আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভবিষ্যতের চোর

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। ভবিষ্যতের চোর মোহাম্মদ ইসহাক খান আমি একজন চোর। "চোর" না বলে "কৌশলী" বলাই ভাল, কারণ আজকালকার চুরিতে এমন সব টেকনোলোজি আছে যে এটাকে চুরি বললে ঠিক মানায় না।

তাছাড়া "চোর" শব্দটাতেই কেমন একটা চোর-চোর ভাব আছে; আমার লাইনের অনেকে তো "চোর" শব্দটিকেই অসম্মানজনক বলে মনে করে! কথা কম, কাজ বেশি। আজ রাতে আমি কী করবো সেটা খুলে বলি। টাকাপয়সা চুরি করে ছিঁচকে চোরেরা। আমি ছিঁচকে চোর নই, ছোটখাটো চুরি করা আমার পক্ষে মানহানিকর। কাজেই আমি টাকা চুরি করবো না, স্টেট ব্যাংকের অধীনস্ত টাকশালে যে টাকা তৈরি হয়, সেগুলোর ছাঁচ চুরি করে নিয়ে আসবো।

তারপর আর টাকা রোজগার করতে হবে না, নিজেই টাকা "তৈরি" করে নিতে পারবো। এতদিন ধরে কেন যে এই বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি, ভেবেই পাই না। এতদিনে বিলিয়নেয়ার হয়ে যেতে পারতাম। গত দু'রাত খেটে আমি প্ল্যান ফাইনাল করেছি। কোন ভুলচুক নেই।

অতন্দ্র প্রহরী, সতর্ক ক্যামেরা- সবকিছুই আমার মাস্টার প্ল্যানের সামনে কুপোকাত, দাঁড়াতেই পারবে না। চলুন, কথা না বাড়িয়ে কাজে যাওয়া যাক। এই গল্পের নায়ক আমি, কাজেই সম্পূর্ণ ক্রেডিট আমার। আজকালকার চোরেরা সহকারী সাথে রাখে না, তার দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ, চোরের সহকারীও একজন চোর, তাকে আর যা-ই হোক, বিশ্বাস করা চলে না।

দ্বিতীয় কারণ, অনেক কষ্ট করে চুরি করে আনা জিনিসের ভাগ অন্য কাউকে দিতে কোন চোরই পছন্দ করে না। *** নিশুতি রাত। আমি টাকশালের গেটের বাইরে ঘাপটি মেরে বসে আছি। ওদের কাঁটাতারের বেড়া ইলেক্ট্রিফায়েড, আমি ভাল করেই জানি। কাজেই আমি প্রথমেই আমার বিশেষ গ্লাভস পড়ে নিলাম, এতে আমার গায়ে শক লাগবে না, আবার কোন বিদ্যুৎ ঝিলিকও দিয়ে উঠবে না।

আমি সাপের মতো নিঃশব্দে কাঁটাতারের বেড়া বেয়ে উঠে গেলাম, ভেতরে লাফিয়ে পড়লাম। ধুপ করে একটা আওয়াজ হল। এই কম্পাউন্ডটার প্রতি বর্গ-ইঞ্চি জায়গা মনিটর করে সব মিলিয়ে একশো আটটি ক্যামেরা, ওগুলোকে ফাঁকি দিয়ে একটা মাছিরও সাধ্য নেই ঢোকে। কিন্তু আমি কী করে সশব্দে এখানে ঢুকে পড়লাম, কোন অ্যালার্ম বেজে উঠলো না, এই তো? আমি বেশ করুণার দৃষ্টিতে তাকালাম আমার দিকে তাকিয়ে থাকা সবগুলো ক্যামেরার চোখের দিকে, প্রত্যেকটি ক্যামেরা নিশ্চল, মাথার ওপর লাল বাতিগুলো জ্বলছে না। ঢোকার আগেই যে আমি ক্যামেরাগুলো দূর থেকে বিকল করে দিয়েছি, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

এবার মেইন বিল্ডিঙয়ের সামনে এসে হাজির হলাম। তালপাতার সেপাইয়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুটো প্রহরী রোবট, হাতে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র। আমি দিব্যি ওগুলোকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম, কোথায় কে আছে না আছে আমার জানা আছে, গত দু'দিনে মুখস্ত করে ফেলেছি। শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে যন্ত্রমানবগুলোকে একটা নিশ্চল পুতুল বানিয়ে দেয়া আমার কাছে কোন ব্যাপারই না, বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের কাজ। লেজার রশ্মি দিয়ে জায়গাটা একেবারে সেগুলোর রাখা আছে, সেগুলোর ওপর পা কিংবা শরীরের যেকোনো অংশ স্পর্শ করলেই বেজে উঠবে বার্গলার অ্যালার্ম।

কিন্তু আমি অনেক আগেই সেগুলো অচল করে দিয়েছি, বলাই বাহুল্য। আমি গলিঘুপচি পেরিয়ে, সব বাধা উপেক্ষা করে ঈপ্সিত জায়গায় পৌঁছলাম। এই দরজাটা খুলে ঢুকতে পারলেই কেল্লা ফতে, এই ঘরেই রাখা আছে টাকার ছাঁচগুলো, নিয়ে কেটে পড়তে পারলেই ... ... আমি সুরুৎ করে মুখে লোল টেনে নিলাম। দরজা ভেঙে ঢোকে ডাকাত। আমি ডাকাত নই, আমার নীতিমালায় আছে, কায়দা করে দরজা খুলে ঢুকতে হবে, দরজা ভাঙা চলবে না।

চোর হলেও আমার নীতি আছে, অনেক ভালোমানুষেরও যেটা নেই। তবে দরজা চুরি করতে এলে ভিন্ন কথা, তখন তো কব্জা ভাঙতেই হবে। কিন্তু এ কী? দরজাটা খুলছে না কেন? আগেই নিশ্চিত হয়ে নিয়েছি দরজাটায় কোন বুবি ট্র্যাপ নেই, হাত দিলেই প্যাঁ প্যাঁ শব্দ করে পুরো তল্লাট মাথায় তুলবে না। সব কায়দা খাটানোর পরেও যখন দরজা নড়ল না, তখন কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলাম, খামচি মারলাম, এমনকি গোটা কয়েক কামড়ও দিলাম, কিন্তু উঁহু, কোন কাজ হল না। দরজাটা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

আমি আমার সব আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করলাম, ভাবতে ভাবতে কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুনোর উপক্রম, হাঁপিয়ে গেলাম, কিন্তু হতচ্ছাড়া দরজাটা খোলার কোন রাস্তাই দেখতে পেলাম না। তবে কি আমার মতো একজন জগদ্বিখ্যাত চোর চুরি করতে এসে খালি হাতে ফিরে যাবে? লোকে শুনলে বলবে কী? আমার এতদিনের পসার তো সব ধুলোতে মিশে যাবে। বেশীক্ষণ ভাবার সময় পেলাম না, কারণ করিডোরে ভারী পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। এক জোড়া নয়, অনেক জোড়া পায়ের আওয়াজ। আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।

মানুষজন টের পেয়ে গেছে, এখন এদিকে আসছে। এখানে বুদ্ধুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলে গণধোলাই খেতে হবে, এই পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে সেটা খুব সুখকর হবে না। আমি প্রাণ রক্ষার্থে জীবনে এই প্রথম চুরি করতে গিয়ে চুরি না করেই ফিরে এলাম। আমি চোর হই আর যা-ই হই, খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বেঁচে থাকলে অনেক চুরি করা যাবে।

এখনো বিয়ে-শাদী করিনি, মনের মতো কোন "চুন্নী" পাই নি। এখনই পাবলিকের ধোলাই খেয়ে মরা মোটেই ঠিক হবে না। *** আমার "চুরিবিদ্যার ইতিহাসবেত্তা" বন্ধু ছবিটা দেখে হেসেই খুন। আমি বোকার মতো বসে আছি, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। সে হাসতে হাসতে বিষম খেলো, তারপর ঢকঢক করে এক গেলাস পানি গিলে বলল, তোর এই কাহিনীটা শুনে এত মজা পেয়েছি, বলার মতো নয়।

তুই তো সব চোরকে হাসাবি রে। আমি রেগে যাই। আমি এসেছি একটা গুরুতর সমস্যা নিয়ে, সমাধান না দিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসার কী আছে? বন্ধুর মাথায় একটা "বিরাশির দশ আনা ওজনের চাঁটি" মারার পর তার সম্বিৎ ফিরে আসে। সে বলে, ছবিটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখ্‌। আমি তাকাই।

একেবারে খালি হাতে আসি নি আমি, দরজাটার ছবি তুলে নিয়ে এসেছি। দ্যাখ্‌, দরজাটার ছিটকিনিতে কী লাগানো আছে? বন্ধু আবার জিজ্ঞেস করে। এটাই তো সমস্যা করলো। এই আঙটার মতো কিম্ভূত জিনিসটা কী রে বাবা? এটাকে বলে তালা। তালা? সেটা আবার কী বস্তু? আরে গাধা, চুরিবিদ্যার ইতিহাস ভাল করে পড়লে দেখবি, প্রাচীন কালে মানুষ চোরের হাত থেকে রেহাই পেতে এই জিনিসটা ব্যবহার করতো।

একটা লম্বা কাঠি এটার তলায় ঢুকিয়ে মোচড় দিলেই খুলে যায়, সেই কাঠিটাকে বলে চাবি। চাবি? হ্যাঁ, চাবি। যেকোনো ধরণের তালা খোলার জন্য সব চোরের কাছে একটা মাস্টার কী থাকতো। এখন আর তালাচাবি কেউ ব্যবহার করে না। স্টেট ব্যাংকের ব্যাটাদের বুদ্ধি আছে বলতে হবে, তোর মতো আধুনিক চোর কখনো তালা খুলতে শেখে না, তারা শেখে আধুনিক চৌর্যবৃত্তির কৌশল, সাড়ে তিনশো ক্রেডিটের কোর্স।

তালা খোলার ব্যাপারটা চুরিবিদ্যার সিলেবাস থেকে অনেক আগেই আউট হয়ে গেছে। আমি মাথা চুলকোই। আমি জন্মেছি মাত্র উনত্রিশ বছর আগে, চুরি করতে করতে যা কিছু শিখেছি সব এ কালের। আমি কী করে জানবো যে প্রাচীন কালের মানুষ এত সাবধানী ছিল, নিরাপত্তার জন্য লেজার রশ্মির ফাঁদ, সারভেইলেন্স ক্যামেরা কিংবা ইলেক্ট্রিফায়েড ফেন্স, ডিজিটাল পাসওয়ার্ড, রেটিনা স্ক্যান, ভয়েজ রিকগনিশন - এসবের কিছুই ব্যবহার করতো না, ব্যবহার করতো একটা তালা? মামুলি, নগণ্য তালা? সেই পদ্ধতি পাঁচশো বছর পর একটা স্টেট ব্যাংক ব্যবহার করবে, তা-ই বা কী করে জানবো? আমার মতো মহা-মহোপাধ্যায় চোর পর্যন্ত সে তালা খোলার কোন রাস্তাই চিন্তা করতে পারেনি। নিজেকে অনেক বড় চোর ভাবতাম, কিন্তু এখন দেখছি, চোর সমাজে মুখ দেখানোর আর যো রইলো না।

আমি চোরদের কলঙ্ক। (২৯ নভেম্বর, ২০১২) ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।