অবশেষে এসে গেল সেই দিনটা । সংসার হওয়ার পর একা আর কোথাও যাওয়া হয়নি । এবার একা যেতে যেন অনেকটা দড়ি ছিঁড়ে বের হওয়ার মতো । আমাদের ছোট্ট কন্যাটির বাইরে যাওয়াতে ভীষণ আনন্দ । কিন্তু এবার সে যাচ্ছেনা তাই ভীষণ মন ভার ।
তার এই মন ভার বুকে চেপে আমিও কোনো মতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম ।
যাক্ যাওয়ার আগে আমরা যাদের পরামর্শ পেয়েছি তাদের মধ্যে একজনের কথা একটু বলে নেয়া ভাল । সে নাকি প্রায়শঃই এপার ওপার যাতায়াত করে । যায় যশোহর । কলকাতা থেকে সকালে রওনা হয়ে বাড়িতে গিয়ে দুপুরের ভাত খায় ।
বলল কোনো ব্যাপারই না । ঝামেলা যা তা শুধু কলকাতা যাওয়া । ভিসা আর ডলারের জন্য। কলকাতা নেমে ফিরপো মার্কেটে গিয়ে ডলার কিনে বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে দরখাস্ত জমা করলেই হয়ে গেল । লোকটা পাড়া সম্পর্কে শ্যালক হতো ।
সেবার বাংলাদেশ ঘুরে শিলিগুড়ি ফিরে আমি আর রুন্টু ঐ শালাবাবুকে খুঁজে ছিলাম । কপাল ভালো আমাদের রাগ থাকতে থাকতে তার দেখা পাইনি । কারণ তার কথামতো আমরা সেবার কলকাতায় শুধু সময় এবং অর্থ অপচয় করিনি, বরং অপদস্ত পর্যন্ত হয়েছিলাম । অবশ্য আমাদের জোয়ারী উৎসাহ তাতে বিন্দুমাত্র দমেনি । বাঙালের গোঁ বলে একটা কথা আছে না ।
যা পুরোমাত্রায় আমাদের মধ্যে বিরাজমান ছিলো ।
সেবার সকালে শিয়ালদা স্টেশনে নেমে আমরা সময় নষ্ট না করে দুর্মূল্যের ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে গেলাম ফিরপো মার্কেটে । পৌঁছে দেখি মার্কেট বন্ধ । ঝাড়া এক ঘন্টা অপেক্ষার পর মার্কেট খুললো । সেখানে ঢুকে মানি এক্সচেন্জারের কাউন্টারে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে সরাসরি বললাম ডলার লাগবে ।
উত্তরে কিছু না বলে লোকটা ভুত দেখার মতো আমাদের দেখতে লাগলো । সকাল সকাল দোকান খুলেই এরকম দুইজন ভুত দেখবে এতটা হয়তো ভাবেনি । যা হোক উত্তর তো তাকে দিতেই হলো । বললো- সোজা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চলে যান । পারমিশন করিয়ে আনুন ।
তারপর দেখা যাবে । বলেই সে দোকান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । আমরাও অবাক হয়ে দু'জন পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে । অতঃপর সেখান থেকে হাঁটা পথেই চললাম রিজার্ভ ব্যাঙ্ক । হায়রে সেখানে এসে দেখি বিশাল লাইন ।
অধিকাংশই বাংলাদেশযাত্রী । শুনছি সেখানেও নাকি ডলারের রেশন করে দেয়া হয়েছে । অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমান ডলার ইস্যু হয়ে গেলে লাইনে থাকলেও আর ওদিন হবে না । পরদিন আসতে হবে । শুনেতো আমাদের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা ।
বেড়ে যাবে হোটেল খরচ । আমার আবার টান পড়বে ছুটিতেও । সংগে তো গোনা পয়সা । সবসময় চিন্তা এই বুঝি কম পড়ে যায় । যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয় ।
দুপুরের পরে আমাদের টার্ম আসার আগেই বলা হয়ে গেল আজকের ডলার ইস্যু এখানেই শেষ। আবার পরদিন । পরদিন বলতে তারও পরদিন । কারণ পরদিন সরস্বতী পুজা । ব্যাঙ্ক বন্ধ ।
কিন্তু আমরা নিরুপায় । সারাদিন নানা রসিকতায় সবাইকে নিয়ে জমিয়ে থাকা রুন্টুও কেমন শান্ত হয়ে গেল । এদিকে ভেঙে গেছে লাইন । যে যার মতো এদিক ওদিক চলেও যাচ্ছে । আমি বললাম রুন্টু যাহোক কিছু একটা করতে হবেই--দু'দিন ধরে হোটেলে বসে থাকলেতো সব দম এখানেই শেষ হয়ে যাবে ।
যাওয়া আর হবে না । দু'জনে পরামর্শ করে ঠিক হলো যে ঐ ইস্যুইং অফিসারকে ধরতে হবে । বলতে হবে আমাদের অবস্থাটা । দরকারে পা' জড়িয়েও ধরতে হবে । রেডি ? চল ।
দুজন আস্তে আস্তে অফিসারের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ---কী চাই? আমাদের কথা পুরো না শুনেই ---না না অসম্ভব, পরশুদিন আসুন । কিন্তু আমরা নাছোড় । আমরা আমাদের কথা বলেই চললাম । অফিসারটি তার কাজও করে চলল । মাঝে মাঝে খুব করুণ সুরে 'স্যার আপনি আমাদের ভরসা---আপনি স্যার-----বলতে বলতে রুন্টু সত্যি সত্যি নিচু হয়ে টেবিলের নিচে---বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে----।
অফিসারটি প্রায় আঁতকে উঠলো । 'এই এই করছেন কী, করছেন কী' বলে নিজের হাতের কাজ থামিয়ে এতক্ষণ পর আমাদের মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন । জিগ্গেস করলেন ব্যাপারটা কী বলুন তো--। সুযোগ পেয়ে আমরা দেশ বাড়ির কথা এবং আমাদের দুদিন অপেক্ষা মানে যাওয়া না হওয়া--ইত্যাদি অফিসারকে আমরা আমাদের সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করলাম । লেগে থাকলে সাফল্য আসে--কথাটা দেখা গেল আমাদের এই ক্ষেত্রে লেগেও গেল ।
অফিসারটি রাজি হয়ে আমাদের দরখাস্ত এবং পাসপোর্ট দু'টি চেয়ে নিলেন । আসলে তখনও কিছু জরুরিভিত্তিক ইস্যু বাকি ছিলো । আমাদের কেসটা উনি সেখান থেকে করে দিলেন ।
সারাদিন স্নান খাওয়া নেই তো কি হয়েছে । যখন বেলা পাঁচটায় হাতে পারমিশনটা নিয়ে আমরা দু'জন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বের হলাম তখন আর আমাদের পায় কে ।
লালদিঘির উল্টো দিকেই রয়েছে বিখ্যাত মানি চেন্জার । আমরা ফিরপো মার্কেট ভুলে গিয়ে লালাদিঘি প্রায় একলাফে পাড় হয়ে পৌঁছে গেলাম আর এন দত্ত'র কাউন্টারে । ডলার কিনে সোজা শিয়লদার কাছে এক হোটেলে । বেশি রাত না জেগে শুয়ে পড়লাম । কারণ খুব ভোরে আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে গিয়ে লাইন দিতে হবে ।
ভিসার দরখাস্ত জমা দেওয়ার জন্য । শুনলাম অনেকে নাকি ওখানেই ফুটপাতে রাত কাটায় । আগে লাইন পাওয়ার জন্য । যাক্ আমরা হোটেলের বয়'কে বলেও রেখেছিলাম আমাদের ডেকে দেওয়ার জন্য ।
পরদিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে গেলাম পার্কসার্কাস ।
এত ভোরে আর কোথাও ভীড় না থাকলেও হাইকমিশন অফিসটির সামনে বেশ ভীড় । সবই প্রায় দুস্থ দরিদ্র মলিন মানুষের জটলা । তার মধ্যে অনেকেরই রাত কেটেছে ফুটপাতে। কারণ অনেকেই কলকাতার বাইরের থেকে এসেছে । যাক্ আমরা প্রথম বিশ জনের মধ্যে আছি ।
কাউন্টার খুলবে বেলা দশটায় । মাত্র এক ঘন্টার জন্য । বন্ধ হয়ে যাবে এগারটায় । আমাদেরটা এগারটার মধ্যেই জমা হয়ে গেলো । এবার আমাদের টেনশন বিকেল চারটা অবধি ।
চারটায় আবার কাউন্টার খুলে নাম ডেকে ডেকে পাসপোর্ট ফেরৎ দেবে । হোটেলে ফিরে বিশ্রাম । টেনশনের কারণে আমরা আবার তিনটের মধ্যেই চলে এলাম হাইকমিশনে । অবশ্য সব টেনশনের অবসান ঘটিয়ে আমরা দুজনেই দশ দিনের ভিসা সমেত পাসপোর্ট ফেরৎ পেলাম । এবার আমরা যেতে পারি বাংলাদেশ ।
দীর্ঘ একবছরের নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এই একটা পর্যায়ে যে আমরা এসে পৌঁছুতে পারবো একসময় সত্যিই আশা ছিলোনা ।
এই দিকে রুন্টু লাফাচ্ছে । কতক্ষণে ভোর হবে । ঠিক হলো যে পরদিনই যতটা ভোরে সম্ভব আমরা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখবো । এই নাটকীয়তা এই উত্তেজনার স্বাদ শুধু আমরাই নিচ্ছি ।
এর ভাগ আর কে নেবে!(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।