কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
কেস১
আমার এক দোস্ত চরম টাইপ পড়ুয়া ছেলে। বন্ধুর নাম ছিল শান্ত। একসাথে স্কুল কলেজে পড়ছি, লেখাপড়া নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নাই। একই গ্রুপে আমরা।
সারাদিন এক সাথে ঘুরতাম, বাসায় যেয়ে আমি গান নিয়ে পরে থাকতাম, আর ও লেখাপড়া করত।
যাই হোক, ইন্টার শেষ হল। ছেলে গেল ঢাবি তে। কিন্তু, দুঃখের কথা, তার পড়ার বিষয় খুব একটা ভাল না। মোটামোটি আর কী ! সামাজিক বিজ্ঞানে আছে সে।
যাই হোক, আমরা জানি সে ভাল ছাত্র, আর সে নিজেও তা জানে। তাই এখন তার প্ল্যান হল,সারাদিন লেখাপড়া করে ফার্স্ট সেকেন্ড টাইপ কিছু একটা হওয়া, এরপরে পারলে এখানেই শিক্ষক হয়ে যাওয়া।
খুবই ভাল কথা, সে এখন সারাদিন পড়াশোনা করে।
ঘটনা হল, অতি সম্প্রতি আমাদের আরেক জিগরী দোস্ত ঢুকছে এক প্রাইভেট ভার্সিটিতে । সে ট্রিপল ই পড়ে।
এতে তার মাটিতে আর পা পড়তেছে না। সে আমার ওই ভাল ছাত্র বন্ধুকে ফোন করে বলে,তার জন্য নাকি ওর বড়ই কষ্ট লাগে। এই ঘোড়ার ডিম পড়ে সে পরে কীই বা করবে। স্বাভাবিকভাবেই যাকে বলা হল, সে খুবই কষ্ট পাইছে। শান্ত বেচারা আমাকে সব বলে, আমারও খারাপ লাগল খুব শুনে।
তো ওই ছেলেকে আমি ফোন করে খুব ঝাড়ি দিলা যে, দোস্ত তুমি শান্তকে এগুলি বলছ কেন? তুমি নিজেকে ইদানীং কী মনে কর?হেন তেন। যাই হোক, ও স্যরি বলল। পরে সব ঠিকঠাক। আমি আর শান্ত একদিন ওর ভার্সিটিতে ঘুরতে গেছি। যেয়ে দেখি অবাক কাণ্ড! ওদের ক্লাস সপ্তাহে ৩ দিন হয়, ৩ ঘণ্টা করে।
এরপর শেষ। আমরা বললাম, ল্যাব !!! তখন জানলাম,ল্যাব এখনও বানানো শেষ হয় নি। আপাতত আরেক বিল্ডিংয়ের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে কাজ চালাচ্ছে। ওদের ভার্সিটি থেকে ওখানে যেতে নাকি রিকশা লাগে। তাই আর ঝামেলা করে খুব একটা যায় না।
এখন, শান্ত চিন্তা করতেছে, উলটা ওই ছেলেকে ফোন করে ভাব নবে কী না!!
কেস২
আমার এলাকার এক বড় ভাই, সেই কতদিন ধরে শুনি উনি নাকি সাংঘাতিক ভাল ছাত্র। পাশ করার গেই নাকি তার জন্য চাকরী পুরা রেডি। ভাল, খুব ভাল। কিন্তু, উনি পাশ করে আর বেরুচ্ছেন না। ৪ বছর পরেও শুনি ২য় বর্ষ।
তো, ঘটনা হল, উনি আমাকে একেবারেই তুচ্ছতাচ্ছিল্ল করেন। একেবারেই। সেদিন দেখি, রাস্তায় কিছু পিচ্চি পোলাপানকে কী একটা ঘটনা বলতেছেন। তিনি এক বাসে ছিলেন, ৪০ কিমিতে চলতেছিল। আর সামনে থেকে আসতেছে এক ট্রাক, ৬০ কিমিতে।
পরে, লাগল এক ধাক্কা। ট্রাকটা আর বাসটা নাকি দুই দিকে ধাক্কা খেয়ে ত্রিশ মিটার পিছিনে সরে গেল। এরপরে বিশাল আম গাছে বাস বাড়ি খেল, আরও কিছু হাবিজাবি। আমি বললাম, এ কী করে হয় !! সে বলল, আরে ব্যাটা তুই প্রাইভেটের পোলা, তুই এসবে বুঝিস কী ? আমি শুনছিলাম, সে ভাল ছাত্র অনেক। ভাবলাম,আমারই ভুল।
তাই আর কিছু বলি নাই।
পরে,আরেকদিন দেখি সে এক ছেলেকে বুঝাচ্ছে, পানির নাকি মধ্যাকর্ষণ শক্তি নাই। তাই পানত উপর মানুষ দাঁড়াতে পারেনা। আমি বললাম, এ কী করে হয় !! সে বলল, আরে ব্যাটা তুই প্রাইভেটের পোলা, তুই এসবে বুঝিস কী ? আমি শুনছিলাম, সে ভাল ছাত্র অনেক। ভাবলাম,আমারই ভুল।
তাই আর কিছু বলি নাই।
সে আমাকে পায়ই বুঝায় যে, ঢাবিতে পড়ার কারণে সায়েন্সে উনার উপর নাকি কেউ না। আর প্রাইভেটে পড়ার কারণে আমি নাকি কিছুই শিখি নাই। আমি যতই বলি, পানিরও মধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে,সে ততই হাসাহাসি করে।
শান্তর সাথে ঢাবিতে দেখা করতে যেয়ে দেখি ওই সিনিয়ার ভাই।
হঠাত মনে হল,উনি এই ক্যাম্পাসে কেন? উনার সাবজেক্ট জানলাম, হিউম্যানিটি। আর,এই পোলা এত দিন আমার সাথে সায়েন্স কপচায়।
এখন ভাবতেছি, উনারে নিয়াই হাসব কী না!!
পাবলিকে চান্স পাওয়ার জন্য সারাদিন খাঁটতে হয়। প্রচুর লেখাপড়া করতে হয়। তখন আমি শুধু ঘুমাইছি।
এখন, আমার বন্ধু পাবলিকে গেছে, আর আমি প্রাইভেটে। আমি তাকে গুরুত্ব দিব না? ভার্সিটিতে ঢুকার সময় অবশ্যই সে আমার চেয়ে ভাল ছাত্র ছিল।
কিন্তু, চার বছর আগে কেউ বলতে পারেনি যে, ২০০৯ সালে আকাশ কেমন ছাত্র হবে ! আজকেও কেউ বলতে পারবে না যে,পাশ করে বের হবার সময় আকাশ আরও চার বছর পরে কেমন ছাত্র হবে !
[আমি মনে করি,বুয়েটে ভর্তি হতে কোন ছেলেকে যতটুকু খাঁটতে হয়,দর্শনে ভর্তি হতে তার ১০ ভাগও খাঁটতে হয় না। অথচ, এরা এমন একটা ভাব নেয়, না জানি কত বছর ধরে দর্শনে আসা তাদের সাধনা ছিল। তখন,পড়াশোনা করি নাই বলে আমাকে খোঁচা দেয়।
]
একই স্কেলে আমি প্রাইভেটের ছেলে থেকে পাবলিকের ছেলেকেই এগিয়ে রাখব। মানে, আমি যদি সিজিপিএ ৩ পাই, আরেকটা পাবলিকের ছেলেও সিজিপিএ ৩ পায়, তাহলে আমি মনে করি পাবলিকের ছেলেটা বেশি ভাল ছাত্র। কারণ, ওদের লেখাপড়ার সিস্টেম অনেক ঝামেলার আর কষ্টের। সেইখানে,আমরা বেশির ভাগ নোটপত্র একেবারে হাতের নাগালে পাই। লেখাপড়ার প্রতি ওর আগ্রহ আমার চেয়ে বেশি ছিল।
[কিন্তু, একটা ছেলে সিজিপিএ ২ পেল, আর প্রাইভেটের একজন ৩ পেল। প্রথম ছেলেটা পাবলিকে পড়লেও আমি মনে করি না সে দ্বিতীয় জনের চেয়ে ভাল ছাত্র হবে। শুধু ইন্সটিউটের নাম বেঁচে বেশিদিন খাওয়া যায় না। ]
[আরেকটা দিক না ভাবলেই না, প্রাইভেটে যেহেতু সবাই অনেক টাকা খরচ করে পড়তে আসে, তাই প্রাইভেটে পোলাপান একটু খারাপ করলেও তাদের টেনেটুনে পাশ করিয়ে দেয়া হয়। আবার, শুধু এটুকু বললেই শেষ হয় না।
অনেকে প্রাইভেটে যেহেতু সব বিষয়ে গড়ে ৭৫ এর উপরে পেলে ৫০% বা পুরো ফ্রী, তাই এরা কখনই চায় না ছাত্ররা সহজে তেমন নাম্বার পেয়ে যাক। তাই একটা ছেলে যখন টপ সিজিপিএ পাবে, তখন সে প্রাইভেটের হলেও প্রশংসার দাবী রাখে। ]
পাবলিকে ল্যাবের সুযোগ অনেক থাকে। কিন্তু, সব বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না [অবশ্যই সব ভার্সিটির কথা বলছি না। ]।
আবার, প্রাইভেটে তার উলটা। তাছাড়া, সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সবখানেই।
[ক্রেডিট আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার সাবজেক্টের ক্রেডিট সংখ্যা বেশি,তার আলাদা দাম থাকতে বাধ্য। পাবলিকের ছেলেদের অনেক বিষয়ের উপর নিজেরই গবেষণার সুযোগ থাকে, কিন্তু প্রাইভেটে সে সুযোগ থাকে না।
তবে, অনেকে ভাবে এরা তো শুধু নোট পড়েই খালাস। তবে, এ ব্যাপারে আমি ছোট্ট একটা ব্যাখ্যা দিতে চাই। ‘ফিজিক্স ফর ইঞ্জিনিয়ার্স’ বইটাতে অধ্যায় আছে ৩০ টা !!!!! সেখানে এটার জন্য সময় পাইছি ৪ মাস মাত্র। স্যার কী পুরোটা পড়াবেন ? আমার সাবজেক্টের সাথে কিছুটা সংশ্লিষ্ট মোট ১০ টা অধ্যায় পড়ালেন। ১,৪,৫,৯,১২,১৯,২৩,২৫,২৯,৩০ তম অধ্যায়।
এতেই হিমশিম খাচ্ছি। এখন কথা হল, এই যে ১২ তম এর পড়ে ১৯ তম অধ্যায় পড়তে হল,হয়ত ১৭,১৮ তম অধ্যায়ে অনেক সূত্র ছিল যা ১৯ তম অধ্যায়ে কাজে লেগেছে। সেটা তো আমরা জানলাম না। এখন তাহলে এই অধ্যায়ের অংকগুলো কীভাবে করব?থিওরীগুলোর প্রমাণও বুঝতেছি না। এ কারণেই দরকারমত স্যার নোট বা শিট দেন, যেখানে বইয়ের প্রশ্নটাই অনেক ব্যাখ্যাসহ দেয়া থাকে।
অনেকে এটা বুঝে না, এটা নিয়েই প্রাইভেটকে হেয় করে। ]
[সর্বপরি,প্রাইভেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার মতে পর্যাপ্ত ল্যাব থাকা না থাকা। কোন প্রাইভেট ভার্সিটি এটাকে কাটিয়ে উঠলে তাকে আর হেয় করা যাবে না। আর,পাবলিকের সমস্যা আমার মতে,সেশন জট। ]
[মাঝে মাঝে প্রাইভেটে কিছু গণ্ডমূর্খর দেখা মেলে, পাবলিকে তা মিলবেনা।
তবে, এটাকে নেগেটিভ মাইন্ডে না ভাবলেও চলে। কারণ, দেশের প্রথম সারির অর্থাৎ সবচেয়ে মেধাবী ছেলেগুলোকে নেয় পাবলিক ভার্সিটি। এরা যদি দারুণ ডাক্তারে পরিণত হয়, তবে খুব কী অবাক হওয়ার কিছু আছে !! আর, দ্বিতীয়,তৃতীয় সারির কিছু ছেলেকে নিয়ে এদের মাঝে কয়েকজনকেও যদি প্রাইভেট ভার্সিটি ভাল ডাক্তার বানাতে পারে, তাহলে আসলেই অবাক হতে হয়। তবে, এক্ষেত্রে ভার্সিটির মান যত ভাল হবে, এধরণের ছেলেদের সংখ্যাও বাড়বে। ]
আমি মনে করি, একটা ছেলে বুয়েটে পড়ে, আর একটা ছেলে রাবিতে দর্শন পড়ে, এদের দুজনকেই ‘পাবলিকে পড়ে’ এই কথা বলে ছাত্র হিসেবে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়না।
আবার,একই কারণে প্রাইভেটের একটা ভাল ছাত্রকে ‘প্রাইভেটে পড়ে’ বলে রাবির দর্শনের ছেলেটার পিছনে ফেলা যায় না। মানুষ হিসেবে সবাই সমান হলেও ছাত্র হিসেবে সবাইকে আলাদা জায়গা দিতে হবে। কে কেমন ছাত্র তা এখনকার যুগে সে কোন ইন্সটিউটে পড়ে,সেটা দিয়ে বিচার করা যায় না। কেউ পড়াশুনা না করলে কোথাও তার জায়গা হবে না, এখন আমি পাবলিকে আর প্রাইভেটে যেখানেই পড়ুক না কেন!! ইন্সটিউটের নাম বেঁচে খুব বেশিদিন খাওয়া যায় না। তাই কে কোথায় পড়ে সেটা দিয়ে বিয়ার না করে, আমাদের উচিত ‘কে কেমন’ সেটা দিয়ে তার বিচার করা।
[কোন ভাবেই কাউকে ছোট করার জন্য এ লেখা না। তাও কেউ যদি কোন দিক থেকে আহত হন, তাহলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।