আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতা সময়ের পাঠ নাকি সময়কে পাঠ করা?

_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________

কবিতা সময়ের পাঠ নাকি সময়কে পাঠ করা? সৈয়দ আফসার অতিপ্রতি কল্পনার মতো বিরহ কাতর দিনে একা ফ্রেশইয়ার গায়ে মাখবো বলে হাঁটতে-হাঁটতে ওভার-ব্রীজের সরুহাতল চেপে গা হেঁলিয়ে দাঁড়াই, দৃষ্টি গুলিয়ে ফ্রেশইয়ারের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করি, বৈরী আবহাওয়ার সাথে দিনের তরতাজা স্মৃতি ধরে রাখবো বলে এত যে মাখামাখি! কখনও চোখ বুঁজে, গা চেপে শিহরিত করে, তাকে কল্পপ্রীতি ভেবে বন্ধু হতে বলি! একসাথে ডিনার খাবো, মিডনাইট বাতি নিভিয়ে দীর্ঘ ঘুমের আবেশে এককাঁথায় শোবো.. জানালার কাচ ভেদ করে সকালের সূর্য্যে আমাদের জাগিয়ে তুলবে, আমরা স্নান করবো; তুমি স্যন্ডউয়িচ তৈরি করবে আমি ফ্ল্যাক্স অন্ দেবো চা বানাবো। কিছু বললে না শুধু ছুঁয়ে গেলে নীরবতায় আমার প্রয়োজন হল ধৈর্য্য। আজকের দিনটা ভাল রোদ-যৌবণা, পারসোনালি আমার। দূরে গেলে ফিবরে না সহসাই... তাই ছায়ার সাথে দেহের পুরনো সখিত্ব একই আগ্রহে বাড়ছে, মনে হয় দৃষ্টিরুচি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এক সাক্ষাৎকারে, মানবসভ্যতার অগ্রগতি হচ্ছে কিনা?--এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন--দিনদিন তো আমাদের শব্দাংক বাড়ছে।

শব্দের ক্রমপ্রবৃদ্ধির অর্থই মানবসভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। কেননা প্রতিটি শব্দই হচ্ছে একটি একটি নতুন আইডিয়া। আর নতুন আইডিয়া মানেই অগ্রগতি। শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত উক্তি--নতুন শব্দ নয় শব্দের নতুন সৃষ্টি এসব শব্দ, শব্দকথা সারা দিনের ক্লান্তিহীন কাজের ফাঁকে মাথায় ঘূণপোকার মতো হাঁটে। রাতে যখন কিছু লিখতে বসি বারবার নিজেকে প্রশ্ন করি? কেন যে এখনও আমি দু'এক লাইন লেখার চেষ্টা করি! নিজের ভেতর কী এমন সুপ্তকাঙ্খা লুকানো শবদেহ যেন[sbমদনকুমার! চেতনে-অচেতনে কি এমন গুপ্তকথা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভাবায়, দৃষ্টির শূন্যবোধ ছাড়া কি এমন ধরে রেখেছি যে, এপিঠ ওপিঠ ছিঁড়ে-ছেনে দোলায়-উৎরায়... আমি তো জেনেছি চেয়ে থাকলে চোখের সৌন্দর্য বাড়ে না স্পর্শও করা যায় না, যদিও সকল কল্পনার ভেতর জন্ম নেয় ব্যক্তি শরীরহীন কিছু অভিমান।

নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা কাঙ্খাগুলি নিজের জন্য লিখি পূর্ণবার পড়ে আনন্দ লাগে, নিজেকে আয়নার ওপাশে দাঁড় করাই নিজেকে কবি করে তোলার সাধ সারারাত জেগে থাকে, কিন্তু আমার তো শেষের কবিতার লাবণ্য নেই, নেই জীবনান্দের বনলতা সেন, বিনয়েরগায়ত্রী মঈন চৌধুরীর পরিনেই, মোস্তাক দীনের পড়শিও কাছে নেই... বৃষ্টি ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কিন্তু কবিতার পরতে পরতে তুমি... কবিতায় তুমি-টা আসলে কে? না!... কিছুই জানি না; নিজের ভেতর যৌনতা ছাপিয়ে যৌবণ পান করা কী এক বিষাদময়ী অজানা দীর্ঘশ্বাস নিরুপায় কাঁদে, পলে অনুপলে অন্ধকার নামে আত্ন-বিশ্বাসে; ঘুমকুয়াশা রাতে ঝরাপাতার শব্দগুলো অবিশ্বাস্যরকম আবেগি করে তুলে; কি রকম একধারণা মনোজগতের সন্নিকটে কেঁপে ওঠে; স্বপ্নলোক বাতাসেও হারায় দুঃখ মনে হয় স্পর্শহীন নিঃসঙ্গী। তখন কেন জানি মনে হয় কিছুই জানে না শোকপাখি, শীতের আড়ালে বরফঢাকা মুখগুলো লজ্জাকাতর; একাকিনী। সুখে দুঃখে আমি অতিসাধারণ, শীতে বুকে কাঁপন তুলে নিয়ত ঠেলে যাচ্ছি জীবন, আর প্রতিটি শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে দু-চোখের আবেগ। বলতে পারো মৌনবিষাদ।

সংশয়ের ভেতর লুকিয়ে গেছে আপন মুখগুলো ভাবলে মনে হয় ছুটির দিনে এই বুঝি হারালে কেউ সুনসান দুপুরে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে। কিন্তু কেনো?... মন তুমি কিছুই যান না, লাজে বিলাজে শুধু কাঁপো নিঃঝুম প্রাণে। ছদ্মভেসে শূন্যতা জাগিয়ে তুলো প্রাণে, মনেই পড়ে না হৃদকন্ঠবুকে কখন রেখে ছিলে ঋণ বসন্ত না শীতে। দু’হাত পেতে রাখি উষ্ণতায় থেঁতলে যাওয়া রোদে; যদি ছায়াতে খুঁজে পরিত্যাক্ত জিজ্ঞাসা... পুরোটাই পাবে। শুধু দূরত্ব এটুকু যে স্থানে এসেছি গ্রীষ্ম-বসন্ত বলতে কিছু নেই, পাইনি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ পাখির কলতান জোনাকি পোকা কিংবা ঘাস ফড়িংয়ে সন্ধান।

পাইনি পাকা ধানের ঘ্রাণ...নেই ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের আমেজ; অলি-গলি চোখে পড়ে না মেঠো পথ ধরে হাঁটা হয়নি কতদিন আমাকে ছেড়ে সন্ধাকাশে মিটমিট্ আলো হাসছে সোডিয়াম বাল্বে মিশে । চোখের জলে গলে না লবণ, বরফ গলে না রোদে মিশে ওই শীতের দেশে; কিভাবে বাঁচি? ভেবে মাছ মাংসের ঘ্রাণে ঠোঁট চেপে হাসি, অর্ধাংশ কল্পনা হালকা করে দশনোখে রাখি; জিজ্ঞাস করো-রে মন? কোনো পরবাসি...! কেউ জানে না তোমার এড়িয়ে চলার দ্বিধা গুছিয়ে রেখেছি তীব্র যন্ত্রণায় হাড়কাঁপা কুয়াশার ফাঁকে। কাউকে বলবো না কলহসুখগুলো রেখে তুমি কীভাবে পাড় হও সাঁকোহীন নদী, নদী পাড়ের গ্লানি। নদীর চোখে ঝুকে পড়া মেঘ সেজে বৃষ্টি হও, তোমাকে প্রণাম দেবো জলহীন তরীদাহ! যেখানে জল দেখে তৃষ্ণার্ত তুমি; কে তোমাকে অঙ্গুরি ছোঁয়াবে গভীর টানে। না! তোমাকে বলবো না ওই যে দাঁড়িয়ে আছি অপেক্ষা করছি তোমার হেঁটে যাওয়া পথে, না হয় কল্পনায় জড়িয়ে রাখুক খুঁটে-খুঁটে দেখুক মাটির যন্ত্রণা।

কাঁকনের শব্দ হৃদকম্পন জাগে আজ ঘুঙুরের শব্দ দু’পায়ের ফাঁকে বাজে তাও কম কিসের; ছোট্ট বেলার সেই লুকোচুরি খেলার ছলে কৌশরে পেয়েছি বৃষ্টির দোলা এখন শুধু স্মৃতির আকরে ব্যথা পাবে কষ্টপাথরের বুকে। আর ওই সব স্মৃতি এখন প্রদীপে জ্বলে না, বহুদিন পর সব নিষেধ ডিঙিয়ে স্বপ্ন হয়ে জড়ায় রাত্রিশেষে, বালিশের পাশে। বুঝতে পারি না কি বলবো অন্যভাবে... গতরাতে যা পেলাম যদি তোমাকে বলি, শুনবে তো?... সোডিয়াম আলোয় ওই সারি সারি অপরিচিত গাছের প্রেমাঘাতে শুনে কিছু পাতারও আসক্তি জাগালো। সিগারেটের অবশিষ্ট অংশের মতো কিছু শুকনো ডালপালার তৃষ্ণা ছড়িয়ে পড়ল গাছের মূলে। সে দিন ওই স্মৃতিকে বলছি যদি ফিরে এসো সমস্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে এসো... কিন্তু তুমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছো আশ্বাসের ভেতর, কিছুই বলবো না কিছুতেই হাঁটতে যাব না ওই দিগন্তশোকে হয়ত হাঁটতে হাঁটতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে ফাঁড়ি পথ ধরে রাত্রিশেষে বাতাসের মর্মর সুর চিরায়ত নিয়মে ভেঙে যাবে ঘুম চেনা সেই কাক ডাকা ভোরে... সারারাত পাহারায় থেকে নিজের পোষা কুকুরটিও ঘুমিয়ে যাবে বারান্দার একপাশে।

মন তাড়া করে হারানোর ভয়, দায়িত্বও বেড়ে যায়; কিন্তু বুঝে ওঠতে পারি না কি কারণে দু’চোখে ভাসে করুণস্মৃতি আনমনের দায়বদ্ধতা। বলবো না চার-দেয়ালর ভেতর ফায়ারপ্রেসে যদি অনুভূতিগুলো কাঁদে, কাঁদুক ছুঁয়েও দেখবো না; যদি বলি বরফের দেশে এই তো বেঁচে আছি তোমার মত হিম বাতাসে শরীর ঘিরে রেখেছে নিবিড়তা,রূঢ়তা, না-ফোটা সীমাবদ্ধতা। স্বভাব দোষে রাতের কথাগুলো শুয়ে পরে বালিশের পাশে, কেবল মশারি টাঙানো যায় না। বিচানাকে বলি থাকে তুমি গোপন কথাগুলো বলো; সহায়তা করো; শাসন করো না। সুখে-দুঃখে আলোড়িত করো সেও একদিন হতে পারে চিরসখা ... মনের ভেতর সারাক্ষণ গুনগুনিয়ে নিভৃতে যে সকল স্মৃতি-বিস্মৃতি মনকে দোলায়িত করে সে সকল স্মৃতিকে ভাব-ভঙ্গিমায় প্রকাশ করার জন্য সুর ও ছন্দের পথে হেঁটে হৃদকোষে এক ধরনের বিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা থেকে দু’একটি লাইন লেখার তাড়না জাগিয়ে তুলে হয়ত তাই কবিতা।

ওঠা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। দু’একলাইন যা লিখি নিজের জন্য লিখি ভবিষ্যতে স্মৃতি জাগাবো বলে; তারচে’ বেশি জানি না কোন পথ ছুঁব আগে পাপ না পুণ্যের, পুনঃপুন উদ্দেশ্য-নির্দেশ-উপরোধ বলা যায় প্রযোগ। ধর্মের জ্ঞানে পরোক্ষ ভাবে পুণ্যতার দিকেই মন প্রাণ ধাবিত করে কিন্তু কবিতা রহস্যের জালে পুড়ে হৃদয়ের অন্তঃপুরে কৌতূহল জাগায়। সে সব কথাগুলো ভাবলে অন্তরের গ্লানি ঘুচে না, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে আহত দেহে নামে বিন্দু-বিন্দু নীরবতা। সকাল হলে ভুলে যাই রাতের সবটুকু ভাল লাগা।

ইশারা ইঙ্গিতে কিছুই স্বরণে আসে না, রোদ থেকে ছায়াও গড়িয়ে নামে; ডানাহীন জলপ্রীতিআলোহীন অন্ধকারহীন বল-বীর্যহীন শাশ্বতের উচ্চাশাহীন বিজ্ঞানহীন শূন্যআরএককহীন মিথহীন সময়হীন আশাহীন ব্যাপ্তিহীন স্পেসহীন মাত্রহীন মুখহীন ভূগোলহীন অতীবর্তভবিষ্যহীন দেহের সান্ত্বনা। কবিতা ছাড়া আর কোনো পথে হাঁটতে জানি না মাকে ভালবাসি যে গর্ভে প্রাণ দিয়েছে মা...। কিন্তু মা কবিতা পছন্দ করে না, মা বলেন যে সময়টুকু কবিতার পেছনে ব্যয় হলো যদি এই সময়টুকু মসজিদে নামাজ পড়ে ব্যয় করো, তাহলে পরকালে তার ফল উপভোগ করতে। কিন্তু মাকে বুঝাতে পারিনি এই সব ধরা বাঁধা নিয়ম আমার ভাল্লাগে না, সবার উপরে মানবতা তারচে’ বেশি বলবো না। মাকে বলতে পারি না ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে হুহু করে কেঁদে ওঠে বুক, কনকনে শীতের রাতে যারা কাগজ জ্বালিয়ে রাত কাটায় তাদের কথা কে শুনে; যারা রিস্কা ঠেলে ঠেলাগাড়ি চালায় নৌকা বায় বৈঠার বাইনে বাইনে শ্বাসকষ্ট পোড়ায়, মনের সুখে গলা ছেড়ে গান ধরে, তাদের পানে মন চলে যায়।

এসব স্বরণে এলে লতা-পাতার মতো বোবা হতে থাকি স্বর্ণলতা পরাগাছা সেজে, দেহ ছেড়ে সেও চলে যাবে একদিন সব মায়া ভুলে চিরস্থায়ী ঘুমে। ছোট্ট সেই পিঁপড়েরও স্বাধীনতা থাকে তার পথটুকু সে নিজেই অতিক্রম। কিন্তু আমি... আমার পথটুকু অতিক্রম করতে পারিনি, যেমন তুমি পেরেছো; তোমার মত করে সাজিয়েছো যেন পত্রলিপিতে কেঁপে ওঠা সাড়ে তিন হাত শাদা কল্পনা। কবিতা যে আমার প্রাণে মিশে গেছে, যদি বেঁচে থাকি কবিতা নিয়েই বাঁচবো। কবিতা পাঠে সময় নষ্ট হয় না, কবিতা সময়ের পাঠ নাকি সময়কে পাঠ করা? তাও জানি না।

এই যে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে... নিয়তির দোষ দেব না। বাংলা কবিতা দেশে নেই, কোকিল-শ্যামা-দোয়েল পাখির কলতান নেই, মুক্তবিহঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়াউড়ি করে না শীতের অতিথি পাখিগুলো, গোলাপ-জবা-বেলী-রজনীগন্ধা কিংবা চ্যামেলি ফুলের ঘ্রাণ খুঁজে পাই না, ওই লাল-শাদা-বেগুনী চেরী ফুলের টবে, আষাঢ়ের কদম ফোটে না ডালে ডালে; পুকুরের জলে শাপলাফুল হাসে না গাছে গাছে মরা ডালের আর্তনাদ মর্মরে কানে বাজে, সবুজ ঘাসে পা ফেলি না কতদিন হলো... অন্ধকার রাতে একাকী হাঁটি সোডিয়াম আলোর পাশে। লেখক কিংবা কবি সব সময় তাঁর চারপাশ নিয়ে চলতে হয়, আমি কবির কথাই বলবো; কবি সব সময় শব্দকে ভাঙবেন, টুকরো টুকরো করে নিজস্ব ভাষা-প্রকরণে আর শব্দের গভীরতায় ফুটিয়ে তুলবেন। কবি শুধু ভাবনা-কল্পনা-সময়চেতনা কিংবা দায়বদ্ধতা থেকে কবিতা লিখবেন তা মনে করি না। কবিতা নিজের ভেতর ফুটিয়ে তোলা নিজের কথাগুলো সহজ সরল করে বলা নিজের ভেতর শব্দের ভূবন, শব্দনির্বচন কিংবা শব্দবিন্যাস করে নিজের একটি স্বকীয় পথ খুঁজে ফিরবেন সেখানেই একজন কবির স্বার্থকতা।

কবি তো খুঁজে নেবেন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রাণগাছের রসদানা কোথায় রোপণ হওয়া আপন সান্ত্বনা । মনকে নাড়িয়ে যদি হাঁটি, যদি আবেগে ঝেড়ে ফেলে ফেরারী রুমাল ছায়া হয়ত মিলিয়ে যাবে পথে, আমি আর্দ্র আবহাওয়ায় বার-বার খুঁজেছি তোমাকে, সময়ের পথে, কখনো পাশের বালিশে, ঝুলানো দেয়ালের আয়নায়। তবুও মনে হয় সময়ের কোনো পরিধি নেই, নেই কোনো বাছ-বিচার। আমাকে করুণা করো না বন্ধুরা ক্ষমা করো সুজনেষু যারা। পরবাসে এসে প্রথম মনে হলো আমি আর কবিতার পথে হাঁটতে পারবো না; কবির দেশ কবিতার দেশ থেকে হারিয়ে যাব; লুপ্ত আকুতি ছাড়া নিজের নেই বিস্তর জানাশুনা।

চার দেয়ালের ভেতর বন্দি করেছে শীতের তীব্রতা। জীবনের এই উপলব্দি-অভিজ্ঞতার ভেতর নিজস্ব দহন-পীড়ন-দুঃখ-যন্ত্রণা কিংবা আনন্দ বেদনাকে পুঁজি করে আশা-প্রত্যাশকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখা। সব কবিরাই চান তাঁর অভিব্যক্তিগুলো নিজের মতো করে ছিঁড়ে -ছেনে দেখে, নিজের সরল পথ সন্ধান করা, খোঁজা... এপ্রসঙ্গে যদি শঙ্খঘোষের সেই কথাগুলো বলি,শব্দের সত্য কি কবি তুলে নেন নিজস্ব জীবনযাপন থেকেই? যাপনের সঙ্গে তাঁর উচ্চারণের নিবিড় কোনও সঙ্গতি কি থাকে কোথাও? না যদি থাকে তা, শব্দ কি তবে পৌঁছে যায় না কেবল নিষ্ফল কয়েকটি চিহ্নে? এই ভাবে কি সমস্ত শব্দকেই নিরর্থ আর নিষ্ক্রয় করে তুলছি আমরা? কবি কি তাঁর কবিতা বন্ধ করে দেবেন তবে? না কি তাঁর ভিন্ন একটি ধরন সত্যের পথে যাবার?হয়ত এরকম জিজ্ঞাসা মনের গভীরে থেকে যায়, প্রকাশভঙ্গি কিংবা উচ্চারণের ধারায় আত্ন-মগ্নতায় ঘুরপাক খায় শূন্যতায় কবিকে পীড়িত করে কবি চান তাঁর কাব্যজগতকে নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের কল্পনা-উপমা-অলংকার জগতকে সেচে-ছেনে নিজের সেরা কবিতাগুলো লিখতে, সবাই তা পারেন না বলেই নিরন্তর চেষ্টা... আর যারা পেরেছেন সে পথ ধরে হাঁটতে এবং তারা তাদের কবিতাগুলোকে আরো উপভোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য; লিখে যাচ্ছে নিরবধি তাদের কবিতা পাঠে আমিও ঋণী। এখানে আমার পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে নব্বইয়ের দু’জন কবির কবিতা প্রসঙ্গে বলবো একজন লিখে গেছেন এবং অন্যজন লিখে যাচ্ছেন নিরন্তর তাদের কবিতা এক বার পড়ে তৃপ্তি আসে না হৃদয়ে শান্তি মিলে না অদৃশ্য এক কল্পনার দোলাচলে হাঁটি বার বার পড়তে মন চায় শব্দের ভাঁজ খুলে খুলে দেখি। প্রথমে পড়বো নব্বইয়ের ক্ষণজন্মা কবি শামীম কবিরের কবিতা, মাত্র চব্বিশ বছর বেঁচে ছিলেন, এই অল্প সময়ের মধ্যেও তিনি লিখে গেছেন কিছু অসাধারণ হৃদয়ছোঁয়া কবিতা।

জাল কবিতাটি আমার খুব ভাল লাগে আশা পাঠকেরও ভাল লাগবে। একদিন জাল ফেলতে যাবো/ জাল ফেলার খুব আনন্দ/ জাল ফেলা বিষয়ে আমার পরিচিত এক জেলে আছে / সে বলে জাল তুলে কতো কিছুইতো ধরা পড়তে/ দ্যাখা যায় কিন্তু জালের আসল কাজ হলো মাছ ধরা/ আমি মাছ খাই না/ একদিন জাল ফেলতে যাবো /অবশ্য আমার মাছ না উঠলে চলবে/ (জাল/ শামীম কবির/ নব্বইয়ের কবিতা / মাহবুব কবির সম্পাদিত ১৯৯১) জাল কবিতাটি পড়লে আমার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে মনে পড়ে পদ্মা নদীর মাঝি গল্পে অসহায় জেলে কুবেরের কথা, এখনো কুবেরের মতো অনেক জেলে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর থেকে মাছ ধরে জল ও জালের সাথে জীবনের গ্লানি টেনে নিচ্ছে বাঁচার তাগিদে। জাল কবিতাটি যতবার পড়ি ততবারই ভাল লাগে, চোখে ভাসে করুণস্মৃতি, আরো ভালো লাগে কবিতাটির ভেতরের গল্পটি কি অপূর্ব যেন জীবন সুতোয়গাঁথা। নব্বইয়ের আরেক কবি মোস্তাক আহমাদ দীন এর জন্মলজ্জা কবিতাটি আমার প্রিয় একটি কবিতা-- এ বিধি লাগে না ভালো: জন্ম লজ্জা ফেলে দিতে / কাঁদিবার কথা / এ বড় রহস্যকথা সান্দ্রকথা আমি তার বুঝি নাতো সার / আমার সঙ্গিরা বলো / কাহার গলায় ধরে বলি আজ জননী জননী / এত যে ঘুরেছি ভূমি তবু আমি জীবন চিনি না / অথচ সে যুবক নই / দিবসে দাঁড়ালে যে সূর্যকণা খেয়ে নিত রাতের দাঁতেরা / আমার নিয়তি ওহো / বাববার ভুলে যাই জন্মদাত্রী আমার মায়ের মুখ, স্তন / অথচ গ্রহণ প্রশ্নে / জমজ বোনেরে ঠেলিয়াছি দূরে / আজ বিস্মরণের দিন আজ এংকা পথে ঘুরিতেছি / আনত দুহাত নিয়ে / জন্মলজ্জা ফেলে দিতে শূন্যে শূন্যে খুঁজিতেছি গলা (কথা ও হাড়ের বেদনা / মোস্তাক আহমাদ দীন / প্রকাশক পাঠকৃতি ফেব্রায়ারি ২০০১) কবিতাটি মেজাজ,উপস্থাপনা,উপমা,চিত্রকল্পের কী অর্পূব সংমিশ্রণ তারচে’ আরো সুন্দর নিজের মতো করে কবিতা ভেতরে প্রবেশ করে নিজের স্মৃতিকে কল্পনার রঙে-ঢঙে দোলায়িত করা। কবি পরোক্ষ ভাবে তাঁর জীবনের আক্ষেপ যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন; নিজেই নিজের আত্ন মগ্নতা,কাতরতা,তুচ্ছতার গল্প তুলে ধরেছেন।

সৃষ্টিশীল সত্তাকে খুঁজে ফিরছেন জীবনের গতি-প্রকৃতিতে মিশে, স্মৃতি-বিস্মৃতিতে ডুবে হৃদয় চুরমার করে চিরায়িত বন্ধনের নানা অনুষঙ্গকে বিষয় বৈচিত্রের মাধ্যমে কন্টাকাকীর্ণ বোধের ঠনক নাড়াতে চেয়েছেন স্বতন্ত্র মেজাজে। একজন সৃষ্টিশীল কবির কবিতা পড়ে নিজের ব্যবধান খুঁজি, নতুন পথের সন্ধানে হাঁটি... সে সব জিজ্ঞাসার প্রাপ্তি খুঁজে ফিরি ঘুমন্তশ্বাসে। সব কবিরাই চান নিজের কাব্য জগতকে নিজের মতো গড়ে তুলতে, হৃদকোষ ছিঁড়ে-ছেনে অবধারিত ভাবে লিখতে, লিখেছেন নিজের অন্তঃসত্তা অন্তজগতকে ব্যবহার করে। যদি রুমাল দিয়ে মুছে নাও দু’চোখের জল;না ছুঁলেও দুঃখ পাবে। রুমাল থেকে জলের গন্ধ পাবে, তোমাকে ছুঁয়াবে; ছোঁয়াবে।

আর যদি আঙুলে চেপে ধরো মাউথ অর্গানের সুর, না-ছুঁলেও হবে। রুমালের দুঃখগুলো আমারি র’বে । ভিনদেশে বসে স্বদেশে ফিরে যাবো, সে কাঙ্খায় স্বপ্নগুলোকে টেনে হেঁছড়ে ইলাষ্টিকের মতো পরিধি গুনে চলেছি, মাটির গন্ধ পাইনি জামায়, জলপুকুরে স্নানহীন শরীরের ঘাম, ছয়ঋতুর পরিবর্তনের অনুভব অনুভূতিগুলিকে জাগিয়ে রাখি রহস্যময় দৃষ্টিতে ফ্রেমেবাঁধাপ্রাণে। কবিতার দায় কি পরিবর্তন, না বিবর্তন? তা জানি না, শুধু বলবো যত দিন বাঁচি কবিতা নিয়েই বাঁচতে চাই; কবিতায় নিজের আবাস ভূমি বানাতে চাই; কবিতা আমাকে নতুন পথ দেখাবে মনের শান্তি দেবে, আর... গদ্য লেখার পেছনে যে দু'জন আমাকে নিরবধি তাগাদা দিয়েছেন, দু'জনকেই ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।

নুশেরা আপু, আন্দালীব

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.