মানুষ যা কল্পনা করতে পারে, তা সে অর্জন করেত পারে।
নোম চমস্কি
ঘোষক: যে শ্রুতি-সেমিনারটি আপনারা শুনতে যাচ্ছেন সেটি শব্দযন্ত্রে ধারণ করা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের যুবক-যুবতীদের হিব্রু সমিতির কবিতা-কেন্দ্রে, ১৯৭০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি। এই অনুষ্ঠান হাজির করছে নোম চমস্কিকে। তিনি বলবেন ‘‘ভবিষ্যতের সরকার’’ নিয়ে। বলছেন নোম চমস্কি ...
একটি অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত মোটামুটিভাবে আদর্শ চারটা অবস্থানকে আলোচনার কর্মকাঠামো হিসেবে দাঁড় করিয়ে নেওয়াটা আমার মনে হয় কাজের হবে।
এই অবস্থানগুলোকে আমি (১) ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী, (২) মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক, (৩) রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক, এবং (৪) রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী অবস্থান নামে ডাকতে চাই এবং একটা একটা করে আমি এগুলো বিবেচনা করে দেখতে চাই।
আর, আমার নিজের অবস্থানটা আমি আগেই পরিস্কার করে দিতে চাই, যেন আমি কী বলছি তা আপনারা মুল্যায়ন ও বিচার করতে পারেন। মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বলতে আমি বাম-অভিমুখীন মার্কসবাদ থেকে শুরু করে নৈরাজ্যবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত চিন্তাধারার পরিসরটিকে বোঝাতে চাই। আমার মনে হয়, এই ধ্যানধারণাগুলো মূলগতভাবে সঠিক এবং অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজের যুগে এগুলোই ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের উপযুক্ত ও স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। উল্টোদিকে, আমার মনে হয়, শিল্পায়িত দেশগুলোতে তথা শিল্পায়িত সমাজসমূহে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ (অর্থাৎ যেটা বলশেভিকতন্ত্রে পরিণত হয়েছে), রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের মতাদর্শ, আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র-এগুলো নিঃসন্দেহে আধিপত্যশীল; কিন্তু আমার বিশ্বাস, সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে এগুলো পশ্চাদমুখী এবং অত্যন্ত অপর্যাপ্ত।
এবং আমার বিশ্বাস, আধুনিক শিল্পায়িত সমাজের সাথে এইসব সামাজিক কাঠামোর এক প্রকার অনুপযুক্ততা এবং সামঞ্জস্যহীনতা থেকেই আমাদের সত্যিকারের মৌলিক সমস্যাগুলোর একটা বিরাট অংশের উদ্ভব ঘটে থাকে।
তো, এখন তাহলে এই চারটা আলোচ্য অবস্থান একটা একটা করে বিবেচনা করে দেখা যাক। আরম্ভ করব ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ
ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সবচেয়ে পরিসীমিত ও ন্যূনতম উপায়- আঙ্গিকগুলো ছাড়া অন্য সকল প্রকার হস্তক্ষেপের বিরোধিতার ঘোষণা দেয় ধ্রুপদীউদার-নীতিবাদ। এ হলো তার প্রধান ভাবধারা।
আচ্ছা, এই সিদ্ধান্তটি পরিপূর্ণভাবে পরিচিত ঠিকই, কিন্তু যে যুক্তি-পরম্পরা এই সিদ্ধান্তটিতে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে কাজ করে, সেটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এবং আমার মনে হয়, খোদ সিদ্ধান্তটির চেয়ে সেটি অনেকখানি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই অবস্থানের একেবারে গোড়ার দিকের এবং সবচাইতে দীপ্তিময় ব্যাখ্যাগুলোর একটা হচ্ছে ভিলহেল্ম্ ভন হামবোল্টের রাষ্ট্রকর্মের সীমা । এটা লেখা হয়েছিল ১৭৯২ সালে। কিন্তু পরবর্তী ৬০/৭০ বছর ধরে এটা অপ্রকাশিতই ছিল। তাঁর মতে:
রাষ্ট্রের ঝোঁক হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে তাকে রাষ্ট্রের একনায়কসুলভ উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্রে পরিণত করা, এবং মৌলিক স্বভাবের দিক থেকে মানুষ যেহেতু স্বাধীন, অনুসন্ধানশীল এবং নিজেকে নিখুঁত করে-তুলতে-থাকা একটি সত্তা, সুতরাং বোঝা-ই যায়, রাষ্ট্র হচ্ছে গভীরভাবে মানবিকতা-বিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান।
অর্থাৎ, সমৃদ্ধতম বৈচিত্র্য সহযোগে মানবীয় সুপ্তশক্তির পূর্ণাঙ্গ ঐকতানমূলক বিকাশের সাথে রাষ্ট্রের কার্যকলাপ ও অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত বেমানান। সুতরাং, হামবোল্ট-এবং পরের শতকে মার্কস, বাকুনিন, মিল এবং আরও অনেকে-মানুষের প্রকৃত অভীষ্ট হিসেবে যাকে বিবেচনা করেছেন তার সাথেও রাষ্ট্রের কার্যকলাপ ও অস্তিত্ব মানানসই নয়। এবং আমার মনে হয় এটা একটা যথার্থ বিবরণ।
আধুনিক রক্ষণশীলগণ যে নিজেদেরকে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের সরাসরি-বংশধর বলে ভাবতে চান-সেটা এই অর্থে। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধুমাত্র চূড়ান্ত রকম ভাসাভাসা একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এমন ভাবনায় অটল থাকা যেতে পারে।
ধ্রুপদী মুক্তিপরায়ন চিন্তনের মৌলিক ভাবধারাগুলো অপেক্ষাকৃত সতর্কভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে চাইলে কেউ সেটা দেখতে পারেন। এই চিন্তনের প্রকাশ, আমার মতে, সবচেয়ে প্রগাঢ়ভাবে ঘটেছে হামবোল্টের রচনায়।
আমার মনে হয়, এ-সব প্রসঙ্গের যথেষ্ট ব্যাপক সমসাময়িক তাৎপর্য রয়েছে, এবং খানিকটা হয়ত সুপ্রাচীন পুঁথিপত্র পাঠজনিত সংক্ষিপ্ত সফরের মতোই মনে হতে পারে, তবু যদি আপনারা কিছু মনে না করেন, প্রসঙ্গগুলো আমি একটু বিশদ করতে চাই।
রুশোর মতো, বা তাঁর আগে কার্তেসীয়দের মতো, হামবোল্টের অভিমতও এই যে, মানুষের প্রধান ধর্ম তার স্বাধীনতা।
অনুসন্ধান করা এবং সৃজন করা-এগুলোই হচ্ছে সেই সব কেন্দ্র, যাদেরকে ঘিরে যাবতীয় মানবীয় কর্মপ্রয়াস কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে আবর্তিত হয়।
কিন্তু, আরো একটু এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেন,
সমস্ত নীতিনৈতিকতাজনিত সংস্কৃতি জন্মলাভ করে একান্তভাবে এবং সরাসরিভাবে আত্মার অন্তর্জীবন থেকে। বাহ্যিক ও বানানো ফন্দিফিকির দিয়ে কখনোই তা উৎপাদন করা যায় না। যেকোনো মানুষের অপরাপর অন্তর্গত সক্ষমতার মতোই, উপলব্ধির অনুশীলনও সাধারণত অর্জিত হয় তাঁর নিজের কর্মতৎপরতা, তাঁর নিজের উদ্ভাবনী শক্তি অথবা অন্যদের আবিষ্কার কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাঁর নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে।
তো, বোঝাই যাচ্ছে, এই সব ধারণা-অনুমান থেকে একটা শিক্ষা-তত্ত্ব দাঁড় করানো যায় (এবং তিনি তা দাঁড় করান-ও বটে, যদিও সে পথে আমি যাব না), কিন্তু অন্যকিছুও দাঁড় করানো যায়। হামবোল্ট এগিয়ে যান শোষণের তত্ত্ব এবং বিচ্ছিন্ন শ্রমের তত্ত্বের অন্তত আদি-সূত্রগুলো দাঁড় করানোর দিকে, যা-আমার মনে হয়-অনেক তাৎপর্যপূর্ণ দিক দিয়েই গোড়ার দিককার মার্কসের কথা মনে করিয়ে দেয়।
স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির অনুশীলন সংক্রান্ত যেসব মন্তব্যের উদ্ধৃতি আমি দিলাম, সেগুলো আসলে এভাবে বলেছিলেন হামবোল্ট:
যে-জিনিসটা মানুষ নিজে বানায়, সেটাকে সে যতটা নিজের বলে ভাবে, তার তুলনায় যে-জিনিসটার সে মালিক, সেটাকে কখনও ততোটা নিজের বলে ভাবে না। এবং যে-ভোগবিলাসীরা বাগানের ফলমূল বেশুমার উপভোগ করেন, তাঁদের তুলনায় যে-শ্রমিক বাগানটার পরিচর্যা করেন, তিনটি সম্ভবত অনেক বেশি সত্যিকার অর্থে সেটার মালিক। আর যেহেতু খাঁটি মানবীয় কাজ হলো সেইটা, যা আসে অন্তরের তাগিদ থেকে, তাতে করে মনে হয় যেন সকল কৃষক এবং কারুকুশলীকে উন্নীত করে নেওয়া যেত শিল্পী পর্যায়ে, অর্থাৎ এমন মানুষের পর্যায়ে, যাঁরা তাঁদের শ্রমকে ভালোবাসেন শুধু শ্রমেরই খাতিরে, সেই শ্রমের উন্নতি ঘটান নিজস্ব নমনীয় প্রতিভা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার সাহায্যে এবং সেই সূত্রে অনুশীলন করেন নিজেদের মেধার, মর্যাদাবান করে তোলেন নিজেদের চরিত্রকে, আর উল্লসিত ও পরিমার্জিত করে তোলেন নিজেদের আনন্দসুখ। এরকমটা হলে মানবিকতা ঠিক সেই সমস্তজিনিসের জন্যই মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠত, যেসব জিনিস এখন প্রায়ই তার মর্যাদাহানি ঘটায়, যদিও জিনিসগুলো নিজেরা সুন্দরই বটে।
হামবোল্ট বলেছিলেন,
নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা হচ্ছে সেই অপরিহার্য শর্ত, যাকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিক মানবীয় স্বভাবের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল কর্মপ্রয়াসও কল্যাণকর কোনো প্রভাব উৎপন্ন করতে পারে না।
জিনিসটা যা-ই হোক না কেন, সেটা যদি একজন মানুষের স্বাধীন পছন্দ থেকে জন্মলাভ না-করে থাকে, অথবা সেটা যদি শুধু আদেশ-নির্দেশ ও পরিচালনা-নির্দেশনার ফলাফল-মাত্র হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তাঁর একান্ত সত্তার ভেতরে প্রবেশ করে না, বরং তাঁর প্রকৃত স্বভাব থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে যায়। তিনি এটা সত্যিকারের মানবীয় কর্মশক্তি সহযোগে সম্পাদন করেন না, সম্পাদন করেন বরং স্রেফ যান্ত্রিক নির্ভুলতা সহযোগে। কিন্তু একজন মানুষ যদি তাঁর নিজের আগ্রহ, কর্মশক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত উপায়ের বদলে বহিঃস্থ দাবি ও নির্দেশনা মোতাবেক যান্ত্রিক উপায়ে কাজ করেন, তাহলে আমরা তাঁকে বাহবা দিতে পারি বটে, কিন্তু তিনি যা সম্পাদন করেন তাকে আমরা তুচ্ছ জ্ঞান-ই করি।
হামবোল্টের মতে তাহলে, মানুষের জন্মই হয়েছে অনুসন্ধান এবং সৃজনের জন্য, এবং যখন একজন মানুষ বা একটি শিশু তাঁর নিজের স্বাধীন পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে অনুসন্ধান বা সৃজনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন, হামবোল্টের নিজের ভাষায়, ‘‘একজন শিল্পী-তিনি তখন আর উৎপাদনের যন্ত্র নন, বা সুপ্রশিক্ষিত একটি তোতাপাখি নন’’। মানুষের স্বভাব সম্পর্কে তাঁর ধারণার নির্যাস এটাই।
এবং আমার মনে হয়, এ থেকে অনেক কিছুই বোঝা যায় এবং মার্কসের সঙ্গে, মার্কসের গোড়ার দিককার পান্ডুলিপির সাথে, বিশেষত তাঁর ‘‘শ্রমের বিচ্ছিন্নতা’’ সংক্রান্ত নিচের বিবরণের সাথে তুলনা করলে, তুলনার বিচারে ব্যাপারটা খুবই কৌতূহল-উদ্দীপক হয়ে ওঠে:
শ্রমের বিচ্ছিন্নতা ঘটে তখনই, শ্রমিকের কাছে কাজ যখন বাইরে-থেকে-আসা একটা ব্যাপার, যখন কাজ তাঁর স্বভাবের অংশ নয়। এমন যে, তিনি তাঁর কাজের মধ্যে নিজেকে পূর্ণ করে তোলেন না, বরং খারিজ করে দেন নিজেকেই, এবং শারিরীকভাবে তিনি হয়ে পড়েন নিঃশেষিত আর মানসিকভাবে অধঃপতিত। এই বিচ্ছিন্ন শ্রম শ্রমিকদের একটা অংশকে নিক্ষেপ করে আবার সেই বর্বর ধরণের কাজের মধ্যে, আর বাকি অংশকে পরিণত করে মেশিনে। এভাবে মানুষকে তা বঞ্চিত করে তাঁর প্রজাতি-ধর্ম থেকে, স্বাধীন সচেতন কর্মতৎপরতা আর উৎপাদনশীল জীবন থেকে।
মার্কসের সেই সুপরিচিত ও প্রায়শ-উদ্ধৃত রচনার কথাও স্মরণ করে দেখুন, যেখানে সমাজের এমন একটা উচ্চতর রূপের কথা বলা হচ্ছে, শ্রম যেখানে জীবনের একটা উপায় মাত্র নয়, জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়াও বটে।
এবং বিশেষায়িত শ্রম সম্পর্কে তাঁর উপর্যুপরি সমালোচনার কথাও মনে করে দেখুন। বিশেষায়িত শ্রম
শ্রমিকের অঙ্গহানি ঘটিয়ে তাঁকে মানব-সত্তার একটা টুকরা-অংশে পরিণত করে ফেলে, অধঃপতিত ক’রে তাঁকে স্রেফ খুচরা যন্ত্রাংশ বানিয়ে ফেলে; তাঁর কাজকে এমন নিদারুণ যন্ত্রণায় পরিণত করে যে, কাজের আসল অর্থই ধ্বংস হয়ে যায়; আর শ্রম-প্রক্রিয়ার মধ্যেকার বুদ্ধিবৃত্তিক সুপ্ত সম্ভাবনা-গুলোকে তাঁর কাছ থেকে পৃথক করে রাখে ঠিক সেই অনুপাতে, যে-মাত্রা পর্যন্ত বিজ্ঞান একটা স্বাধীন শক্তি হিসেবে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত।
রবার্ট টাকার সঠিকভাবেই জোর দিয়ে বলেছেন যে, একজন বিপ্লবীকে মার্কস যতটা না অতৃপ্ত ভোক্তা হিসেবে দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন হতাশ উৎপাদক হিসেবে। এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের অনেক বেশি র্যাডিক্যাল এই পর্যালোচনা প্রায়শই একই ভাষায় প্রবাহিত হয় আলোকায়নের মুক্তিমুখীন চিন্তাধারা থেকেও। এই কারণে আমার মনে হয়, এ-কথা মানতেই হবে যে, নির্যাসের দিক থেকে (অবশ্য যেভাবে তা বিকশিত হয়ে উঠেছিল সেদিক থেকে নয়) ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী ভাবধারা গভীরভাবে পুঁজিবাদবিরোধী।
এই ভাবধারাকে যদি আধুনিক শিল্প-পুঁজিবাদের মতাদর্শ হিসেবে কাজ করতে হয় তবে তার এই নির্যাসকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।
১৭৮০-র দশকে এবং ১৭৯০-র প্রথম দিকে বসে লেখার সময় হামবোল্টের কোনো ধারণা ছিল না, আধুনিক পুঁজিবাদ কী রূপ ধারণ করবে। ফলে, ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের এই চিরায়ত গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার সমস্যাটির ওপর জোর দিয়েছেন, এবং প্রকাশ্যত তিনি ব্যক্তি-খাতের ক্ষমতার বিপদ নিয়ে চিন্তিত নন। এর কারণ হলো এই যে, তিনি ব্যক্তি-নাগরিকদের অবস্থার আবশ্যিক সমতায় বিশ্বাস করেন এবং তার পক্ষে কথা বলেন, এবং কর্পোরেট-পুঁজিবাদের জমানায় গিয়ে ব্যক্তির ধারণাকে কীভাবে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হবে সে-ব্যাপারে ১৭৯০ সালে লেখার সময় অবশ্যই তার কোনো ধারণা ছিল না। ‘‘তিনি এই ভবিষ্যৎ দেখতে পাননি’’, আমি এখন নৈরাজ্যবাদী ইতিহাস-রচয়িতা রুডল্ফ্ রকারের উদ্ধৃতি দিচ্ছি,
তিনি এই ভবিষ্যৎ দেখতে পাননি যে, গণতন্ত্র (আইনের কাছে সকল নাগরিকের সমতার মডেল সহকারে) এবং উদারনীতিবাদ (নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার উপর মানুষের অধিকার সহকারে) উভয়ই পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপর আছড়ে পড়ে ভেঙ্গে যাবে।
আগে থাকতে হামবোল্ট দেখতে পাননি যে, লুণ্ঠনজীবী পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ঘটানো একটা চূড়ান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য, প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। নিঃসন্দেহে আমি ইতিবাচক অর্থেই বলছি।
কার্ল পোলানির কথা বলা যায়। সুনির্দিষ্টভাবে তিনি দেখিয়েছেন:
বাজার যদি নিজে-নিজে খাপ-খাইয়ে চলতে চাইত, তাহলে তার পক্ষে সমাজের মানবীয় ও প্রাকৃতিক সারবস্ত্তকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন না-করে টিকে থাকা সম্ভব হতো না, কোনো মেয়াদের জন্যই না। এটা একদম দৈহিকভাবেই মানুষকে ধ্বংস করে দিত, আর তার পরিপার্শ্বকে বানিয়ে ফেলত ঊষর বিরাণ প্রান্তর।
আমার মনে হয় কথাটা ঠিক। শ্রমের পণ্য-চরিত্রের ফলাফলও হামবোল্ট আগে থাকতে দেখতে পান নি। মতবাদটা হচ্ছে, আবারও পোলানির ভাষায় বলা যাক,
পণ্যের পক্ষে এটা নির্ধারণ করা সম্ভব না যে, কোথায় এটা বিক্রির জন্য হাজির করা হবে, কী কাজে এটা ব্যবহার করা উচিত হবে, কী কায়দায় এটা ভোগ করা বা ধ্বংস করা উচিত হবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে পণ্যটা অবশ্যই মানব-জীবন। সুতরাং ধ্রুপদী মুক্তবাজারের অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ আটকানোর জন্য সামাজিক রক্ষাকবচ ছিল একটা নূন্যতম প্রয়োজন।
হামবোল্ট ১৭৯০ সালে এটাও বোঝেননি যে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সম্পর্ক এক প্রকার দাসত্ব-বন্ধনকে চিরস্থায়ী করে তুলেছিল, যাকে আসলে আরও বহু আগে, ১৭৬৭ সালে, সাইমন লিঙ্গুয়েট ‘‘এমনকি দাসপ্রথার চেয়েও খারাপ’’ বলে ঘোষণা করেছিলেন এই কথাগুলো লেখার মাধ্যমে:
অন্য যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য এটা একটা অসম্ভব পরিস্থিতি--যা আমাদের খামার-শ্রমিকদেরকে বাধ্য করে সেই জমি চাষ করতে, যার ফসল তাঁরা খাবেন না; এবং আমাদের রাজমিস্ত্রিদেরকে বাধ্য করে সেই ইমারত গড়তে, যার ভেতরে তাঁরা বাস করবেন না। অভাব হচ্ছে সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে ঐসব বাজারে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন প্রভুদের জন্য, যাঁরা তাঁদেরকে কেনার মতো দয়া দেখাবেন। অভাব হচ্ছে সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে বাধ্য করে ধনী লোকের কাছ থেকে তাঁকেই আরো ধনী বানানোর অনুমতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে নত হতে। দাসপ্রথার অবদমন তাঁর জন্য কার্যকর কী অর্জন এনে দিয়েছে? আপনি বলবেন, ‘সে স্বাধীন’। সেটা তার দুর্ভাগ্য।
বলা হয়ে থাকে, এসব মানুষের কোনো মালিক বা প্রভু নাই। তাঁদের আছে প্রভুদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর, সবচে কর্তৃত্বপরায়ন যে-প্রভু: সেই অভাব। এ হলো সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে সবচেয়ে নির্মম নির্ভরশীলতায় পর্যবসিত করে।
দাসত্ব-বন্ধনের ধারণার মধ্যে যদি মানব-স্বভাবের জন্য অমর্যাদাজনক কিছু থেকে থাকে (আলোকায়নের প্রত্যেক মুখপাত্র যেমনটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করে থাকেন), তাহলে তার মানে এই দাঁড়ায় যে, নতুন একটা বন্ধন-মুক্তি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে, ফুরিয়ার যাকে ইতিহাসের তৃতীয় এবং শেষ বন্ধন-মুক্তির পর্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমটা ক্রীতদাসদেরকে ভূমিদাস বানিয়েছিল, দ্বিতীয়টা ভূমিদাসদের বানিয়েছে মজুরিজীবী, তৃতীয়টা প্রলেতারিয়েতকে বানাবে স্বাধীন মানুষ: শ্রমের পণ্য-চরিত্র উচ্ছেদ করার মাধ্যমে, মজুরি-দাসত্বের পরিসমাপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে এবং বাণিজ্যিক, শিল্পভিত্তিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার মাধ্যমে।
এগুলো হচ্ছে সেই সব জিনিস, যা হামবোল্ট তাঁর উদারনীতিবাদী মতবাদে প্রকাশ করেননি এবং দেখেননি কিন্তু আমার মনে হয় তিনি হয়ত এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণই করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি অবশ্যই স্বীকার করেন যে, সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৈধ, ‘‘যদি স্বাধীনতা সেই শর্ত-পরিস্থিতিকেই ধ্বংস করে দেয়, যা না থাকলে শুধু স্বাধীনতাই নয়, খোদ অস্তিত্বই অচিন্তনীয় হয়ে পড়ে’’। আর, এটাই তো সেই পরিস্থিতি, যার উদ্ভব ঘটে অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এবং আমি তাঁর যেসব মন্তব্যেরউদ্ধৃতি দিয়েছি, সেরকমভাবে জোরের সাথে তিনি নিন্দা করেছেন শ্রমের বিচ্ছিন্নতাকে। যে-উপলক্ষেই লেখা হোক না কেন, আমলাতন্ত্র এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্র সংক্রান্ত তাঁর সমালোচনা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখদায়ক দিকগুলোর কোনো কোনোটা সম্পর্কে অত্যন্ত ভালো ভাষায় লেখা আগাম সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণযোগ্য; এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এই যে, তাঁর সমালোচনার ভিত্তিটাকে তিনি যতটা কল্পনা করেছিলেন তার চেয়ে আরও অনেক বেশি বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রেও, বিশেষত শিল্প-পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে, প্রয়োগ করা যায়।
যদিও তিনি একটা ধ্রুপদী উদারনীতিক মতবাদের অভিপ্রকাশ ঘটান, তাই বলে হামবোল্ট কিন্তু কোনো আদিম ব্যক্তিতন্ত্রবাদী নন, যেমনটা ছিলেন, ধরুন রুশো।
যে-বর্বর তার নিজের মধ্যেই বসবাস করে, রুশো তার উচ্চ প্রশংসা করেন, কিন্তু হামবোল্টের অন্তর্দৃষ্টি একদমই আলাদা। তাঁর মন্তব্যগুলোরসারকথা তিনি এভাবে পেশ করেন,
এই প্রবন্ধে উন্মোচিত ভাবধারা এবং যুক্তিমালার সামগ্রিক মর্মবস্ত্তটিকে বেশ ভালোভাবেই এই কটি কথায় বলা যেত: যখন তারা মানব-সমাজের সমস্ত শেকল ভেঙ্গে ফেলবে, তখন তারা যত-বেশি-সম্ভব নতুন সামাজিক বন্ধন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। বিচ্ছিন্ন মানুষ শৃঙ্খলিত মানুষের তুলনায় অধিকতর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না।
এবং তিনি আসলে অগ্রসর হন রাষ্ট্র বা অন্য কোনো কর্তৃত্বপরায়ন প্রতিষ্ঠানের বলপ্রয়োগ থেকে মুক্ত স্বাধীন সমিতিসমূহ নিয়ে গঠিত একটা সমাজ-সম্প্রদায়ের দিকে, যেখানে স্বাধীন মানুষ সৃজন করতে পারবে, অনুসন্ধান করতে পারবে এবং তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশ অর্জন করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে, নিজের সময় থেকে অনেক বেশি এগিয়ে, তিনি একটি নৈরাজ্যবাদী অন্তর্দৃষ্টি পেশ করেছিলেন, যা সম্ভবত শিল্পায়িত সমাজের পরবর্তী পর্যায়ের জন্যই মানানসই।
আমরা সম্ভবত এমন একটা দিনের প্রত্যাশা করতে পারি, যখন এইসব আলাদা আলাদা ধারাকে মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের সাধারণ একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা যাবে। মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র এমন একটা সামাজিক রূপ, আজকের দিনে যার অস্তিত্ব নাই বললেই চলে, যদিও এর উপাদানগুলোকে সম্ভবত অনুধাবন করা সম্ভব। অনুধাবন করা সম্ভব, যেমন ধরুন, ব্যক্তিগত অধিকারের নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, যা এত দিনে অর্জন করেছে তার পূর্ণতম বাস্তবায়ন (যদিও পশ্চিমা গণতন্ত্রসমূহে এখনও তা করুণভাবে বাধাগ্রস্থ হয়ে আছে); অথবা অনুধাবন করা সম্ভব, যেমন ধরুন, ইসরায়েলী কিববুৎজিম-এর মধ্য দিয়ে, বা যুগোস্লাভিয়ার শ্রমিক-পরিষদের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, অথবা জনসচেতনতা জাগানোর বা সামাজিক প্রক্রিয়াতে নতুন ধারার সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে, যা তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবসমূহের মৌলিক একটা উপাদান, যা আবার অস্বস্তিকরভাবে সহাবস্থান করে সমর্থন-অযোগ্য কর্তৃত্বপরায়ন আচার-অনুশীলনের সাথে।
তাহলে প্রথম এই প্রসঙ্গটার সার সংক্ষেপ করা যাক। রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রথম যে-অবস্থানটিকে আমি একটি আলোচ্য প্রসঙ্গ হিসেবে দাঁড় করিয়েছি, সেটি হল ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী অবস্থান।
এর মতবাদ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে পরিসীমিত করা উচিত, কিন্তু এই সুপরিচিত বৈশিষ্ট্যায়নখানি অত্যন্ত ভাসাভাসা গোছের। অধিকতর গভীরভাবে দেখলে, ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি মানুষের স্বভাব সংক্রান্ত একটি বিশেষ ধারণা থেকে গড়ে ওঠে। এটা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি যা বৈচিত্র্য ও স্বাধীন সৃজনের উপর গুরুত্বারোপ করে। আর এই জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গিটি শিল্প-পুঁজিবাদ, মজুরি-দাসত্ব, বিচ্ছিন্ন শ্রম এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন সংক্রান্ত উঁচু-থেকে-নিচু ক্রমবিন্যাস-কাঠামো ও কর্তৃত্বপরায়ন নীতিমালার সাথে মৌলিকভাবে বিরোধপূর্ণ। উদারনীতিবাদী চিন্তাধারা-অন্তত এর হামবোল্টীয় চেহারায়-মালিকানা-প্রবণ ব্যক্তিতন্ত্রের ধ্যানধারণারও বিরোধী, যেসব ধ্যানধারণা পুঁজিবাদী মতাদর্শের সহজাত।
ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ তাই সামাজিক শৃঙ্খল উচ্ছেদ করতে চায়, কিন্তু তার জায়গাটা পূরণ করতে চায় সামাজিক বন্ধন দিয়ে-প্রতিযোগিতামূলক লোভ দিয়ে নয়, লুণ্ঠনজীবী ব্যক্তিতন্ত্র দিয়ে নয়, আর কর্পোরেট-সাম্রাজ্য দিয়ে তো অবশ্যই নয় (তা সেটা রাষ্ট্রীয়-ই হোক, বা ব্যক্তিখাতেরই হোক)। সুতরাং, ধ্রুপদী মুক্তিপরায়ন চিন্তাধারার সাথে যখন শিল্প-পুঁজিবাদ সংক্রান্ত উপলব্ধি যুক্ত হয় তখন তা, আমার মনে হয়, সরাসরি মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের দিকে, বা আপনি চাইলে বলতে পারেন নৈরাজ্যবাদের দিকে, অগ্রসর হয়।
মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র
আচ্ছা, দ্বিতীয় যে আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই, সেটা হলো রাষ্ট্র সম্পর্কে মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকল্প। নৈরাজ্যবাদের প্রতি খানিকটা সহানুভূতিপূর্ণই বটে, এমন একজন ফরাসী লেখক একদা লিখেছিলেন, ‘‘নৈরাজ্যবাদের আছে একটা চওড়া পিঠ, কাগজ যেমন এও তেমনি, যেকোনো কিছুই সহ্য করে’’। আর নৈরাজ্যবাদের অনেক রকমফের আছে এবং তার মধ্যে মাত্র একটাই আমার বিবেচ্য বিষয়, সেটা হলো বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদ, যিনি ১৮৬৫ সালে তাঁর নৈরাজ্যবাদী ইশতেহারে লিখেছিলেন যে, ‘‘নৈরাজ্যবাদী হতে হলে প্রথমেই সমাজতন্ত্রী হতে হবে’’।
আমার আগ্রহ ১৮৮৬-র হে-মার্কেট-ঘটনার অন্যতম শহীদ অ্যাডল্ফ ফিশারের নৈরাজ্যবাদের প্রতি, যিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক নৈরাজ্যবাদীই একেকজন সমাজতন্ত্রী, কিন্তু প্রত্যেক সমাজতন্ত্রীই একেকজন নৈরাজ্যবাদী নন।
পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ একজন নৈরাজ্যবাদীকে অবশ্যই উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা করতে হবে। এই ধরণের সম্পত্তি সত্যিই চুরি, প্রুধোঁ তার সেই বিখ্যাত মন্তব্যে যেমনটি বলেছিলেন। কিন্তু পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ একজন নৈরাজ্যবাদী বিরোধিতা করবেন সরকার কর্তৃক উৎপাদন চালানোর বন্দোবস্তেরও। আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
এর মানে হলো রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র, অর্থাৎ উৎপাদনের উপর রাষ্ট্রের কর্ম-কর্তাদের হুকুম আর কারখানায় ম্যানেজার, বিজ্ঞানী, কারখানা-কর্মকর্তাদের হুকুম।
শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হলো শোষণ থেকে মুক্তি। বুর্জোয়াদের সরিয়ে সেখানে নতুন একটা শাসক-পরিচালক-শ্রেণী নিজেদেরকে বসিয়ে দিলে এই লক্ষ্য অর্জিত হয় না, অর্জন করা যায় না। শ্রমিক-পরিষদের কোনো একটা রূপকাঠামোর মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজেরা উৎপাদনের প্রভু হয়ে উঠলেই কেবল সেটা বাস্তবায়িত হতে পারে।
ঘটনাক্রমে, এসব মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে বামধারার মার্কসবাদী অ্যান্টন প্যানেকোয়েক-এর রচনা থেকে, এবং লেনিন যাকে শিশুসুলভ অতি-বামপন্থা [মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের বঙ্গানুবাদে ‘বামপন্থী শিশুরোগ’--অনুবাদক] বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই র্যাডিক্যাল মার্কসবাদ আসলে নৈরাজ্যবাদী স্রোতোধারাসমূহের সাথে একীভূত হয়ে যায়।
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমার মনে হয়।
বাম-অভিমুখীন মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রী নৈরাজ্যবাদের একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হওয়ার আরেকটা নজির দেওয়া যাক। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত এই চিত্রায়নটি সম্পর্কে ভেবে দেখুন:
রাষ্ট্রীয় মালিকানা আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিছুতে পর্যবসিত হতে পারে বলে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা মানেন না। রাষ্ট্র কেন গণতান্ত্রিকভাবে শিল্প-কল-কারখানাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তা আমরা দেখেছি। শিল্প-কল-কারখানার গণতান্ত্রিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব শুধু শ্রমিকদের দ্বারা, যাঁরা সরাসরি নিজেদের পর্যায়ের লোকজনের মধ্য থেকে শিল্প-কারখানার প্রশাসনিক কমিটি নির্বাচিত করবেন। মূলগতভাবে সমাজতন্ত্র হবে একটা শিল্পায়িত ব্যবস্থা।
এর একেকটা এলাকার নির্বাচকমন্ডলী হবে শিল্পকারখানা-মুখীন চরিত্রের। এভাবে, সামাজিক প্রশাসনের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্ব ঘটবে তাঁদের, যাঁরা সামাজিক কাজকর্মাদি এবং সমাজের শিল্পকারখানাভিত্তিক শ্রমকর্মসমূহের দায়িত্ব বহন করেন। এভাবে, কর্মদায়িত্ব-বহনকারী এবং সমাজ-সম্প্রদায়ের চাহিদা সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত মানুষজনের কাছ থেকে উৎসারিত হয়ে এ-ধরণের প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রবাহিত হবে ওপরের দিকে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক শিল্পকারখানা-কমিটি যখন বসবেন, সামাজিক কাজকর্মের প্রতিটা পর্যায়কে তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করবেন। তার মানে পুঁজিবাদী রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক রাষ্ট্রের বদলে স্থাপিত হবে সমাজতন্ত্রের শিল্পকারখানাভিত্তিক প্রশাসনিক-কমিটি।
একটা সমাজব্যবস্থা থেকে অন্য আরেকটায় উত্তরণই হচ্ছে সমাজবিপ্লব। পুরো ইতিহাস জুড়ে রাজনৈতিক রাষ্ট্র বলতে বুঝিয়েছে শাসকশ্রেণীর লোকজনদের সরকার। সমাজতন্ত্রের জনতন্ত্র (রিপাবলিক) হবে শিল্পকারখানার সরকার, যা পরিচালিত হবে পুরো সমাজ-সম্প্রদায়ের পক্ষে। আগেরটার অর্থ ছিল অধিকাংশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাধীনতা, পরেরটার অর্থ দাঁড়াবে সকলের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সুতরাং এটা হবে সত্যিকারের গণতন্ত্র।
এই কথাগুলো নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র: এর উৎপত্তি ও কাজ নামক একটা বই থেকে। বইটা উইলিয়াম পলের লেখা, ১৯১৭ সালের প্রথম দিকে। লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব-এর ঠিক আগে, যা লেনিনের সবচেয়ে মুক্তিপরায়ন রচনাকর্ম। উইলিয়াম পল বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, পরে বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁর পর্যালোচনা নৈরাজ্যবাদীদের মুক্তিপরায়ন মতধারার একেবারে হুবহু প্রায়, বিশেষত এই নীতির প্রশ্নে যে, রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত হতেই হবে, তার বদলে সমাজবিপ্লবের গতিধারায় বসাতে হবে সমাজের শিল্পকারখানাভিত্তিক সংগঠন।
প্রুঁধো ১৮৫১ সালে লিখেছিলেন, সরকারের বদলে যা আমরা বসাতে চাই, তা হচ্ছে শিল্পকারখানাভিত্তিক সংগঠন। এরকম আরো অনেক অনেক মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। নির্যাসের দিক দিয়ে, এটা হচ্ছে নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবীদের মূলগত ভাবধারা।
এরকম আরও অনেক কথার উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। তবে তার চেয়েও যেটা বেশি জরুরী সেটা হলো, স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী কর্মকান্ডে এসব ভাবধারা বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক বার, যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীতে আর ইতালিতে, ক্যাটালোনিয়ায় [স্পেনের একটি প্রদেশ] ১৯৩৬-এ।
কেউ হয়ত এই যুক্তি দেখাতে পারেন, অন্ততপক্ষে আমি তো তা দেখাবোই যে, লম্বা উদ্ধৃতিটা আমি যে-অর্থে পড়লাম সেই অর্থে কাউন্সিল কমিউনিজম হচ্ছে শিল্পায়িত সমাজে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের স্বাভাবিক রূপ। এটা অর্ন্তজ্ঞানলব্ধ এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটায় যে, শিল্পব্যবস্থা যখন স্বৈরাচারী অভিজাত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকে (সেই অভিজাতরা মালিক, ম্যানেজার, কারিগরী কলাকুশলী, ভ্যানগার্ড পার্টি, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বা অন্য যাঁরাই হোন না কেন), গণতন্ত্র তখন অনেকাংশেই একটা ছলনা। কর্তৃত্বপরায়ন আধিপত্যের এরকম পরিস্থিতিতে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী আদর্শসমূহ (মার্কস এবং বাকুনিন এবং সত্যিকারের অন্যসব বিপ্লবীরা যার প্রকাশ ঘটিয়েছেন) বাস্তবায়ন করা যাবে না; অনুসন্ধান এবং সৃজন করার মতো, নিজের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোর পূর্ণতম বিকাশ ঘটানোর মতো স্বাধীন হবে না মানুষ, মানব সত্তার একটা টুকরো হয়েই থেকে যাবে শ্রমিক-অধঃপতিত হয়ে, উপর থেকে চালানো উৎপাদন-প্রণালীর একটা যন্ত্র হয়ে।
এবং এই অর্থে বিপ্লবী মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের ভাবধারা গত অর্ধ শতকে শিল্পায়িত সমাজগুলোতে অন্তর্লীন হয়ে থেকেছে, আর আধিপত্যশীল ভাবধারা হিসেবে থেকেছে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কিন্তু গত দুই-এক বছরে কৌতূহল জাগানোর মতো পুনরুত্থান ঘটেছে।
অ্যান্টন প্যানেকোয়েকের যে-প্রতিপাদ্যটি থেকে আমি উদ্ধৃতি দিলাম, সেটা আসলে নেওয়া হয়েছে ফরাসী শ্রমিকদের র্যাডিক্যাল একটা গ্রুপের প্রচার-পুস্তিকা থেকে। আর বিপ্লবী সমাজতন্ত্র সম্পর্কে উইলিয়াম পলের উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে ওয়াল্টার কেন্ডলের একটা প্রবন্ধ থেকে। গত মার্চে ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে অনুষ্ঠিত শ্রমিক-কর্তৃত্ব সংক্রান্ত জাতীয় সম্মেলনে এটি পড়া হয়েছিল। ফরাসী ও ইংরেজ এই উভয় গ্রুপই গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষত গত কয়েক বছরে ইংল্যান্ডের শ্রমিক-কর্তৃত্ব-আন্দোলন, আমার মনে হয়, গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
যেমন ধরুন, সবচেয়ে বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কয়েকটা এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। সম্মিলিত প্রকৌশল ফেডারেশন [সম্ভবত ‘সম্মিলিত প্রকৌশল ইউনিয়ন’], আমার মনে হয় এটা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন, এসব মূলনীতিকে তাদের ভিত্তিগত ভাবধারা হিসেবে গ্রহণ করেছে। ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো সম্মেলন করেছে তারা, যা থেকে বেরিয়ে এসেছে আগ্রহ-জাগানিয়া পুস্তিকা-সাহিত্য এবং [ইউরোপ] মহাদেশে একই রকমের ঘটনা আরো আছে। ফ্রান্সে ও জার্মানীতে কাউন্সিল কমিউনিজম এবং সমজাতীয় ভাবধারার প্রতি এবং মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের অন্যান্য রূপকাঠামোর প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে ফ্রান্সের মে-১৯৬৮ নিশ্চয়ই আরো বাড়িয়েছে, যেমনটা তা বাড়িয়েছে ইংল্যান্ডেও।
অতিরিক্ত মতাদর্শায়িত আমাদের এই সমাজের মোটের উপর রক্ষণশীল ছাঁচের কারণে এটা খুব বিস্ময়কর নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসব ঘটনার স্পর্শ লাগেনি।
কিন্তু সেটাও বদলে যেতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধের ক্ষয়ে যাওয়াটা এসব প্রসঙ্গের কোনো কোনোটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাকে অন্তত সম্ভব করে তুলেছে। আর নিপীড়ণের বর্তমান ঢেউকে যদি ফিরিয়ে দেয়া যায়, পরাভূত করা যায়, বামরা যদি তাঁদের অধিকতর আত্মহত্যাপ্রবণ ঝোঁকগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং বিগত দশকের অর্জনগুলোর উপর নির্ভর করে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে সমাজ-সম্প্রদায়ে ও কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সহকারে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পথে শিল্পায়িত সমাজকে গড়ে তোলার সমস্যাটাই সমসাময়িক সমাজের সমস্যাসমূহ সম্পর্কে যাঁরা সচেতন তাঁদের কাছে প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসঙ্গ হয়ে উঠবে। আর, বিপ্লবী মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের জন্য গণআন্দোলন যখন গড়ে উঠবে, আমার প্রত্যাশা সেটাই ঘটবে, অনুমান তখন কাজের দিকে অগ্রসর হবে।
আমি যেমনটা করেছি, সেভাবে বাম-মার্কসবাদ ও নৈরাজ্যবাদকে লাল রঙে ছাপানো একই শিরোনামের অধীনে একত্র করাটাকে কারো কারো কাছে উচ্চ-অথচ-অলীক আদর্শের অনুগামী কাজ বলে মনে হতে পারে, কেননা গত শতাব্দী জুড়ে মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে বজায় ছিল বৈরিতা, যার সূত্রপাত ঘটে একপক্ষে মার্কস ও এঙ্গেলস এবং অন্য পক্ষে, ধরা যাক প্রুঁধো ও বাকুনিনের মধ্যকার বৈরিতা দিয়ে।
অন্ততপক্ষে উনবিংশ শতকে রাষ্ট্র প্রশ্নে তাঁদের পার্থক্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু এক অর্থে সেটা ছিল কৌশলগত। নৈরাজ্যবাদীদের ছিল এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, পুঁজিবাদ এবং রাষ্ট্রকে একই সঙ্গে ধ্বংস করতে হবে। এঙ্গেলস ১৮৮৩ সালের এক চিঠিতে এই ভাবধারা প্রসঙ্গে তাঁর বিরোধিতা প্রকাশ করেছিলেন:
নৈরাজ্যবাদীরা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।