আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবদুল জলিলের সাহসী উচ্চারণ এবং...

আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ

আবদুল জলিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি এখন দলীয় কর্মকাণ্ডে নিস্ক্রিয়। বলা যায়, তাকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কাগজে-কলমে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও দায়িত্ব পালন করছেন দলের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন না করলেও আওয়ামী লীগের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর তার অজানা থাকার কথা নয়।

প্রধানমন্ত্রীর এক সময়ের আস্থাভাজন হিসেবে আবদুল জলিল সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন এবং এবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি আবদুল জলিল দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় অনেক মন্ত্রী রয়েছেন, যারা ডিজিএফআই বা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ‘পেইড এজেন্ট’। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের প্রভাবশালী নেতাদের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, “সব ব্যাটা ওই সময় ডিজিএফআই’র দালালি করেছে।

কে দালালি করেনি, সাহস থাকলে বলুন। আমু, রাজ্জাক, তোফায়েল, সুরঞ্জিত¬ সবাই দালালি করেছে। তখন কারা কারা সকাল-বিকাল গুলশানে যেত তা কি আমরা জানি না?” আবদুল জলিলের এ বক্তব্য শুধু সরকারের নাড়ি ধরে টান দেয়নি, কিছু গুরুতর প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। আবদুল জলিলের এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে না পেরে আবদুল জলিল সঙ্ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি কী বলল ধরতে নেই।

আবদুল জলিলের এই সমস্যা সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। আশা করি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যথার্থই বলেছেন, আবদুল জলিল বিক্ষুব্ধ। একজনকে দায়িত্ব দিয়ে তা যদি পালন করতে না দেয়া হয় তার ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেননি যে, আবদুল জলিল বাড়তি কিছু বলেছেন বা অসত্য বলেছেন।

বরং আমরা জানি মানুষ ক্ষুব্ধ হলে অনেক কিছু গোপন করতে পারেন না, প্রকৃত সত্য বলে ফেলেন। ক্ষুব্ধ আবদুল জলিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের ধারেকাছে না গিয়ে হয়তো সত্য কথাই বলেছেন। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের এক ধরনের সরলতা থাকে, আবদুল জলিলের মধ্যেও এ ধরনের সরলতা আছে বলে শুনেছি। তবে এর আগেও বিভিন্ন সময় তিনি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। বিগত চারদলীয় সরকারের আমলে সরকার পতনের ডেডলাইন ঘোষণা করে ট্রাম্পকার্ডের কথা জানিয়েছিলেন।

এরপর যে চমকের কারণে তাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে নিস্ক্রিয় করা হয়েছিল সেটি ছিল এক/এগারোর পর কারাগার থেকে দেয়া তার আলোচিত চিঠি। যাতে তিনি নেত্রীর সমালোচনার পাশাপাশি রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর খেসারত হিসেবে সংস্কারপন্থীদের গ্রুপে যোগ না দিয়েও পরে দলের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের মতো তিনিও কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং তাকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে নিস্ক্রিয় করা হয়। যা হোক আবদুল জলিলের সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো¬ ওয়ান/ইলেভেনের আগে ও পরে আওয়ামী লীগের সাথে সেনাবাহিনীর একটি অংশের যোগাযোগ ছিল। তাদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক হতো।

বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে মাসোহারা নিয়েছেন। কেন নিয়েছেন? তাদের নীতি বাস্তবায়নের জন্যই কি? তাহলে প্রধানমন্ত্রী অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কি আবদুল জলিলের ভাষায় এই এজেন্টদের তৎপরতার কারণে? আবদুল জলিল স্পষ্ট করে বলেছেন¬ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো নেতাদের সাথে গুলশানে নিয়মিত বৈঠক হতো। সেখানে সৈয়দ আশরাফুলও যেতেন। আবদুল জলিলের কথায় তারা তখন ডিজিএফআই’র দালালি করেছেন। আবদুল জলিলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট উঠে এসেছে যে, আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের সাথে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের সাথে শুধু নিয়মিত বৈঠকই হতো না, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল।

এর আগে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পর মহাজোটের অপর নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারত না। সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী লীগের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এরশাদের পর আবদুল জলিলের এই বক্তব্যের মাধ্যমে সে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হলো¬ ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তার পরিকল্পনার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা হয়েছে। পরে তারাই মন্ত্রিপরিষদে স্থান পেয়েছেন যারা ডিজিএফআই’র সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আবদুল জলিলের কথায় তারাই ডিজিএফআই’র পেইড এজেন্ট।

নির্বাচনের আগে এ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই কি একটি একদলীয় সংসদ কায়েম করা হয়েছে? এ ধরনের একটি সংসদ প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী মহলের সাথে আওয়ামী লীগের আঁতাত হয়েছিল? নিশ্চয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এর লক্ষ্য ছিল না। কারণ একদলীয় সংসদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, গণতন্ত্র নয়। বিশ্বের অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে দলের সাধারণ সম্পাদকের এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ উঠলে বিষয়টি শুধু তদন্ত নয়, যারা পেইড বলে অভিযুক্ত হবেন তাদের পদত্যাগ করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি হবে বলে আশা করা যায় না। বরং দলের মধ্যে আবদুল জলিলের পরিণতি নিয়ে এখন নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এর অতীত উদাহরণও আছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিয়ে শামসুল হকের পরিণতি সবারই জানা। মওলানা ভাসানীর পছন্দের এই রাজনীতিক কোটারি স্বার্থের বলী হয়ে ‘পাগল’ হিসেবে অভিহিত হয়েছিলেন। তিনি আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে পারেননি। আবদুল জলিলও হয়তো আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সক্রিয় হতে পারবেন না।

তবে আবদুল জলিল অভিজ্ঞ রাজনীতিক। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সাথে জড়িত। শুধু আবেগের বশে এমন বক্তব্য দিয়েছেন বলে মনে হয় না। তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসব তথ্য প্রকাশ করেছেন। আবদুল জলিল সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছেন, “আপনারা লিখে দিন।

আমি তো সবই হারিয়েছি। এখন আমি কাউকেই ভয় পাই না। আমি আমার জায়গায় থেকে ‘ফাইট’ করে যাব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। দল থেকে বাদ দিলেও পার্লামেন্ট থেকে তো বাদ দিতে পারবে না।

দরকার হলে আবার ভোটে যাব, জনগণ আমার সাথে আছে। ” আবদুল জলিলের বক্তব্যের মাধ্যমে ওয়ান/ইলেভেনের আগে-পরে এবং মন্ত্রিপরিষদের গঠন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় একটি পরিকল্পনা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জেনে-বুঝে তা করেছেন। ক্ষমতার রাজনীতির কারণে আবদুল জলিলের মতো বিশ্বস্ত নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন। আবার একইভাবে অনেক প্রেসিডিয়াম সদস্যও মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ পড়েছেন।

বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই সব কিছু সাজিয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর অনেক রাজনৈতিক নেতার সাথে আবদুল জলিলও গ্রেফতার হয়েছিলেন। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রধান উপদেষ্টার কাছে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা দিয়ে চিঠি লিখে মুক্তি লাভ করেছিলেন। অবশ্য রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা অনেক নেতা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর ঠিক থাকে না। এক সময় প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, তিনিও ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর আর রাজনীতি করবেন না।

যা হোক আবদুল জলিল কারাগার থেকে লেখা সেই চিঠিতে নেত্রীর ভুল সিদ্ধান্তেরও কড়া সমালোচনা করেছিলেন। যদিও নির্বাচনের পর আবদুল জলিল বলেছেন, তাকে এ ধরনের চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য যারা নেত্রীকে মাইনাস করে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের চেয়ে অসুস্থ আবদুল জলিলের এই চিঠির অপরাধ বেশি হবে কি না তা নিয়ে দলের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আবদুল জলিলের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গুলশানে মিটিং করা নেতা আর পেইড মন্ত্রীদের কারণে তাকে নিস্ক্রিয় করা হয়েছে। আবদুল জলিল বলেছেন, ‘আমি পরিস্থিতির শিকার।

দেশবাসী জানে, আমি কোনো অন্যায় করিনি। বিনা দোষে আমার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে। আমরা আজ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আর যারা ডিজিএফআই’র দালালি করে ওই সময় সুবিধা ভোগ করেছে, এখনো তারা সুবিধা নিচ্ছে। আবদুল জলিলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট, তিনি ওয়ান/ইলেভেনের সময় পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন আর এখন হয়েছেন ষড়যন্ত্রের। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবদুল জলিল সাহসী হয়ে মুখ খুলছেন, অনেকে হয়তো তার মতো সাহসী হতে পারেননি। তার পরও অনেকের মুখ থেকে ছিটেফোঁটা ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে। তাদেরই কেউ কেউ বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে কচিকাঁচার আসর বলেও অভিহিত করেছেন। দলের মধ্যে অভিজ্ঞ নেতাকর্মী থাকা সত্ত্বেও বাইরে থেকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী করার সমালোচনা করেছেন। আসলে ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে গণতন্ত্রের বদলে দেশে ব্যক্তির একনায়কত্ব কায়েম হয়েছে।

এর ফল হচ্ছে আবদুল জলিলের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, আবদুল জলিল কি আওয়ামী লীগে টিকতে পারবেন? তিনি যাদের সম্পর্কে পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগ এনেছেন, তারা তাকে কিভাবে নেবেন? নাকি তিনি শামসুল হকের মতো পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছেন? আবদুল জলিলের বক্তব্যের জবাবে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সংসদে সরকারদলীয় উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, নৌকা থেকে কেউ নেমে গেলে তিনি হারিয়ে যান। তার আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায় না। আবদুল জলিল কি হারিয়ে যাবেন নাকি তার মতো বঞ্চিতরা টিকে থাকার জন্য আরেকটি নৌকা বানাবেন তা দেখার জন্য আমাদের আর কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। লেখকঃ আলফাজ আনাম Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.