অনেকেই বলেন রবীন্দ্রনাথ , নজরুল , সুকান্ত , মাইকেল আমাদের জাতীয়
স্বার্থ , জাতীয় ঐক্যের কবি। কথাটি যারা বলেন , তারা তা বলেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। এ নিয়ে ভিন্নমতও আছে। কাজী নজরুলের কথাই ধরা যাক। নজরুল যখন তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি লিখলেন তখন এই উপমহাদেশের অবস্থা কেমন ছিল ? কেমন ছিল রাজনৈতিক চিত্রাবলি ? কবি একটা শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন।
একা হলেও , কবিতায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। সে সময় সেজন্য তাঁকে জেল জুলুম ও সহ্য করতে হয়েছিল । বলা হয়েছিল তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী ।
নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক কবি। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রমিলা দেবী কে বিয়ে করেছিলেন।
সে সময় ও কিন্তু ইসলাম ধর্মের নীতিনির্ধারকরা তা ভালো চোখে দেখেনি। সমালোচনায় পন্চমুখ হয়েছে।
নজরুল যখন বিদ্রোহী কবিতাটি লিখলেন তখন তিনি একদিকে হলেন
দেশপ্রেমিক। আর সেই সময়ের শাসকরা বললো , তিনি জাতীয় স্বার্থের
প্রতিপক্ষ । তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করছেন।
এই কথাটা আলোচনার
মূলভাবনা রেখে আমি এই লেখাটা এগুতে চাই।
সুকান্ত বললেন , '' অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি , জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি ''।
সেই সময়টা কেমন ছিল ? সেই সময়টাও ছিল শোষক আর শোষিতের
স্নায়ুযুদ্ধকাল। যা এখনও আছে, চলছে। সুকান্তের ঐ কবিতায় সেই সময়ের
শাষকগোষ্টী কি খুশি হয়েছিল ? না - হয় নি।
কেন হয় নি ? কারণ সুকান্ত মজলুম মানুষের কথা বলে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এর জন্য তিনিও হয়ে উঠেছিলেন তথাকথিত রাষ্ট্র স্বার্থের
প্রতিপক্ষ। তা হলে দেখা যাচ্ছে এই, - আজ আমরা যাদেরকে জাতীয় ঐক্যের কবি বলছি , তারা সে সময়ে রাষ্ট্রের চোখে ছিলেন প্রতিপক্ষ !
ইতিহাস এভাবেই বাঁকবদল করে।
এবার বলা যাক রবীন্দ্রনাথের কথা। এই সময়েও কোনো কোনো সুধী-প্রবীন লেখকরা বলছেন , বাংলাদেশে রবীন্দ্রপূজা বন্ধ হোক।
এর কারণ কি ? বাংলাদেশে রবীন্দ্র মেলা হচ্ছে। নজরুল মেলা হচ্ছে।
হয়তো ভবিষ্যতে জীবনানন্দ মেলা , শামসুর রাহমান মেলা হবে। এটা
তো আশা কথা। তাহলে ঐ পক্ষটি অখুশী হচ্ছেন কেন ?
এর কারণ আছে।
ইতিহাস বলছে, নজরুল যখন তার মানুষ কবিতা টি লিখেন তখন সেই মৌলবাদী শক্তিটি নজরুলকে না না ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করেছিল। তারা তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল।
নজরুল যখনই শ্যামা সংগীত সাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন তখনই তাঁর উপর
খড়গ নেমে এসেছে। তিনি যখন গজল , ইসলামী গান লিখেছেন তখন
সেই মৌলবাদীরা কবির গায়ে তাদের লেবাস লাগাবার চেষ্টা করেছে।
বলেছে, তিনি আমাদেরই লোক !
২
নজরুল ছিলেন সাম্যের কবি।
তা আমরা মুখে বলি ঠিকই । কিন্তু একটি
পক্ষ তাঁকে তাদের নিজস্ব মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে প্রচার করতে আজকাল খুবই ব্যস্ত। '' মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই ''---
এটা তাঁর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিনি এটাও তো বলেছেন , '' গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাহি , নহে কিছু মহীয়ান'' । তাঁর এই আদর্শ
টি কে আমরা কতোটা ধারণ করতে পারছি ? যদি পারতাম তাহলে আমাদের সামাজিক অবস্থান এতো নীচে থাকতো না।
একজন কবি কখন জাতীয় স্বার্থের মুখপাত্র হন , হতে পারেন ? এ বিষয়ে
কিছু উদাহরণ দেয়া দরকার।
মহান ভাষা আন্দোলন আমাদের শ্রেষ্ঠ অহংকার । সেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে ঐতিহাসিক কবিতা লিখেছিলেন , আব্দুল গাফফার চৌধুরী। যা পরে
গান হয়। '' আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি ''।
এরই পথ ধরে আসে ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন। শামসুর রাহমানের ''আসাদের শার্ট'' ধারণ করে সেই সময়কালকে।
আমাদের ঐতিহাসিক অর্জন মহান স্বাধীনতা। মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে লেখা
কিছু কবির কবিতা এখানে তুলে দেয়া যাক।
ক এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খান সেনা
ততদিন তব-মোদের যাত্রা মুহূর্তে থামিবে না।
(জসীম উদ্দীন )
খ
আপনারে মুক্ত করি যে সংগ্রামী বীর
দাঁড়াল উন্নত হয়ে পশ্চাতে সে
আর হটিল না,
( সুফিয়া কামাল)
গ
পোড়ে গ্রাম সমজিদ শহীদ মিনারঃ.
চোখ বাঁধা হাতে রজ্জু ট্রাঙ্কে বাসে জীপে
দেখি অসহায় বাংলাদেশ প্রতিদিন কেঁপে ওঠেঃ.
ভেসে যায় বুড়িগঙ্গায় তিতাসে
ধানের ক্ষেতের পাশে কাশবনে শকুন কুকুর
আর চিলদের বিশুদ্ধ উৎসবে।
( ফজল শাহাবুদ্দীন)
ঘ
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা।
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
(শামসুর রাহমান)
ঙ
বুকের গভীরে
মহত্তম সেই অস্ত্র যার
দানবের স্পর্শযোগ্য অবয়ব নেই কোনো
ধ্বনি যার অহরহ প্রাণে তার বাজায় দুন্দুভি
স্বাধীনতা স্বাধীনতা স্বাধীনতা।
আর সেই প্রিয়তম মহত্তম অস্ত্র বুকে
লুকিয়ে সন্তর্পণে ধীর পায়ে
অনন্য কিশোর
সঠিক গন্তব্যে যায় হেঁটে।
(আহসান হাবীব)
এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। এই কবিরাও তো ১৯৭১ সালে সেই
হায়েনা পাক বাহিনী আর রাজাকার জল্লাদদের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহী ছিলেন !
তারাও ছিলেন জাতীয় স্বার্থের প্রতিপক্ষ ! আজ বরণীয় তারা।
কিন্তু এখনও
একটি মহল সেসব কবিতা , সেসব সাহিত্য কে স্বীকৃতি দিতে রাজী হচ্ছে
না। এরাই সাম্প্রদায়িক শক্তি। এরাই সমাজে নাশক হিসেবে বীজ বোনার
তৎপরতায় ব্যস্ত।
৩
যে সব তর্কবাজরা এখনও নজরুলকে তাদের নিক্তিতে মূল্যায়ন করতে চায় এরা মূলত:ই স্বার্থপর -সুবিধাবাধী। তারা কবির মানবিক মূল্যবোধ ও
ধর্মীয় বিশ্বাস কে এক করে ফায়দা হাসিল করতে চায়।
প্রকৃত কবিরা সব সময়ই জাতীয় স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন । তারা বলেছেন মেহনতী মানুষের স্বার্থের কথা, আশার কথা, ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তার কথা।
এখানে সেরকম কিছু উদাহরণ দেবার প্রয়োজন মনে করি।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চ'লে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ'লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ'লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে।
চ'লে যাবে শহর বন্দর ধানখেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ'লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
( সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে / হুমায়ুন আজাদ )
এই কবিতায় যে চিত্রপট বর্ণনা করেছেন কবি , তার বাস্তবতা কি আমরা দেখছি না ? হাঁ, একজন কবির বিজয় সেখানেই।
বাংলাদেশে এখন অন্যতম সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে মৌলবাদ - সাম্প্রদায়িকতা। আর আরেকটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতারণা।
যা বড় বড়
দলগুলো হরহামেশাই করে যাচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে , এর বিভিন্ন বিষয়াদি
নিয়ে লিখলেই ঐ লেখকের গায়ে দলীয় লেবাস লাগাবার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যা একই কায়দায় কাজী নজরুলের গায়েও লাগাবার চেষ্টা করা হয়েছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ঐ সুবিধাবাদী চক্রটি এখনও সক্রিয় আছে । আছে
ঠিক আগের মতোই।
এবং তাদের মৌলচরিত্র থেকে গেছে একই।
এই সেই বাংলাদেশ ,যে বাংলাদেশে সুফিয়া কামাল নিগৃহীত হয়েছেন।
শামসুর রাহমান কে হত্যার জন্য খুনীরা তার শ্যামলীর বাসায় পর্যন্ত
গিয়েছিল। হুমায়ুন আজাদের রক্ত ঝরেছে এদের হাতেই।
আজও তারা একই কায়দায় জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার ঝান্ডা ওড়াতে চাইছে।
আর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে , সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ , রফিক আজাদ , বেলাল চৌধুরী , কবীর চৌধুরী , মাকিদ
হায়দার প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কে।
আমাদের সমাজচিত্রের বাস্তবতাকে এই তর্কবাজরা স্বীকার তো করেই না,
বরং পেশীশক্তি দেখাতে চায়। এই কবিতাটি পড়ুন .......
আরো শুনিলাম ঢাকা শহরের
একদল লোক
সারা বছরই
রাস্তায়, খাল-খন্দক কাটিতে পছন্দ করে
তাই ভয় হয় তুমি যদি
সেই খানা-খন্দকে একবার পড়িয়া যাও
তোমাকে ডাঙ্গায় তুলিবার মতো লোকজন আজকাল
নাই বলিলেই চলে
তাই তোমাকে বলিতেছি তুমি দুই জোড়া জুতা কিনিবা।
একজোড়া তোমার জন্য
আরেক জোড়া মুক্তিযুদ্ধের নামে।
মুক্তিযুদ্ধ যেন সেই জুতা পায়ে দিয়া তোমার সাথেই
আমাদের দোহার পাড়ার বাড়ীতে একবার আসিয়া
বেড়াইয়া যায়।
(জুতা বিষয়ক / মাকিদ হায়দার )
এটা আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক , সেই অশুভ, মানবতাবিরোধী
শক্তিটিকে আমরা এখনও হটাতে পারিনি। আর না পারার ফলেই কাজী
নজরুলের স্বপ্নের সাম্য , শান্তি , সৌহার্দ্য আমরা আমাদের সমাজে প্রতিষ্টা
করতে পারিনি আজ পর্যন্ত।
######## নিউইয়র্ক / ২৫ মে ২০০৯ ( নজরুল জন্মজয়ন্তীতে )
ছবি - হেরা হরটন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।