশের বাড়ি
প্রাণবন্ধু হইলো দেশান্তরি..........
শহুরে মনোজগতে এর পাঠোদ্ধারে বিকৃতির আশংকা-তো থাকেই। কিন্তু মাটির নীচে দেশের বাড়ির ব্যঞ্জনা স্পর্শ করে সবাইকে। রাসেদের প্রেম তবে এতোই তীব্র, এ-কি নিছক মনোদৈহিক প্রেম, না-কি এই প্রেমে অধ্যাত্মিকতার শক্তিটাই মুখ্য। তাদের প্রায় সবগুলো গানেই প্রেম আছে-মুর্শিদী গানই মূলত গায়। মাঝে মাঝে জিকির করে-আল্লাকে পাওয়ার আশায়।
কখনো কখনো খিচুড়ি আর মাংস রান্না করে একে তাকে দাওয়াত দিয়ে রাতভর গানের আয়োজন চলে। কিন্তু না পাওয়ার বেদনাই যে শেষ বিচারে প্রেম হয়ে ওঠে-এই বোধ প্রাচ্যের বোধ। প্রাচ্যের প্রেমে গভীরতা থাকে-আধ্যাত্মিকতা থাকে। এখনকার শহুরে প্রেম মাত্রেই যেমন নারী পুরুষকে বোঝায়, তাদের গানের প্রেম অমন নয়। তারা আরাধনার প্রেম করে।
বেশ কয়েকটি গানে রাধার নাম আছে। আছে ভবনদী পার না হতে পারার যন্ত্রণা।
ভব নদীর পারে
কান্দির সব হারাইয়া
কেমন যাবো ভবনদী বাইয়া
এই গানে ভব নদী পার হতে না পারার ব্যকুলতা আছে, মুর্শিদের কাছে প্রার্থণায় নত এই গান। জাগতিক মায়ায় সে ভুলে ছিল, ভব নদীর পারে এসে দেখে এই নদী পার হওয়ার কোন কিছুই তার নেই-তাই সে কূলে বসে কান্দে কি করে পার হবে এই নদী। শহর মানুষকে এসব ভাবতে দেয় না-কেবল নাভিশ্বাস ছোটাছুটি আর পণ্যময়তা-প্রতিষ্ঠান মুখীনতা।
তাদের জন্যে হয়তো কোন ভব নদী নেই। কিন্তু এই গ্রামহারা মানুষগুলো তাদের ভব নদীকে ভুলতে পারেনি আজো। এই মানুষগুলো শিল্পবোধে, শৈল্পিক অভিব্যক্তিতেও অনন্য হয়ে ওঠে। তাদের কালো কালো শরীরে, মুখের মানচিত্রে তৈরি হওয়া খানাখন্দে- বন্ধ চোখের পাতায় গান গাওয়ার নিমগ্নতা এক অপরিচিত আমেজ তৈরি করে। তারা শহুরে পোশাক আর দেহ সর্বস্ব উলম্ফনের শিকার নয়-গান, এই গানই হয়তো তাদের এখনো গেঁয়ো করে রেখেছে।
সবাই গায়-সবাই বাজায়। আর যখন গায়-চোখ বন্ধ- আশপাশের শব্দকথা কিছুই তার মগ্নতাকে ভাঙতে পারে না। ভুলিয়ে দিতে পারেনি চান বাউলের গানটিও-
আমার যেদিন বিয়া হবে
যাইবো নিজের বাড়ি
বাজার থাইকা কিইন্যা আইন্নো
শাদা রঙের শাড়ি।
আমার বিয়ার বর যাত্রী
চারইজনা দাড়ি
আমারে একেলা থুইয়া
তারা দিবো পারি।
এই গানটির দৃশ্যকল্প শিহরণ জাগানিয়া।
শেষ যাত্রার বর্ণনা এতোটা অনিবার্য আর শৈল্পিক হতে পারে-এতোটা জীবন ঘনিষ্ট হতে পারে। আসলেই-মানসিকভাবে পণ্য বিবর্জিত মানুষের রুচি-আচার-জীবনবোধ-সুর সমস্ত কিছুরই স্বাদ আলাদা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।