আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা আঁতুর ঘর/৫



গত বর্ষায় এসেছিলাম । আবার শুরু হয়ে গেল এইবারের বর্ষা । এরমধ্যে শেষ হয়ে গেল আমাদের ফাইনাল পরীক্ষাগুলো । বাড়ি ফেরার জন্য সবারই মন ছট্‌ফট্‌ করছে । আমরা যারা কোর্স শেষ করার পর চাকরি পাব ভেবেছিলাম তাদের আশা পূরণ হলোনা ।

যদিও অফিস থেকে বলা হয়েছে অপেক্ষা করার জন্য । নিজের খরচে হোস্টেলের বাইরে থেকে যাওয়ার জন্য । কেউ কেউ দল বাঁধছে থাকার জন্য । কিন্তু আমার ইচ্ছা নেই । আমার মনে সাধ জেগেছে ফিরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার ।

মেজদাও তাই লিখেছে । এদিকে চাকরি কিছু হচ্ছে, তবে তা সব ড্রাইভারের চাকরি । সি আর পি'র ড্রাইভার । সি আর পি' মানে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ । কেউ কেউ ঢুকেও গেল ।

যেহেতু আমরা যারা অটোমোবাইল গ্রুপের তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক । আর এক্ষেত্রে তাই কাজে লেগে গেলো কারো কারো । এই সি আর পি' পশ্চিম বঙ্গে নক্সাল আন্দোলন দমন করার কাজে পরবর্তীতে খুব কুখ্যাত হয়ে উঠে । যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ এই কাজ নিয়েছিলো একান্ত দারিদ্রের কারণে । ইতিমধ্যে আমাদের রেলওয়ে ওয়ারেন্ট এবং ক্লিয়ারেন্সের কাগজ পত্র ধরিয়ে দেওয়া হলো ।

মানা ক্যাম্পের বাজারে আমাদের অন্তিম আড্ডাগুলো তখনও চলছে । তারমধ্যে শোনা যাচ্ছে কয়েকজন নাকি ইচ্ছে থাকলেও ফিরতে পারবেনা । কারণ তারা যে সব কিশোরীদের সংগে মন দেয়া নেয়া করেছে তাদের এখানে রেখে যাওয়া চলবেনা । সংগে করে নিয়ে যেতে হবে । অর্থাৎ বিয়ে করতে হবে ।

ক্যাম্পের অভিবাবক, মাতব্বররা এনিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে । এনিয়ে বেশ একটা অরাজকতা । রাতবিরেতে হোস্টেল থেকে প্রেমিকদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মেয়েদের বাড়িতে । সেখানে শলা পরামর্শ করে ঠিক করা হচ্ছে কিংকর্তব্য । আমরা প্রথম প্রথম বিষয়টাতে মজা পেলেও পরে দেখছি যে এবিষয়ে আই টি আই কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই ।

শেষ দুদিন বাইরের লোক অবাধে আমাদের ঘরে ঘরে যাতায়াত করছে যা আগে করেনি । সামান্য হলেও সম্পুর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় আমাদেরও এক ধরণের ভয় হতে লাগলো । আসলে এই ক্যাম্পবাসীরা এই খানে সরকারী সাহায্যে খেয়ে পরে আছে বটে কিন্তু তাতেত আর একটা সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ রূপে পাওয়া যায়না । বিশেষ করে যাদের ঘরে মেয়ে আছে । এখানে মেয়েদের নিয়েই হয়েছে সমস্যা ।

জেনে শুনে অবাঙালীর সংগেত আর বিয়ে দেয়া যায়না । কিন্তু বাঙালী উপযুক্ত ছেলে কই । থাকলেও তা এতই সামান্য যে তা দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান হয়না । অবাঙালী বেষ্টিত এই সব ক্যাম্পবাসীদের পক্ষে নিজেদের এই সামাজিকতার দায় মেটানো খুবই কষ্টকর । ফলে এই ধরণের সুযোগ কেউই হারাতে চায়না ।

যেন আমরা না পারি মেয়েটাকেতো বাংলার কোনো ঘরে বিয়ে দিয়ে পাঠানো গেলো । বাংলার পরিবেশে অন্ততঃ জীবনটা কাটাতে পারবে ভাগ্য ভালো থাকলে । তাছাড়া বাঙালী হিসেবে উদ্বাস্তু হয়ে প্রত্যকেরইত প্রথম পছন্দ ছিলো পশ্চিমবঙ্গ । কিন্তু সরকারী নীতি বা সামাজিক চাপ, যে কোনো কারনেই হোক তা সবার ভাগ্যে জোটেনি । ঘর ছাড়া , দেশ ছাড়া এইসব বাঙালীরা একসময় প্রাণে বাঁচলেও পরবর্তীতে বাঙালী হিসেবে তাদের আর বেঁচে থাকা হলো কিনা কে জানে ! এক/দুই প্রজন্মের মধ্যেই দেখা গেছে তারা এমন এক প্রবাসী বাঙালী হয়ে গেল যে তারা বাঙলা ভাষাটাও হারিয়ে ফেলতে লাগলো ।

প্রথমে দেখেছি পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের প্রতি তাদের একটা নীরব অভিমান । পরে সেটার ভেতর ক্রোধেরও প্রকাশ দেখেছি । দেশ ভাগের বিষফল বাঙালীরা যে ভাবে পেয়েছে ভারতের আর কারোর এই দশা অন্ততঃ হয়নি । পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু বলে তাদের ত্রিপুরা আসাম প:বঙ্গ আন্দামান বিহার উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ উড়িষ্যা এমনকি মহারাস্ট্রেও তাদের ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়তে হয়েছিলো । আর এই ছড়িয়ে পড়তে গিয়ে রুগ্ন পাখির মতো তাদের ডানা থেকে ক্রমশঃ পালক আর প্রাণশক্তির কত যে অপচয় ঘটেছে তার হিসেব কোনো বঙ্গবাসীর কাছে আছে কিনা আমার জানা নেই ।

আমাদের ট্রেডের যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিক ক্যাম্পের বন্ধনে বাঁধা পড়তে চলেছে । বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগের রাতে তা নিয়ে আমরা বেশ হৈ চৈ করলাম । যজ্ঞেশ্বর খুশি । তার বাড়িতে খবর গেছে । তার বাবা মা আত্মীয় স্বজন আসছে ।

ছেলে বৌমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য । এদিকে যজ্ঞেশ্বর সেই ড্রাইভারের চাকরিটা পেয়ে গেছে । এটা নিয়েও ভাবছে । সে আর আমাদের সংগে ফিরছেনা । আজ দুপুরের লাঞ্চটাই আমাদের এখানে শেষ লাঞ্চ ।

একসময় সেই ছাউনি দেয়া মিলিটারি ট্রাক এসে হোস্টেলের সামনে দাঁড়ালো । রায়পুর রেল স্টেশনে আমাদের পৌঁছানোর জন্য । আমরা যে যার মতো তাতে উঠে পড়লাম । একটু একটু বৃষ্টিও হচ্ছে । একপাশে যেখানে আমাদের বড় বড় জলের ট্যাংকগুলো ছিলো, যেখানে আমরা গরমে কাতর হয়ে আশ্রয়ও নিতাম,- আজ লক্ষ্য করলাম যজ্ঞেশ্বর সেখানে একটি মেয়ের সংগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ।

কেউ কেউ বললো এইতো এ-ই যজ্ঞেশ্বরের বউ । ট্রাকটা ঘুরে তাদের পাশ দিয়েই বেরিয়ে গেল আমাদের নিয়ে । (ক্রমশঃ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.