কেবলই নিজেকে খুঁজছি
এক
`জাত গেল জাত গেল বলে
এ কি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তানা না না।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
এক জলেই সব হয় গো সুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো তাকেও ছাড়বে না।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এ ভ্রম তো গেল না।
চৈত্রের গনগনে দুপুরের বাতাসে গানের সাথে একতারার সুর মিলিয়ে গেলে চোখ খুললেন গহর ফকির।
সামনে এসে বসেছে শর্বরীর আট বছরের ছেলে দীপ। গহর ফকির শুভ্র দাড়ি-গোঁফের ফাঁক গলে মৃদু হেসে বললেন, কেমন আছিস দাদুভাই, মা কই?
ঘরে। বারান্দার খুঁটিতে পিঠ ঘষতে ঘষতে বললো দীপ।
গহর ফকির হাত বাড়িয়ে ডাকলেন, কাছে আয়।
দীপ কাছে গিয়ে বসলো।
অনুমতির অপেক্ষা না করে একতারাটি কোলের ওপর তুলে নিল। কচি আঙুল দিয়ে টুং টাং করে শব্দ করতে লাগলো একতারার তারে। গহর ফকির ঝোলা থেকে দুটো আতা বের করে দীপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটা তোর। আরেকটা দিদির।
দিদি তো স্কুলে।
চটজলদি একতারাটা নামিয়ে আতা দুটো হাতে নিয়ে বললো দীপ।
দিদি স্কুল থেকে ফিরলে দিবি।
ঘাড় নাড়লো দীপ। আতা দুটো পাশে রেখে আবার একতারাটা কোলে তুলে কচি আঙুল চালাতে লাগলো একতারার চুলে।
ভেজা কাপড় হাতে ঘর থেকে বের হলো শর্বরী।
মাথার চুল ভেজা গামছায় বাঁধা। সদ্যস্নাত গৃহস্থ বধুর মুখে উপচে পড়া স্নিগ্ধতা। গহর ফকিরের দিকে তাকিয়ে শর্বরী হেসে বললো, এতদিন কোথায় ছিলেন কাকা?
মন বড় টানছিলো রে মা। তাই শাঁইজির আখড়ায় গিয়েছিলাম। অনেকদিন ছিলাম।
কাল এসেছি। বললো গহর ফকির।
শর্বরী উঠোনের তারে কাপড় মেলতে মেলতে বললো, দীপ, তেলের বোতলটা দে তো দাদুকে। কাকা স্নান করে আসেন। আপনার পছন্দের লাউয়ের ডাটা-পাতার ঝোল রান্না করেছি।
গহর ফকির বললো, তুই কি আগের জন্মে আমার মা ছিলি? কেমন করে বুঝলি আজ আমি আসবো!
শর্বরী হেসে বললো, আমি আপনার মা-ই তো। সকালে আপনার ছেলে বলছিলো অনেকদিন কাকা আসে না। গানও শোনা হয় না। তাই আপনার কথা মনে হতেই কি মনে করে লাউয়ের ডাটা-পাতা রান্না করলাম।
ধুতির খোঁটে চোখ মুছে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটা দেন গহর ফকির।
সংসারে তাঁর কেউ নেই। নিঃসন্তান তিনি। স্ত্রী মারা গেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। এখন তাঁর বয়স নব্বই। এতগুলো বছর একা কাঁটিয়েছেন।
স্ত্রী মারা যাবার পর আর বিয়ে করেননি। স্ত্রীকে বড় ভালবাসতেন তিনি। এখন মৃত স্ত্রীর স্মৃতি আর লালনের গান আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন।
এই নব্বই বছর বয়সেও তিনি মোটামুটি শক্ত-সমর্থ। তবে আগের মতো আর নিয়মিত বের হন না।
যখন আর ঘরে খাবার মতো কিছুই থাকে না তখন বের হন। সকালে নিজেই রান্না করে খেয়ে কাঁধের ঝোলা আর একতারাটা নিয়ে বের হন। গ্রামের পর গ্রাম লালনের গান করেন। যে যা দেয় হাসিমুখে তাই গ্রহণ করেন। মানুষের ভাল মুখ, কালো মুখ সবই তিনি হাসিমুখে বরণ করে নেন।
মানুষের সম্পর্কের শিকড় কখন, কিভাবে, কোনদিকে ধাবিত হয় নিজের অজান্তে তা বোঝার উপায় নেই। জগতে মানুষের অভাব নেই। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে মানুষের অভাব নেই। কিন্তু সব মানুষকে সবার ভাললাগে না। মানসপটে সব মানুষের স্থান হয় না।
অনেক সময় কাছের কাউকে সহ্য হয় না। আবার অনেক সময় দূরের অচেনা মানুষও মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নেয়। একেই বুঝি বলে মায়া! কখন যে মায়ার সুতো মানুষকে জড়িয়ে ধরে, আর কখন যে সুতো কেঁটে যায় তা মানুষ ঠিক মতো বুঝতেও পারেনা। নইলে কোথাকার কোন গহর ফকির এই বটেশ্বরের শর্বরীর গৃহে স্নানাহার করবে কেন? আরো তো কতো গ্রাম আছে, কতো বাড়ি আছে, কতো মানুষ আছে। কতো বড় বড় ধনীর গৃহ আছে।
তাদের বাড়িতে কতো রকমারি খাবারের আয়োজন। দুটো খেতে চাইলে হয়তো না-ও করবে না। কিন্তু সব বড় বড় পাকা ঘরবাড়ি ফেলে এসে বটেশ্বরের এই কাঁচা গৃহের বারান্দায় বসে শর্বরীর হাতের লাউপাতার ঝোল কেন খাবেন গহর ফকির। কেন শর্বরীকে বলবেন, আগের জন্মে তুই কি আমার মা ছিলি! এই ভালবাসার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে নিয়মের বাইরেও কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আত্নীয়তার বন্ধন হয়, ভালবাসার জন্ম হয়।
পুকুর থেকে স্নান সেরে এসে বারান্দার এক কোনে বসে পড়লো গহর ফকির। অনেকটা লালন ফকিরের মতোই শুভ্র দাড়ি-গোঁফ, চুল। শুধু গহর ফকিরের চুলগুলো লালন ফকিরের মতো লম্বা নয়। কাঁধ পর্যন্ত। শর্বরী ভাত নিয়ে আসে।
সাথে লাউপাতার ঝোল, সজনে ডাটা চচ্চরি আর পুটি মাছের ঝোল।
দাদুভাই খেয়েছে? জিজ্ঞাসা করেন গহর ফকির।
হ্যাঁ খেয়েছে। একটু থেমে শর্বরী বললো, এই দুপুরের রোদে আর বের হবেন না কাকা। খেয়ে কাছাড়ী ঘরে ঘুম দেন।
বিকেলে যাবেন।
তাই করবো। তোর কথার অবাধ্য হই কেমনে! আমার আর কিছু লাগবে না। যা তুই খেয়ে নে।
শর্বরী চলে গিয়ে একটু পর আবার একবাটি দুধ নিয়ে ফিরে আসে।
দুধ দেখেই গহর ফকির বললো, আবার দুধ কেন রে?
কালো গাইটা এই প্রথম বিয়েলো। দুধ ভালই হয়।
কি বাছুর হয়েছে?
বকনা বাছুর।
যাক ভাল হয়েছে। পাল বৃদ্ধি পাবে।
বিকেলে রোদের তেজ কমলে বের হন গহর ফকির। সকালে গাইতে গাইতে ঘর ছাড়া, আবার বিকেলে গাইতে গাইতে ঘরে ফেরা।
দুই
সেই কত বছর আগে যৌবনে লিয়াকত শাঁই নামে লালন ফকিরের এক শিষ্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তার কাছেই লালনের গানের হাতেখড়ি। অনেক দিন ঘরছাড়া হয়ে তাঁর সাথেই ঘুরে বেরিয়েছেন।
মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন। আবার দেশান্তরি হতেন। শেষে মা-বাবা ছেলেকে ঘরমুখী করতে বিয়ে দিলেন। যাতে ছেলে সংসারে মন দেয়। কিন্তু কোথায় কি! যার ভেতরে বৈরাগ্যের বাসা।
নিরন্ন বাউলের সংসার। তাকে কি আর চাইলেই বিয়ে দিয়ে সংসারী করা যায়! ঘরের বউ ঘরেই থাকে। কিন্তু গহরের আর দেখা নেই। দিন যায়, রাত যায়। এমনিভাবে সপ্তাহ, মাসও যায়।
আবার কোন এক রাতে ফিরে আসে। অভিমানী বধুর অভিমান ভাঙায়। স্বামীর বুকে কাঁদতে কাঁদতে বধুর অভিমান ভাঙে। সেই রাতে বধু আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দেয় গহরকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেবা-যত্ন করে।
বধুটি ভাবে এমনি ভালবাসা দিয়ে যদি তাকে আঁচলে বেঁধে রাখা যায়! কিন্তু বাউলের কি আর সংসারের এত ভালবাসা সয়। আবার পাখি উড়াল দেয়।
এই আসা-যাওয়ার মাঝেই দিন কাঁটতে থাকে। সময়ের আবর্তে মা-বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। স্ত্রী ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই।
কোন সন্তান হয়নি। তবু অভাবের সংসার। সামান্য একটু জমির ফসলে দুজনের সংসার কোন মতে কাঁটে। স্ত্রী কত বোঝায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা টিপ্পনী কাটে।
কোন কিছুই গায়ে মাখে না গহর। মাঝে মাঝে উধাও হলেও স্ত্রীকে খুব ভালবাসে গহর। স্ত্রীর অসুখ হলে তার কাছ ছাড়া হয় না কখনও। সেবা-যত্ন করে। রান্না করে নিজে খায় স্ত্রীকে খাওয়ায়।
একবার স্ত্রীকে বলেই লালনের আখড়ায় গেল বাৎসরিক উৎসবে। ফিরে এলো দিন সাতেক পরে এক রাতে। বাড়ি ফেরার সময় রাস্তা দিয়ে খালি গলায় গান গাইতে গাইতে আসে গহর। গান শুনে হারিকেন নিয়ে রাস্তায় এগিয়ে যায় স্ত্রী। এবারও গান গাইতে গাইতে বাড়ির ভিতরে চলে এলো।
তবু হারিকেন নিয়ে এগিয়ে এলো না স্ত্রী। কোন সাড়াশব্দ নেই। বারান্দায় উঠে গহর বললো, কই ঘুমালে নাকি? কোন সাড়া নেই। দরজায় তালা ঝোলানো। ভাবলো বাবার বাড়ি গেল নাকি? কিন্তু কোনদিন তো বাড়ি খালি রেখে বাবার বাড়িতে যায় নাই।
গহরের গানের সাড়া পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে হারিকেন হাতে এগিয়ে এলো ফরিদা ভাবী আর জামাল ভাই। ওরা কাছে আসতেই বারান্দা থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করলো গহর, ও কোথায় গেছে ভাবী?
ফরিদা ভাবী চুপ করে থাকে। জামাল ভাই হারিকেন নিয়ে একটু এগিয়ে আঙুল দিয়ে দেখায় পেয়ারা গাছের নিচে মাটির টিবি।
তিন
এতদিন ঘুড়ি আকাশে উড়তো ঠিকই কিন্তু নাটাইয়ের টানে এক সময় ফিরে আসতো। নাটাই যেদিন সুতো কেঁটে দিল সেদিন থেকেই আর ঘরে ফেরার তাড়া নেই।
কোন সুতোর বন্ধন নেই। সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি দক্ষিণের বাতাসে উত্তরে যায়, উত্তরের বাতাসে দক্ষিণে। আগে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় মন কেমন করে উঠতো ঘরের জন্য। তখনই ফিরতো ঘরে। এখন আর ঘরের জন্য মন কেমন করে না।
বরং ঘরে ফিরলেই ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। কতবার বাড়ি ফিরে এসে দেখেছে বৈশাখের ঝড়ে ঘর দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেছে। চালের টিনের কোন খোঁজ নেই। অথবা জামাল ভাই মাঠ থেকে টিনগুলো কুড়িয়ে এনে রেখে দিয়েছে। আবার নিজেই প্রতিবেশীদের সাহায়্যে ঘরটা দাঁড় করেছে।
ঘর তুলে দিয়ে ফরিদা ভাবী, জামাল ভাই এবং অন্য প্রতিবেশীরা আবার বিয়ে করার জন্য কতবার বলেছে। কিন্তু সারাজীবনে আর বিয়েই করলো না সংসার বৈরাগ্য গহর ফকির। গহর ফকির সেই গোত্রের মানুষ, যারা সংসারের সুখ-দুঃখের মাঝে জন্মে, প্রকৃতির আলো-বাতাসে বড় হয়, শস্যদানা খেয়ে বেঁচে থাকে, অথচ সারাজীবন তারা সংসারের বাইরের মানুষ হয়েই থাকে।
আজ জীবনের এই সন্ধ্যা লগ্নে এসেও মানুষটা বদলালো না একটুও। একবার অসুখে পড়ে জমিটুকুও বিক্রি করে দিয়েছে।
এখন এই ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। গান গেয়ে যা পায় তাই দিয়েই চলে। অসুখে পড়লে না খেয়ে থাকে অথবা পাড়াপ্রতিবেশীরা দয়াবশত কেউ যদি কিছু দেয় তাই খায়। আজ আর ফরিদা ভাবী-জামাল ভাই নেই যে না খেয়ে থাকলে আদর করে খাইয়ে যাবে। কিংবা অসুখে পড়লে সেবা যত্ন করবে।
গান পাগল লালন প্রাণ এই মানুষটি গানের জন্য অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করেছেন। একবার এক গ্রামে গিয়েছেন গান করতে। কয়েকটি বাড়িতে গান করার পরই একজন হুজুর তার কয়েকজন চেলা নিয়ে চড়াও হয়েছিল গহর ফকিরের ওপর। বৃদ্ধ গহর ফকির প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, শাঁইজির গান করি। মানব প্রেমের কথা বলি।
তোমাদের ধর্ম নিয়ে তো কিছু বলি না। তাহলে তোমরা আমার পিছনে কেন লেগেছ?
হুজুর বললো, বুড়ো বয়সে ধর্ম-কর্ম নাই, নামাজ-রোজা নাই রসের নাগর হয়ে প্রেমের বাণী বিলাও তাই না!
গহর ফকির বললো, কর্মই মানুষের ধর্ম। একজন কৃষকের কাজ জমি চাষ করা, একজন জেলের কাজ মাছ ধরা। তেমনি আমার কাজ গান করা। গানই আমার নামাজ-রোজা, গানের ভিতরই আমি মনের মানুষ খুঁজি।
সেই মনের মানুষ কারো কাছে হতে পারে রক্ত-মাংসের মানুষ, আবার কারো কাছে হতে পারে ঈশ্বর।
গহর ফকিরের কথা শুনে হুজুর ক্ষেপে গিয়ে চড় মেরেছিলো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিলো। বলেছিলো, ফের এই গ্রামে এলে তোর পায়ের রগ কেটে দেব। আল্লাহ্'র পবিত্র জমিনে তোর মতো গুনাহ্গারের থাকার অধিকার নাই।
গ্রামের লোকজন বাধা না দিলে সেদিন হয়তো আরো মারতো গহর ফকিরকে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরেছিল গহর ফকির। মনে মনে বলেছিলো, তোদের আল্লাহ্ যদি গান ভাল না বাসে। মানুষকে ভালবাসার কথা যদি না শুনতে চায়, এমন বিপথগামী অসুর আল্লাকে তোরা কেন ডাকিস!
চার
প্রায় বছর তিনেক হলো গহর ফকিরকে আর কোথাও দেখা যায় না। শর্বরী কতজনের কাছে শুনেছে কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারে না।
কত ফকির-বোষ্টুমীর কাছে গহর ফকিরের সন্ধান করেছে মেলেনি। সবাই বলে, বোধহয় মরে গেছে। বয়স তো কম না।
শর্বরীও তাই বিশ্বাস করে। বোধ হয় মরেই গেছে।
শর্বরীর খুব কষ্ট হয়। শর্বরীর কানে বাজে দুটি শব্দ, 'মা আছি' অনেক ফকির-বোষ্টুমীই তো মা একমুঠো ভিক্ষা দাও বলে ডাকে। কিন্তু সে সব সাজানো বুলি। প্রাণের টান নেই। দাড়িঅলা কোন ফকির এলেই গহর ফকিরের কথা মনে হয় শর্বরীর।
সেদিন অনেকটা সময় তার ভেতরে জেগে থাকে গহর ফকির। কাজ করে, হাঁটাচলা করে কিন্তু ভেতরে থাকে গহর ফকির। কানে ভাসে 'মা আছিস?'
বিকেলে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে শর্বরী। ভাঙা অস্পষ্ট গলার দুটি শব্দ এলো কানে, 'মা আছিস?'
হাতের ঝাড়ু ফেলে প্রায় দৌড়ে ঘরের বাইরে এলো শর্বরী। বারান্দায় এসেই পাথুরে দৃষ্টিতে পাথরের মতো থমকে দাঁড়ালো।
গহর ফকির। তার গহর কাকা। এতদিন যাকে ভেতরে ভেতরে খুঁজেছে। সেই গহর কাকা। কিন্ত একি তার চেহারা! এই গহর কাকাকে তো সে দেখতে চায়নি।
ভ্যানের ওপর বসা যেন একটি কঙ্কাল। হাড়ের ওপর শুধু কালো চামড়ার প্রলেপ। একতারাটি ভ্যানের ওপর পড়ে আছে অসহায়। কান্নায় গলা ধরে এলো শর্বরীর। চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেল।
উঠোনে নেমে ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে শুধু বললো, কাকা!
ভ্যানের ওপর বসে কাঁপছে গহর ফকির। ভাঙা গলায় খুব কষ্টে বললো, কাদি..স ন..আ.আ। বলেই হাফাতে লাগলো।
ভ্যানঅলা বললো, তিন-চার দিন ধরে আমারে কয় আমার একবার বটেশ্বর নিয়ে চল। আমার সময় হয় না।
আজকে খুব কাকুতি মিনতি করে কইলো, আমার আজকে নিয়ে চল, নইলে মা'র সাথে আমার আর দেখা হবে না।
শর্বরী শব্দ করে কেঁদে উঠলো। গহর ফকির হাত দিয়ে ইশারা করলো না কাঁদতে। শর্বরী ঘর থেকে কটা টাকা এনে হাতে গুজে দিয়ে বললো, যাবার সময় কিছু খাবেন।
গহর ফকির দুদিকে মাথা নেড়ে টাকা শর্বরীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ভাঙা গলায় বললো, দাদু...উ ভাই কই..ই।
স্কুলে। বললো শর্বরী।
সামনে থেকে একতারাটা শর্বরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, দাদু ভাইকে দিস।
একটু দম নিয়ে খুব কষ্টে শর্বরীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে বললো, আমি কাল দুপুরে চলে যাবরে মা। তুই ভাল থাকিস মা।
আবার হাফাতে লাগলো।
শব্দ কোনটা বোঝা গেল। কোনটা গেলনা। শর্বরী কাঁদতে লাগলো। কাল দুপুরে চলে যাবে গহর কাকা! গহর ফকিরের চোখ থেকে দুটো জলের রেখা নেমে গেল।
হাত দিয়ে ইশারা করে ভ্যানঅলাকে যেতে বললো।
শর্বরী একতারাটা হাতে নিয়ে ভ্যানের পিছনে বাড়ির সামনের বটগাছ পর্যন্ত এগিয়ে এলো। ক্রমশই ভ্যান দূরে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাড়িগুলোর আড়ালে চলে যায় আবার বের হয়। এক সময় একেবারেই চোখের আড়াল হয়ে গেল ভ্যান।
তবু একতারা হাতে ঝাপসা চোখে সেদিকেই তাকিয়েই আছে শর্বরী। এখনও যে মনশ্চে দেখতে পাচ্ছে তার গহর কাকাকে। কানে বাজছে, 'তুই ভাল থাকিস মা। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।