(গত আগস্টে আমার বন্ধু শিরোনামে একটি ধারাবাহিক পোষ্ট দিয়েছিলাম, সবার অনুরোধে সে পোস্টের সবগুলি পর্ব কোন রকম এডিটিং ছাড়া একত্রে আবার পোস্ট করলাম)
তারিখ টা মনে নেই তবে সাল টা মনে আছে, ২০০৩ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আম্মাকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে গেছি, কিন্তু কিছুই চিনিনা, ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে যতটুকু চিনেছি। কিন্তু ভর্তি মানে যে এত হ্যাপা তা জানা ছিলোনা, ঘুরতে ঘুরতে দম বের হবার উপক্রম। এমন সময় কালো ছিপছিপে একটি ছেলের সাথে দেখা, সে সাহায্যের হাত বাড়ালো কিন্তু আম্মার তাতে কেন জানি মন সায় দিচ্ছিল না। তারপরও তাার সাথে গিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পাদন হলো, কথায় কথায় জানতে পারলাম সে অন্য এক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র।
তবে মজার ব্যাপার হলো তার সঙ্গে যে টেবিলেই গেছি সেখানে সঙ্গে সঙ্গে কাজ সমাধা হয়ে গেছে। কিন্তু সে কারও সাথে কোন রকম উচ্ছস্বরে কথা পর্যন্ত বলেনি। যাই হোক ভর্তি হয়ে বাসায় এলাম, কিন্তু কেন জানিনা তার কথা শুধু মনে পড়ছিল। দুই তিন দিন পরে আমার এক বড়ভাই যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাকে ঐ ছেলেটির নাম বলে জানতে চাইলাম বিস্তারিত। উত্তরে সে বললো সেতু ভাইয়া শুধু আমাদের কাছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার অতি প্রিয়।
সবার সাথে খুবই ভাল সম্পর্ক তার, সবাই তাকে যেমন ভালোবাসে তেমন শ্রদ্ধাও করে। উল্লেখ্য আমার সে উপকারী বন্ধুটির নাম সেতু।
যাই হোক, এর কয়েকদিন পরে যখন ক্লাস শুরু হলো তখন ক্যাম্পাসে শুধু তাকেই খুঁজি কিন্তু কোথাও তার দেখা মেলে না। এমন এক পর্যায়ে কিছু সিনিয়র আমাদের Rag দিতে ব্যস্ত, আর তখনি এসে হাজির আমার বন্ধু। এসে বললো (সিনিয়রদের) যা করেছিস ভালো করেছিস, আর যেন কখন ও ওর আশপাশে না দেখি, সিনিয়ররা জ্বি ভাইয়া বলে বিদায় নিলো।
আমি তাকে বললাম, বাড়ি দূরে, এক আত্নীয়ের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে থেকে ক্লাস করছি, হলে সিট পেলে সুবিধা হতো। শুনে বললো বেশতো, আপাতত কিছুদিন ডাবলিং করে থাকো, কিছুদিন পরে তোমার সিটের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। আমি বললাম কোন সিনিয়রকে তো চিনিনা, কিভাবে ডাবলিং করবো। শুনে সে বললো চলো ক্যান্টিনে যাই দেখি তোমার কোন ব্যবস্থা হয় কিনা। ক্যান্টিনে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার প্রিয় খাবার আইসক্রিম দিলেন এবং নিজে চা নিলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম আইসক্রিম যে আমার প্রিয় আপনি জানলেন কি করে। উত্তরে বললো, সে অনুমান করেছে। এরপর তার এক বান্ধবীকে ডেকে আমার আবাসন সমস্যা আলোচনা করে আমার সঙ্গে তাহমিনা আপুর (তার বান্ধবী) পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন চাইলে আমি এখনই বা যখন খুশী হলে উঠতে পারি।
শেষ মেষ উঠে পড়লাম তাহমিনা আপুর সিটে। হলে থাকি, মাঝে মধ্যে দেখা হয়, কথা হয় বন্ধুটির সাথে।
মাসখানেক পরে সেতু আমাকে নিয়ে গেল হলের প্রোভোস্টের কাছে, পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমার আবাসন সংকট সম্পর্কে বিস্তারিত বললো এবং স্যার কথা দিলেন এক সপ্তাহের মধ্যে আমার সিটের ব্যবস্থা করবে এবং হলোও তাই।
সত্যি বলতে কি প্রথম বর্ষের ছাত্রী হিসাবে ৪র্থ বর্ষের ছাত্রের সাথে বন্ধুত্ব প্রথমদিকে কেউ ই সহজভাবে নেই নি। সেতু ছাত্র হিসাবেও ছিল তুখোড়। রেজাল্ট যে অবস্থায় ছিল তাতে আমরা সবাই নিশ্চিত ছিলাম ও টিচার হবে।
ধীরে ধীরে সেতুর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা বেড়েই চললো, প্রথম বর্ষে Raging এর শিকার হইনি শুধু সেতুর বন্ধুত্বের কারনে।
কিছুদিনের মধ্যে এমন একটা অবস্থা হলো যে সেতুর জীবনের সব কথা আমাকে জানাতো। একদিন ও বললো সম্ভবত ওর জীবনে একটা ঝড় উঠতে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতে জানালো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সে হয়রানীর শিকার হতে পারে, অবাক হয়ে বললাম তা কি করে হয় সবাই তোমাকে এত ভালোবাসে................. ও বললো, এই ভালোবাসা ওর জন্য কাল হয়ে দাড়াচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বার্থান্বেষী মহল তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত, এবং তারা ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা আকছে।
২০০৪ সালের জুলাই মাসের এক সন্ধ্যায় হলে বসে পরদিনের ক্লাসগুলির জন্য নিজেকে তৈরী করছি।
এমন সময় তাহমিনা আপু কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন হলে এসে বললেন সর্বনাশ হয়ে গেছে, জরুরী সিন্ডিকেট ডেকে সেতুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। উল্লেখ্য ঐদিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাংচুর এর ঘটনা ঘটেছিল এবং সে সময় সেতু আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিল। জিজ্ঞাসা করতে তাহমিনা আপু জানালো ঐ ভাংচুরের ঘটনায় সেতুকে জড়ানো হয়েছে। সেতুদের ব্যাচের তখন মাত্র থিসিসের ডিফেন্স বাকী ছিল।
তাহমিনা আপুর কাছে সংবাদটি পেয়ে মোবাইলে কল করলাম সেতুকে, ও মোবাইল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই আমি কেঁদে ফেললাম, ও আমাকে সান্তনা দিলো, বললো কোন চিন্তা করোনা, আমি কোন অন্যায় করিনি, কিছু হবে না, এখন হলে একটা মিটিং এ আছি মিটিং শেষ করে কল করছি।
মিটিং শেষ করে কল করে বললো, তোমরা কোন চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। আগামীকাল সকাল ১০ টায় শহীদ মিনারে ছাত্র-ছাত্রীদের মিটিং ডাকা হয়েছে, সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ছাত্রদের পক্ষ থেকে কি কর্মসূচী আসবে, তবে আমি কোন আন্দোলনের পক্ষে নই, আমি চাইনা আমার কারনে কোন রকম সেশন জট তৈরী হোক।
পরদিন ঠিক দশটায় আমাদের শিক্ষকেরা কৌশলে আমাদের ক্লাসে আটকে রাখলো যেন কেউ মিটিং এ যেতে না পারে। তারপরও সকল ছাত্র-ছাত্রী শহীদ মিনারে এলো (মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া)। সিদ্ধান্ত হলো ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করবে পরদিন থেকে, এটা জানতে পেরে সেই সুবিধাবাদী মহল শিক্ষক সমিতির ব্যানারে ঐ দিন থেকে ক্লাস বর্জন কর্মসূচী ঘোষনা করলো এবং সেতু সহ সকল দোষী ছাত্রদের বিচার দাবী করে।
কিন্তু তখন ও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে নি আসলে ভাংচুর এর ঘটনাটা ছাত্ররা ঘটিয়েছিল না কি পুরোটাই ছিল নাটক।
ছাত্ররা পাল্টা কর্মসূচী দিতে চাইলে বাঁধা হয়ে দাড়ালো স্বয়ং সেতু। সে তখন আইনের পথে এই অবিচারের প্রতিকার করার জন্য আইনের দ্বারস্থ হতে সিদ্ধান্ত নিলো।
সেতুকে আমরা অনেক বোঝালাম, বাংলাদেশে আইনের প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ বরং ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র ছাত্রী তোমার সাথে আছে।
কিন্তু তার এক কথা তার কারনে কোন ছাত্র আন্দোলন হোক, বা সেশন জট হোক তা তার কাম্য নয়। আইনের দ্বারস্থ হলে একজনের (সেতুর) সময় নষ্ট হবে কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। তাই সে প্রথমে সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করে এবং পাশাপাশি সুশীল সমাজকে বিষয়টি জানাতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের ও আয়োজন করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কুচক্রি মহল এতে আরও ক্ষিপ্ত হয় এবং জুলাইতেস তাকে সাময়ীক বহিস্কার করলেও আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী ভাবে বহিস্কার করা হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সে আগুনে পানি ঢালে স্বয়ং সেতু, স্থায়ী ভাবে বহিস্কারের পরদিন শিক্ষক সমিতি তাদের আন্দোলনের কর্মসূচী প্রত্যাহার করে এবং ছাত্রদর ক্লাসে যেতে আহবান করে, কিন্তু ছাত্ররা আপত্তি জানায়।
ঐ সময় সেতু নিজে এসে ছাত্রদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং সে জজ আদালতের মামলা প্রত্যাহার করে হাইকোর্টে রীট মামলা দায়ের করে।
শুরু হয় সেতুর জীবনের নতুন অভিজ্ঞতার, ব্যারিস্টার আর উকিলদের পিছনে ছোটাছুটি, সেই কুচক্রি মহর এখানেও থেমে থাকেনা, সেতুর বিপক্ষে হাইকোর্টের একজন টাকালোভি ব্যারিষ্টারকে নিয়োগ করে তারা।
মামলাটির তদবির খুব জোরে শোরে এগিয়ে নেয় সেতু, কিন্তু তার দূর্ভাগ্য যখন ই মামলাটি শেষের দিকে যায় তখনই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেতুর সাঁজার মেয়াদ কমিয়ে আনে, প্রথমে আজীবন থেকে ৩ বছরের জন্য, সেখান থেকে ১ বছরের জন্য এবং সর্ব শেষ ৬ মাসের জন্য বহিস্কার করে সেতুকে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনানুযায়ী যে সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে রীট মামলা দায়ের করা হয় সে সিদ্ধান্ত বহাল না থাকলে বা পরিবর্তন হলে রীট মামলাটি আপনা আপনি খারিজ হয়ে যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যতবার সেতুর সাজার মেয়াদ কমিয়েছে ততবার সেতুকে নতুন করে রীট মামলা করেতে হয়েছে।
পাশাপাশি বিম্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেতুর বিরুদ্ধে ফৌজদারী আদালতেও মামলা দায়ের করে।
চার পাঁচটি রীট মামলা করতে আর উকিলের খরচ যোগাতে সেতু তখন রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। ওর সঙ্গে তখন হাইকোর্টে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, কিন্তু যারা ওর সাথে ছিল তাদের মুখে শুনেছি একটানা ১৭ দিন সেতু তখন চা-বিস্কুট আর পানি খেয়ে কাটিয়েছে বাড়ির জায়গা জমি বিক্রি করতে হয়েছে, অথচ এই সেতু ছিল আমাদের ক্যাম্পাসে খরচের দিক থেকে সেরা বন্ধু।
প্রতিমাসে টিউশনি এবং ভর্তি কোচিং এ ক্লাস নিয়ে ২০ হাজারের বেশী টাকা আয় করেছে, বাড়ি থেকে ও ভালো একটা সাপোর্ট পেত। কিন্তু কোনদিন একটি টাকা সঞ্চয় করেনি, কোন বন্ধু বা জুনিয়র কোর্স রেজিষ্ট্রেশন করতে পারেনি, কার বাড়ি থেকে টাকা আসেনি তাই না খেয়ে আছে এমন সব গুলোকে খুঁজে বের করে তাদের সমস্যা সমাধান করা ছিল ওর নেশা।
আর সেই সেতু ১৭ দিন ভাত না খেয়ে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক হলে পরিচিত কারোর বেডে শুয়ে রাত টা কাটিয়ে দিয়েছে, হলে যার বেডে অন্য কারো ঘুমানোর অনুমতি ছিলনা। এক রুমে ৪ টি ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল। যাই হোক অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ২০০৫ এর জুলাই এর শেষ দিকে সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে (স্বাধীনতার পরে) প্রথম ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে রীট মামলায় জয়ী হয়। মামলার রায়ে সেতুর উপর অর্পিত সাজা অবৈধ ঘোষিত হয়।
শুনে আমরা যেন আকাশ হাতে পেলাম, ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীরা উল্লাস করলো, স্বাগতম জানালো, অভিনন্দন জানালো এবং ঘোষনা করলো সেতু ক্যাম্পাসে ফিরলে সম্বর্ধনা দিবে।
সেতুর আসতে কয়েকদিন দেরী হলো, মামলার রায়ের কপি তোলাসহ কিছু কাজ সেরে ১ সপ্তাহ পরে ও ক্যাম্পাসে এলো এবং ও যে ঐ দিন ক্যাম্পাসে আসবে আমরা কেই জানতাম না। কেউকে কিছু জানতে দেয়নি। যখন শুনলো সবাই ওকে সম্বর্ধনা দিতে চায় ও আপত্তি করলো। এবং কোন হৈচৈ করতে নিষেধ করলো।
সেতু ক্যাম্পাসে ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু সেই সেতুকে যেন আমরা আর খূঁজে পাচ্ছিলাম না।
কারন ওর জীবন থেকে তখন হারিয়ে গেছে একটা বছর আর সেই সঙ্গে সব স্বপ্ন। সেতু আর আগের মত প্রাণ খুলে হাসেনা, মাতিয়ে রাখেনা বন্ধুদের আড্ডা।
প্রথমে কারনটা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি, পরে জানতে পারলাম আর্থীক অনটন ওর সঙ্গে আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে গেছে, যারা ওর সঙ্গে মামলার কাজে কোর্টে যেত তারা হিসাব আগষ্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোট সাড়ে আট লাখ টাকা খরচ হয়েছে সেতুর, অনেক টাকা ধার ও করেছে। অথচ ওর ওই দূর্দিনে ওকে মোবাইলে কর করলেও কেটে দিয়ে কলব্যাক করতো ও। কখন ও কেউকে বুঝতে দেয়নি ভিতরে ওর কত কষ্ট।
সেতু ক্যাম্পাসে ফিরে আবার নতুন করে রেজিষ্ট্রেশন করে পরীক্ষা দিলো থিসিস ও শেষ করলো। তারপর গ্রাজুয়েশন শেষ করে হন্যে হয়ে চাকুরী খুঁজতে লাগলো, আমরা বললাম মাস্টার্সের কথা শুনে শুধু অবাক হয়ে তাকালো যেন মাস্টার্সের নাম ও কখন ও শোনেনী বা শোনা পাপ।
অবশেষে একটি স্থানীয় এনজিও তে কর্মজীবন শুরু করলো এবং তারপর নিজের মোবাইল নাম্বার টা পাল্টে ফেললো, অনেকদিন পর্যন্ত কারো সাথে কোন যোগাযোগ করেনি।
এদিকে রীট মামলায় জিতলেও নিম্ন আদালতে তখন ফৌজদারী মামলা বিচারাধীন যেখানে ও জামিনে আছে এবং প্রতি মাসে ২ বার আদালতে হাজিরা দিতে হয়, মামলার তারিখ জানতাম শুধূ আমি আর দূর্ভাষী, দেখা করতাম ওর সাথে সত্যি খুব কষ্ট হতো ওর জীবন দেখে।
সেতু একটি ছোট খাট চাকুরী পেলেও মন দিয়ে কাজ করতে পারতো না কারন প্রতিমাসে কমপক্ষে দুই বার ফৌজদারি আদালতে হাজিরা দিতে হতো, আর হাজিরা দেয়ার পরে শুরু হতো মামলার তারিখ পড়ার ঝামেলা।
আইনজীবি নিজেও চাইতেন না মামলাটি খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হোক, কারন যত বেশী তারিখ তার তত বেশী ফিস।
কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে যখন সেতু ক্লান্ত শ্রান্ত সে সময়ে বিচার বিভাগ স্বাধীন করা হলো এবং গত ঈদুল আযহার ছুটির পূর্বে শেষ কার্যদিবসে কুচক্রি মহলের সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ফৌজদারী মামলায় সম্মানে বেকসুর খালাস পায় সেতু আর মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা ও দূর্ণীতির কারণে এবং নীরিহ ছাত্রদের হয়রানী করার দায়ে অভিযুক্ত করে পুলিশ বিভাগকে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় আদালত।
মামলা জয়ের পর আবেগে কেঁদে ফেলে সেতু, সেদিন আমরা ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই একটি মাত্র মামলার জন্য দীর্ঘ চারটি বছর ধরে প্রতিমাসে দুই থেকে তিন দিন আদালতে হাজির হতে হয়েছে ওকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মুখ, পরোপকারি সেতুকে ধর্ণা ধরতে কোর্টের কেরানী মুহুরীদের কাছে, কি যন্ত্রনাদায়ক অভিজ্ঞতা একবার ভেবে দেখুন।
ঈদের ছুটির পর সেতু অফিসে গিয়ে প্রথমে তার বস কে জানিয়ে দিলো সে চাকুরী ছেড়ে দিবে, কারণ সে আর ও পড়াশুনা করতে চায এবং যার জন্য তাকে ঢাকায় যেতে হবে।
বস ছাড়তে নারাজ, কারণ সেতুর মত দক্ষ এবং সৎ কর্মী পাওয়া যে কোন সংস্থার জন্য ভাগ্যের, নিজেকে সে প্রমাণ ও করেছিল, প্রমোশন আর ইনক্রিমেন্টের বন্যায় ভেসেছে তার প্রথম কর্মজীবনে। কিন্তু সেতুর এক কথা সে পড়বে এবং জেলা শহরে থেকে তা সম্ভব নয়। অবশেষে বসের পীড়াপিড়িতে আরও কিছুদিন সময় দিলো সে বসকে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে সহকারী পরিচালক হিসাবে চাকুরী নিয়ে সেতু চলে আসে ঢাকায়, এবং পড়াশুনার চেষ্টা শুরু করে। কথা হয় প্রতিদিন ওর সাথে, এখন ও কোথাও ভর্তী হয়নি সে, জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেরী করছে কেন, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো - "২০০৪ এর দেনা এখন ও শুধিতে পারি নাই রে সখি, দুই এক মাসের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে তারপর এ দেশে আর থাকবো বলে আমা করছি না"।
ইচ্ছা ছিল সেতুকে নিয়ে আরও কিছু পর্ব লিখব, কিন্তু গতকাল সেতু সা.ই. এ ভিজিটর হিসাবে আমার সব পোষ্টসহ সংশ্লিষ্ট পোষ্ট ও কমেন্টগুলি দেখেছে এবং কয়েকটি মন্তব্য ওকে খুবই ক্ষুব্দ করেছে তাই ওর দেয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে যাবতিয় পোষ্ট মুছে দিতে অনুরোধ করেছিল। দূর্ভাষীর অনেক চেষ্টার ফলে আপাতত পোষ্টগুলি থাকছে কিন্তু আজকের এই পোষ্টের পরে সেতুকে নিয়ে আর কোন পোষ্ট দেয়া যাবেনা বলে কথা দিতে হয়েছে। তাই সকল ব্লগারদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। আজ এই শেষ পোষ্টে সেতুর পরিচয়টা দেয়ার চেষ্টা করবো।
সেতুর জন্ম ১৯৭৯ সালে, বাবা মার দ্বিতীয় সন্তান।
ওরা দুই ভাই এক বোন, বোনটি সবার ছোট। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন, মা গৃহীনী, বড়ভাই পরবর্তীতে ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশের একটি গ্রামে ওর জন্ম। শৈশব কেটেছে গ্রামে। গ্রামের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা সেতু গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় এবং গ্রামের হাই স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেনীতে ও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করে।
উপজেলা সদরের বেসরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে একটি মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা পড়ে এবং দু'জনেই এ সম্পর্ককে পড়াশুনার উন্নতির পথ হিসাবে বেছে নেয়। পড়াশুনার ব্যাপারে এক অপরকে আন্তরিকতার সাথে সহযোগীতা করতো, বিষয়টি ওদের দুই পরিবারই জানত এবং সেতুর জনপ্রিয়তা, ভবিষ্যত সম্ভবনা বিচার করে মেয়েটির পরিবার ওদের সম্পর্ককে সহজভাবে মেনে নেয় আর সেতুর পরিবার সেতুর মতামতকে খুব বেশী মূল্যায়ন করত।
কিন্তু ২০০৪ সালের দূর্ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় মেয়েটির পরিবারের কাছে সেতু রাতারাতি ভিলেন বনে গেল। কিন্তু মেয়েটি সেতুকে আরও বেশি সময় দিতে শুরু করে।
মেয়েটির পড়াশুনা শেষ হলে সেতুর পরিবার থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসে ওদের বিয়ের, কিন্তু মেয়ের বাবা মা সেতুর াভিবাবকদের প্রচন্ড অপমান করে এবং মেয়েটি লুকিয়ে আমার মাধ্যমে সেতুর কাছে চলে আসে। কিন্তু মানুষ বাবে এক আর হয় আর এক, মেয়েটির চলে আসাতে আপত্তি করে বসে সেতু বরাবরের মত তার সেই যুক্তি - মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে সে নতুন জীবন শুরু করবে না।
মেয়েটি এবং আমরা ওকে অনেক বুঝাই, কিন্তু সেতুর এক কথা, অবশেষে সেতু নিজে মেযেটিকে তার বাবা মায়ের কাছে দিয়ে আসে এবং মেয়েটির বাবা মা'র সামনে মেয়েটিকে বলে আসে যে সব কারনে তোমার বাবা-মা আমাকে তোমার অযোগ্য মনে করেছে সে সব কারন দূর করে যেদিন যোগ্য হয়ে আসতে পারবো সেদিন তোমার বাবা মার সামনে থেকে তোমার হাত ধরে তোমাকে নিয়ে যাবো, অবশ্য ততদিন যদি তুমি ধৈর্য ধরতে পারো। সেই থেকে মেয়েটি পথ চেয়ে বসে আছে সেতুর, আর সেতু কোন যন্ত্রনা ভোগ করছে তা বোধহয় পাঠক বুঝতে পারছেন।
না, সেতুর কোন রাজনৈতিক পরিচয় ছিলনা।
সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার পূজারী সেতু, মানুষ মাত্রেই ভূল আছে সেতুর ও আছে তবে সেটা খুব উল্লেখযোগ্য কিছু বলে মনে হয় না। আজ ও সেতু নিজেকে আরও যোগ্য করে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত। ভালো পোষ্টে চাকুরী করছে, ভালো বেতন পাচ্ছে, কিন্তু ওর জ্ঞান পিপাসা আর ও বেড়ে চলেছে।
সর্বশেষ আসার সাথে যে কথা হয়েছে তা অনুযায়ী ও এখান থেকে মাস্টার্স করে তারপর বিয়ে করবে এবং তারপর স্বপরিবারে দেশ ছাড়বে বলে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।
ব্লগার বন্ধুরা, সেতু সম্পর্কে আর একটা কথাও লেখার অধিকার আমার নেই।
আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
সেতু আমি জানি তুমি ব্লগে চোখ রাখছ, তোমাকে যদি ছোট করে থাকি তাহলে সেটা আমার প্রকাশ ভঙ্গির দূর্বলতা মাত্র, তুমি বন্ধু হিসাবে আমাদের কাছে অদ্বিতীয় এবং তোমার আসন আজীবন অমলিন। তারপর ও ভূল চুকের জন্য ক্ষমা প্রার্থী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।