শৈশবের স্মৃতিঘেরা কলেজটিকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। কলেজের অভ্যন্তরীণ সড়কের দু পাশের সেই ছোট ছোট গাছগুলো বেড়ে অনেক বড় হয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তার পিচঢালাই ওঠে খানাখন্দকের সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞান ভবনের জানালর গ্রিলগুলোতে মরিচা ধরেছে, কাচগুলো ভেঙে পড়েছে। পুরো ক্যাম্পাসটা কেমন অচেনা মনে হচ্ছে রকিবের।
অচেনা লাগারই কথা, প্রায় এক যুগ পর এই কলেজে আসা। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকায় চলে যাওযার পর এখানে আর আসা হয়নি তার। এক যুগ কম সময় তো নয়। অবশ্য গ্রামেও খুব একটা আসা হয়নি তার। ঈদ ও পারিবারিক বড় কোন উৎসবে আসা হতো, তাও সর্বোচ্চ দুইদিনের ছুটি নিয়ে।
সাংবাদিকতা পৃথিবীর এক অদ্ভূত পেশা, মানুষের ক্লান্তিহীন নেশা। টুয়েন্টি ফোর আওয়ারের জব, সবসময় কান খাড়া রাখতে হয় কোন দিকে কী হচ্ছে? সাংবাদিকতা পেশায় মোবাইল ফোনের জ্বালা বেড়েছে, রাত-বিরাতে অফিস থেকে ফোন করে বস বলেন, অমুক জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে খবর নাও, ওই জায়গায় নাকি আগুন ধরেছে খবর নাও, ইত্যাদি। অফিস থেকে ছুটি মেলানো দুরূহ ব্যাপার। নিজের ও রেহানার অফিস আর বাচ্চার স্কুল-তিন মিলিয়ে একসাথে ছুটির শিডিউল মেলানো কঠিন। অফিস থেকে ছুটি মিললে বাচ্চার স্কুল থাকে. স্কুল ছুটি থাকলে রেহানার অফিসে জরুরি অবস্থা।
তাই গ্রামে যাবো যাবো করেও যাওয়া হয় না। রুটিনমাফিক জীবনটাই বড় যান্ত্রিক মনে হয় রকিবের। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রুনাকে স্কুলে দিয়ে আসা, এরই মধ্যে সকালের নাস্তা তৈরি করে ফেলে রেহানা। তারপর দ্রুত নাস্তা খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া। দুপুরে রেহানারাই স্কুলে গিয়ে রুনাকে নিয়ে আসে।
এভাবে চলতে থাকে, একসাথে ছুটির শিডিউল মিলে না। রকিব কলা ভবনের সামনে যেখানে প্রায়ই মিছিল শেষে সমাবেশে বক্তব্য দিত সেখানে এসে দাঁড়ায়। ইট দিয়ে পাকা করা সামান্য উঁচু ছোট মঞ্চটি এখনো আছে, তবে পলেস্তারা খসে পড়েছে। এখনো হয়ত ছাত্রনেতারা এখানে সমাবেশ করে বক্তৃতা দেয়। মঞ্চটির বাম পাশে দাঁড়াত মেয়েরা, ডান পাশে ছেলেরা।
রকিব ছিল রসালো বক্তা, সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুর সাথে রম্যগল্প মিলিয়ে সহযোদ্ধাদের বেশ হাসাতে পারত। এই জায়গাটি তার কাছে বেশ স্মৃতিময়। অনেকদিন পর এই মঞ্চটি দেখে আবারো বক্তৃতা দিতে ইচ্ছে হচ্ছে রকিবের। সাথে থাকা পুরনো বন্ধু রেজাকে বলল, চল ওই মঞ্চে একটু বসি। ইটের তৈরি ছোট মঞ্চটিতে বসে আছে রকিব ও রেজা।
তারা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। রকিব বলে, ‘পরিবহন শ্রমিকদের সাথে সংঘর্ষের কথা তোর মনে আছে রেজা?’ রেজা বলে. ‘আছে মানে? আমরা সেদিন কী মারই না দিলাম। কলেজের শিক্ষকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে হেলফার আর কি-না বলে গাড়ি ভাঙচুরের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে, কী আশ্চর্য! মারের পর সমাধান। ’ দশ মিনিট বসে তারা উঠতে যাবে এমন সময় কোত্থেকে হঠাৎ করে রুমানা এসে দাঁড়ায়। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে মেয়েটির দিকে কলেজের অধিকাংশ ছেলের নজর ছিল, প্রেমে হাবুডুবু খেতো নীরবে।
কেউ বলতে সাহস পেত না। কিন্তু রকিব বলেছিল। কলেজের রাজনীতিতে জড়িত ছিল বলে মেয়েরা তাকে সমীহ করতো। একই ক্লাসে পড়তো রুমানা, পাশাপাশি বেঞ্চে বসতো। প্রাইভেট টিউটরের কাছেও একই ব্যাচে পড়তো তারা।
এর মধ্যে দুই বছরে নানাভাবে রকিব তার ভালোবাসা ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু রুমানা প্রতিবারই তা এড়িয়ে গেছে। বলেছে, ‘এসব প্রেম-ট্রেমে আমি নেই, ওসব ভুলে যাও। ’ এক কথায় প্রত্যাখ্যান। এর পেছনে কী কারণ ছিল তা কখনোই বুঝেনি সে।
রকিবের ছিল প্রথম ভালোলাগা, প্রথম প্রেমেই ব্যর্থতা তাকে পেয়ে বসেছিল। প্রচণ্ড ধাক্কা খেল প্রথম জীবনেই। মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল, জীবনে আর কখনোই রুমানার সামনে আসবে না। একটা চাপা অভিমান বুকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে রকিব। সেদিন আকাশের বুকে একফালি মেঘ দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল সাগরের পানে।
অনার্সে ভর্তি হয়ে টিএসসিতে তরুণ-তরুণীর ঘনিষ্ঠতা দেখলে রুমানার কথা মনে পড়ে যেত, খুব কষ্ট হতো তার। ধীরে ধীরে নগরজীবনের ব্যস্ততা পেয়ে বসে তাকে, ঢাকা শহরের নানা ফ্যাশনের হাজারো তরুণীর ভিড়ে ছবির মতো মায়াবী চেহারাটি অদৃশ্য হতে থাকে। পড়ালেখা শেষে সাংবাদিকতার চাকরি, বিয়ে সংসার, রুনার জন্ম-কত পরিবর্তন ঘটে গেছে বারো বছরে। টিয়ে কালার সালোয়ারের ওপর গোলাপি কামিজ পড়ে যে মেয়েটি পুরো ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখত তার গায়ে একটা গোলাপি শাড়ি, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়স বেড়েছে, সালোয়ার-কামিজের তারুণ্য আর নেই, সে কারণে শাড়ি উঠেছে গায়ে কিন্তু রুচিটা যেন আগের মতোই রয়ে গেছে, একারণে শাড়ির কালারও গোলাপি।
মুখে কৃত্রিম হাসি ফোটানোর চেষ্টাটা বুঝাই যাচ্ছে, কপালে কেমন একটা দুশ্চিন্তার ছাপ, বিধ্বস্ত চেহারা। কে জানে কলেজের চিরচেনা ক্যাম্পাসটির মতো রুমানার জীবনেও কোন পরিবর্তন ঘটেছে কী-না। বিজ্ঞান ভবনের গ্রিলের মতো তার জীবনেও মরিচা ধরেছে কি-না। রকিবকে মা বলতো, অতি সুন্দরীর কপালে দুঃখ থাকে। ’ জাতীয় কী একটা আঞ্চলিক প্রবাদও বলত মা।
এখন এটা অশ্লীল মনে হয় তার কাছে। তারপরও ওই প্রবাদটি নাকি চিরন্তন সত্য, মাকে নানি কিছু উদাহরণও দিয়েছিল। রুমানাকে দেখে রকিব মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে বলল, ‘এ জীবনে আরো একবার তোমকে দেখতে হবে জানলে গ্রামেই আসতাম না। ’ রুমানা সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘কেন কেন? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি? কতদিন পর তোমাকে দেখছি, কেমন আছি জিজ্ঞ্যেস করবে তা-না, উল্টো বলছ, না? জীবনে আর কখনোই যে মেয়েটির সামনে পড়বে না, কথা বলবে না-এমন প্রতিজ্ঞা করেছিল রকিব, সেই রুমানার বিধ্বস্ত ভঙ্গির কোমল একটি উক্তিতেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল তার। যেন এ কথা উত্তর না দেয়া যায় না, স্মৃতিতে ভেসে উঠল কলেজ জীবনের সেই দিনগুলো।
নারীরা সহজেই পুরুষের মানসপটে স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। এ কারণেই তাদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়। রকিব বলল, তুমি কলেজে কেন এসেছো? রুমানা বলল, কলেজে আসাটা এখন পেশা আর জীবিকা। রকিব উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘দ্যাট মিনস তুমি কলেজ টিচার, অধ্যাপিকা রুমানা? খুব সুখী মানুষ তো। ’ রকিবের শেষের উক্তিটি অর্থাৎ ‘খুব সুখী মানুষ’ কথাটি রুমানাকে সুখ সম্পর্কে আবেগপ্রবণ করে তুলল।
সুখের প্রকৃত সংজ্ঞা তার কাছে জানা নেই, কলেজ জীবনে যখন রকিবদের মতো ছেলেরা তার প্রেমে মত্ত হয়ে ঘুরত তখন নিজেকে বেশ সুখীই মনে হতো। ডিভোর্স হওয়ার আগে দুই বছরের বিবাহিত জীবনটাকে সুখী বলা যাবে না, সুখী হলে বিবাহ বিচ্ছেদ হলো কেন? হঠাৎ সুখ শব্দটি তাকে ভাবিয়ে তুলল। খুব আবেগী হয়ে বলল, ‘কলেজ টিচার হলেই সুখী মানুষ হয়ে যায় নাকি? তা হলে তো সব কলেজ টিচারই বেশ সুখী, তুমি এ ধারনা কোথায় পেলে?’ রকিব হেসে উঠে। বলল, সুখী তো বটেই। কলেজের চাকরি পেয়েছ, পরনে শাড়ি উঠেছে তার মানে সংসারীও হয়েছো।
রুমানা প্রসঙ্গ বদলায়, ‘তোমার কী খবর বলো। চাকরি-বাকরি, ঘরসংসারের কী অবস্থা?’ ব্যক্তিগত বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করেও পারল না রকিব। কতদিন পর রুমানার সাথে দেখা। একটা সময় মানুষ নিজের অজান্তেই আবেগী হয়ে পড়ে, স্মৃতি মানুষকে পেছনে নিয়ে যায়, ভাবিয়ে তুলে বার বার। তাছাড়া রুমানার প্রতি তার অন্যরকম দুর্বলতা ছিল, রেহানার সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর তার সথে দেখা।
সমস্ত সিদ্ধান্ত হঠাৎই যেন বদলে গেল। রকিব বলল. ‘ঘরসংসার আর কি! সব শেষ। যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে বিয়ে করতে পারিনি। হঠাৎ একটা অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনলে তার সাথে ভুল বোঝাবুঝি তো হবেই। দু জন মানুষ একসাথে সংসার করতে গেলে অনেক নমনীয়তা দরকার, চেনাজানা হলে বুঝাপড়া হয়।
সংসার ভেঙে গেছে, রুনাও মায়ের সাথে রয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে মাইন্ড রিফ্রেশের দরকার। সংসার নেই, তাই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আসলাম। ’ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রকিব বলে যাচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি। ‘যাকে ভালোবেসেছিলাম’ কথাটির অর্থ রুমানা ঠিকই বুঝেছে।
আকাশটা হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেছে, একফালি মেঘ উড়ে যাচ্ছে সাগরের পানে। হয়তো এখনই এক পশলা বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার ঠিক পূর্বমুহূর্তের দৃশ্যটি অপরূপ। মেঘ-রোদের মিলিত রশ্মিতে রুমানার পরনের গোলাপি শাড়িটি চকচক করছে। রকিবের কথা শেষ হয়ে গেছে, আর কিছু হয়তো বলার নেই।
রুমানা ভাবছে মানুষের সংসার কেন ভেঙে যায়, সম্পর্কের সূত্রগুলো এমন জটিল কেন। পৃথিবীটা কি ভাঙনের খেলায় মেতে উঠেছে। ভাঙনের পর কী হয়? চর জাগে, ধূ ধূ চর, মরুর চর, কেবল শূন্যতা সেখানে। নিজের মতো রকিবের সংসারও ভেঙে গেছে হয়তো একই কারণে। মানিয়ে নেয়া বা মেনে চলা যাকে বলে।
অনেকক্ষণ দু জন নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। রকিব বললো, ‘তোমার হাজব্যান্ড কি করে, তিনিও কি কলেজ টিচার?’ রুমানাও খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। বলল, তোমার আর আমার কপাল এক, বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। যে ছেলেটি ভালোবেসেছিল সে বিয়ে করতে আসেনি, হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল!’ রকিব আর কিছুই বলতে পারলো না, আকাশের সমস্ত মেঘ যেন তার মাথায় ভেঙে পড়ল। দক্ষিণ হাওয়া রুমানার শাড়ির আঁচল আর খোলা চুলগুলো উড়ছে।
দুটি শঙ্খচিল মেঘের ভেলা ভেঙে হারিয়ে গেল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।