আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পয়লা বৈশাখের উৎসব এবং এক গ্লাস কোকাকোলা



দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে আজ মহাউৎসব, মহাধুমধাম। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এ উৎসব। শুরু বছরের নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, শেষ গভীর রাতে। নাচ-গান-অভিনয়-আবৃত্তির মধ্য দিয়ে নতুন সূর্যোদয়কে বরণ করে নেয়া।

চলে পান্তা খাওয়ার ধুম। পানিতে ভেজানো ভাত, সঙ্গে আলু ভর্তা, পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা ও ইলিশ মাছ ভাজি। দুপুরে খিচুড়ি, সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার শাক ভাজি, বিভিন্ন প্রকার ভর্তা, মাছ এবং মাংসের তরকারি সবশেষে দই ও পায়েস। এ দিনের পোশাক অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। ছেলেদের পাজামা-পাঞ্জাবি।

তরুণীদের ঢোল-কর্তাল-বাঁশি-একতারা-দোতারা-প্রত্যন্ত গ্রামের দৃশ্য ইত্যাদি সংবলিত সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বিশাল মিছিলে যোগদান। সে মিছিলে চারুর ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকদের অঙ্কিত বাংলার নদীনালা, গাছ-গাছালি, ঘরবাড়ির দৃশ্যাবলি এবং জীবজন্তু-জানোয়ারের মূর্তি দেখা যায়। জায়গায় জায়গায় বসে যায় মেলা। হাতে তৈরি নানা ধরনের দ্রব্য ও খাবার মেলায় বিক্রি হয়।

সে সব জিনিস দেখলে বাংলার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার একটা স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। এই মেলা যেন বাংলার মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। মাটির পুতুল, পাটের শিকা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝার, ঝিনুকের মালা, বৈচির মালা, পুতির মালা, মাছ ধরার পলো, দাও, কুড়াল, বর্সা, লাটিম এবং বাতাসা, মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, কদমা, রসগোল্লা ইত্যাদি কত না অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তখন মনে হবে এ সব জিনিস আমাদেরই পূর্ব-পুরুষরা এক সময়ে ব্যবহার করতেন। যদিও আধুনিক সমাজে আজ আমরা এ সব থেকে অনেক দূরে।

রাতের আয়োজন কবিগান, ভাটিয়ালী, মুর্শিদি, জারি-সারি ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে এবং টিভি চ্যানেলে। দৈনিক পত্রিকাগুলোও বাংলার হরেক রকম লেখা নানা রঙে বিশেষ সংখ্যা ছাপিয়ে থাকে। দিনভর উৎসবের আনন্দ হিল্লোলের মধ্য দিয়ে নতুন বছর পয়লা বৈশাখকে বরণ করা হয় এবং প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে কোনোই ব্যত্যয় ঘটে না। উৎসব মাত্র একদিনের। কিন্তু এই একটি দিনের জন্য প্রস্তুতি চলে মাসাধিক সময় ধরে।

তাতে কারো কোনো ক্লান্তি লক্ষ্য করা যায় না। যার যতটুকু সামর্থ্য সেই সামর্থ্যরে মধ্যেই অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও খাওয়া-দাওয়া মেলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে উৎসব সীমাবদ্ধ ছিল। ইদানীং দেখা যাচ্ছে ছোটো-বড় সবার নতুন কাপড়-চোপড় বানানোর ধুম পড়ে যায়। এতে বোঝা যায় পয়লা বৈশাখকে হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেয়ার পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও দেখা যায়, বিষয়টি সম্পূর্ণ গ্রামীণ হলেও শহরের অলিতে-গলিতে বিষয়টির আবেদন ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ধ্বনি হোক দরিদ্র হোক, শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক বাঙালি মাত্রেই এ দিনে উৎসবে মাতোয়ারা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কেন সব মানুষ এই একটি দিনের জন্য অমন পাগলপারা হয়ে ওঠে। কবে থেকেই বা এই ধারার সূচনা হলো। ‘কয়েক শতাব্দী ধরে বাঙালি পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উপলক্ষে যে পুঞ্জিভূত আনন্দে অবগাহন করে তার উদ্ভব হয়েছিল ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের আমলে।

সম্রাট আকবর নবরত সভার আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন একটি নির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঠিক করে দিতে, যাতে ওই নির্দিষ্ট সময়ে প্রজারা জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করতে পারে। ১৫৫৬ সালে পয়লা বৈশাখকে নির্দিষ্ট করে খাজনা পরিশোধের যে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল, মূলত সেটা ছিল ফসলি সন। খাজনা পরিশোধ করা মানে কষ্ট ও কৃচ্ছ্রতার ব্যাপার। জমিদারদের জন্য হলো সে দিনটি মহাআনন্দের। জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য করত পুণ্যাহ অনুষ্ঠান।

প্রজাদের অবস্থা তো বোঝাই যায়। যে কোনোভাবেই হোক জমিদারের খাজনা সুদে-আসলে পরিশোধ করতেই হবে। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করলে তো হবে না, বছরের এই দিনে তাদের ভালো আপ্যায়নও করাতে হবে। মিষ্টিমুখ করানো, পান-সুপারি মুখে বিদায় হতো প্রজা। শুধু জমিদারদের বাড়িতেই যে ভালো খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত হতো তা কিন্তু নয়।

গাঁও-গেরামের ঘরে ঘরে যার যার সাধ্যমতো একটু ভালো খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত হতো। পয়লা বৈশাখ মানে হালখাতার উৎসব। সারাবছর বিকিকিনির ফর্দ মেলাতে ব্যস্ত হবে ব্যবসায়ী। পাওনাদেনা কতটুকু পরিশোধ হলো, কত টাকাইবা বকেয়া রইলো তার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ব্যবসায়ী। নিজ প্রতিষ্ঠানকে ঝেড়ে-মুছে তকতকে করে লম্বা টুল-টেবিল বিছিয়ে দাও।

রঙিন কাগজের ঝালর দোকানের চারদিকে মালার মতো ঝুলিয়ে দাও। দোকানের চালে বাঁধো লাউড স্পিকার। রেকর্ড বাজছে- ‘আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি...’। আরও কতো গান। ক্যাশবাক্সের সামনে বসে আছে দোকানের ম্যানেজার।

টাকা পরিশোধের পর টুপ করে বসে যায় লম্বা টুলটায়। সাভারের মিষ্টি আহা কতদিন খাইনি। দাদার সঙ্গে নাতিও এসেছে। গত বছরের হিসাব-নিকাশ শেষ। আবার অছিমুদ্দিনের নামে নতুন হিসাব খোলা হলো।

চালের উপর উড়ছে গদিসাইদের পতাকা। লাউড স্পিকারে বাজছে চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির গান। ‘আগে কলকাতায় পয়লা বৈশাখ ছিল মধ্যবিত্তের বৈঠকি উৎসব। ক্রমশ তা বৈঠকখানা পেরিয়ে মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে পড়ে নববর্ষ উৎসবের নাগরিক চেহারায় রূপান্তর ঘটে।

গ্রামাঞ্চলের মেলা বা উৎসবের পাশাপাশি শহরাঞ্চলে ইংরেজি নববর্ষের কায়দায় নববর্ষের উৎসের রূপান্তর হয়। ইংরেজি নিউ ইয়ার্স গ্রিটিংস কার্ডের মতো শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড মুদ্রণ ও বিতরণ (বিনিময় ) শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ শহরাঞ্চলে এখন পুরোপুরি একটি আধুনিক নাগরিক উৎসব। .... ........করাচি ও লাহোর থেকে কিছু উর্দুভাষী আলেম ছাপমারা ব্যক্তিকে ঢাকায় পাঠিয়ে প্রচার চালানো হতো বাংলা নববর্ষ, নবান্ন শারদ বা বসন্ত উৎসব পালন করা মুসলমানদের জন্য বেদাত (ধর্মবিরোধী) কাজ। ১৯৫৩ সালে করাচি থেকে পাঠানো পাকিস্তানের এক ধর্মীয় পীর আল্লামা সোলায়মান নদভি ঢাকায় এসে কার্জন হলের সমাবেশে এ ধরনের ফতোয়া দিয়ে বাঙালি ছাত্রদের হাতে প্রহৃত হওয়ার ভয়ে পুলিশ পাহারায় পলায়ন করেন।

একথা সত্য, সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের পর বাংলার পূর্বাংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ দ্রুততর হয়। রাজধানী ঢাকায় সামন্তযুগীয় কালচারেও আধুনিক নগর সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। প্রথমে কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাড়িতে সন্তর্পণে ও ঘরোয়াভাবে বাংলা নববর্ষ উৎসব পালন শুরু হয়। গ্রাম্যমেলা বা উৎসবের খোলস পাল্টে শহরগুলোতে নববর্ষ উৎসব শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নাগরিক উৎসব হয়ে ওঠে। তাতে সাধারণ জনসমাজও যোগ দিতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে।

এটা আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে মুক্তবুদ্ধির প্রয়াত পুরুষ ওয়াহিদ উল হক ও তার স্ত্রী সনজিদা খাতুনের নেতৃত্বে প্রাথমিকভাবে রবীন্দ্রসংগীত প্রসারের জন্য প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট সংগীত স্কুল কাজ শুরু করার পর। ঢাকায় রমনার বটমূলে, নারিন্দার বলধা গার্ডেনে বাংলা নববর্ষ, শারদ ও বসন্ত উৎসব পালন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে”। আজও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ। আজও এ দেশের শিক্ষার হার সন্তোষজনক নয়। আজও লোকসংখ্যার ৬০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।

আজও দেশে বেকারের সংখ্যা ৪ কোটির মতো। আজও দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অপ্রতুল হওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আশানুরূপ গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই রয়েছে, এসবের মধ্যেও দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকে। উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে।

তবে কি, একটি দিনের জন্য হলেও তারা সব দুঃখ সব বেদনা, সব গ্লানি ভুলে থাকতে চায়; অতীত আদলটাকে একবারের জন্য হলেও ঝালিয়ে নিতে চায়। দেশবাসীর এই হৃদয় নিঙরানো আগ্রহকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব। অনেকে আবার এ প্রশ্নও তোলে কি হবে অতীতের আদল আরেকবার দেখে নিয়ে, আমরা তো অতীতকে দূরে ঠেলে দিয়ে আধুনিকতার রসে সিক্ত হচ্ছি। দিন যতই এগুচ্ছে পশ্চিমা কালচার ততই আমাদের অতি পছন্দের অতিপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমনকি বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে পর্যন্ত আমরা বিদেশ আদলে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি।

চেষ্টা করছি পান্তা খাওয়ার পর এক গ্লাস কোক খেতে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।