চেনা পথ , অচেনা সহযাত্রী
ফকির ইলিয়াস
=======================================
খুব দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একজন মানুষ চলছে। পথটি তার অপরিচিত নয়। এ পথ দিয়ে হেঁটে গেছেন- পিতা, পিতামহ। পূর্বপুরুষের পদছাপ গোনে গোনে মানুষটি চলছে; কিন্তু তার প্রতিবেশ নতুন। চারপাশে নতুন মুখ, নতুন দীনতার ছাপ।
এই দীনতা, সংস্কৃতির সংকটের। এই অভাব অর্থনৈতিক হলেও মূলত নৈতিকতার। এক ধরনের মিশ্রণ এসে রঙ পাল্টে দিয়েছে নিজের গতিপথের। তাই পথের সহযাত্রীরা, মানুষটির কাছে শুধু অচেনাই নয়, প্রতিপক্ষও বটে। একই সমাজে বসবাস করেও মানুষ কীভাবে মানুষের প্রতিপক্ষ হতে পারে- সে উদাহরণ আমরা প্রায় সবসময়ই দেখি।
দেখি বিভিন্ন সমাজে। বিভিন্ন দেশে। তবে বহুজাতিক, বহুভাষিক দেশে তা দেখা যায় একভাবে। আর একই জাতিক, একই ভাষিক রাষ্ট্রে তা দেখা যায় অন্যভাবে। তারপর যদি কোনো রাষ্ট্রে গোঁড়া কট্টরবাদিতার গোড়াপত্তন হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
পোশাক-পরিচ্ছদ, মানুষের নিজের সংস্কৃতি, সভ্যতার একটি পরিচয় বহন করে বটে। তবে তা প্রধান পরিচয় নয়। কিন্তু কেউ যদি ধর্মীয় লোকাচারের দোহাই দিয়ে পোশাককেই ধর্মের প্রধান পর্দা বলে বিবেচনা করতে চায়, তবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তা কতটুকু গ্রহণ করবে? কতটুকু গ্রহণ করা উচিত? একটি ছোট্ট ঘটনা। গত কিছুদিন আগে কানাডায় একটি নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটেছে। পাকিস্তানের একজন অভিবাসী কানাডিয়ান পিতা, হিজাব না পরার জন্য তার ষোড়শী কন্যাকে খুন করেছে নির্মমভাবে।
মেয়েটির অপরাধ, সে হিজাব পরতে চায়নি। পিতার সঙ্গে বাকবিতন্ডার চরম পর্যায়ে মেয়েটিকে প্রাণ দিতে হয়। কী নির্মম নিয়তি! কী নির্মম মানসিকতা! প্রশ্ন হচ্ছে, হিজাব পরলেই কি মেয়েটি পূতঃপবিত্র হয়ে যেতে পারত? কিংবা সৎ ও মহৎ হয়ে যেত? না, এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশে মহিলারা মাথায় হিজাব বাঁধেন। বর্তমান সময়ে, অনেকে আবার তা বাঁধেনও না।
জিন্সের প্যান্ট, জ্যাকেট এখন আধুনিক আরব মেয়েদের গায়ে। আর সেসব মেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় বেড়াতে এলে কী পোশাক-আশাক এখানে এসে পরে, তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, নিজ রাষ্ট্রের বাইরে বেরিয়েই তারা কিছুটা হলেও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানোর চেষ্টা করছে? কেন করছে? কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তাদের এক ধরনের বন্দিত্বের শিকল পরানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে নিরন্তর। আর তারা মুক্তি খুঁজতে চাইছে সেই বন্দিত্ব থেকে। এখানেও একে অন্যের প্রতিপক্ষ।
এক সময় ছিল আরব মুল্লুকের প্রায় সব অফিস, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কোম্পানিতে বিদেশি শ্রমজীবী, পেশাজীবীদের প্রাধান্য ছিল। এখন তা ক্রমেই কমছে। ওসব দেশের স্থানীয় নাগরিকরা কাজের দায়িত্ব নিচ্ছে। নিতে এগিয়ে আসছে। সে সঙ্গে সেসব দেশের মানুষও ত্রক্রমেই আদিমতাকে ডিঙিয়ে আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছে।
বৈষম্যের দূরত্ব বাড়লেও মানুষ গ্রহণ-বর্জনের বিবেককে সংহত করতে পারছে। আর এটাই আপাতত তাদের বড় পাওয়া।
সৃজনশীলতার পক্ষে পাওয়ার মাঝে ,প্রজন্মকে নিবিষ্ট রাখার এি যে প্রত্যয়,
তা হোচট কেলেই সমাজ বিচ্যুত হয়। ধর্ম যাজকরা সুযোগ নিয়ে মানুষের কাছে আসে। এবং ধর্ম ও সংস্কৃতির সহজ মিশ্রন ঘটিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পায়।
বহু জাতিক কোনো দেশে রাষ্ট্রীয় আইন বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করে। আর করে বলেই সবাই নিজ নিয়মে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে সহজ ও সাবলীলভাবে। পাশাপাশি মানুষ ভোগ করতে পারে ধর্মীয় স্বাধীনতাও । কিন্তু একক আধিপত্যবাদী কোনো দেশে
প্রতাপশালীরা অন্যকে জব্দ করে রাখতে চায়। অথবা ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে
রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কৃতির গায়ে ধর্মের লেবাস লাগাতে চায়।
ধরা যাক বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির বৈশাখবরণ অনুষ্ঠানের কথা। বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। এর সঙ্গে বাঙালি জাতির প্রকৃতিগত চেতনা জড়িত। কিন্তু দেখা গেল, এই বৈশাখবরণ অনুষ্ঠানে মানুষের সম্মিলনকেও একটি মহল মেনে নিচ্ছে না। নিতে পারছে না।
কেন পারছে না? কারণ এরা মনে করে মানুষের সংস্কৃতিগত ভিত মজবুত হয়ে গেলে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে কট্টরবাদিতা করতে পারবে না। মানুষের ঐতিহ্যগত চেতনার বহিঃপ্রকাশ এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সে জন্যই তারা খোঁড়া করে রাখতে চায়। জাতীয় পরিচয়কে ধর্ম দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা এ সমাজে নতুন নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,যারা এই সমাজের মহান ধর্মগুলোর প্রণেতা , - সুবিধাবাদীরা তাঁদের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে
বিভিন্ন সময়ে। নিজে পালন করুক আর না করুক,দুর্বলচিত্ত মানুষের স্বল্প শিক্ষিত চেতনা কিংবা মূর্খতার সুযোগ নিয়েছে এই চক্র।
একটি রাষ্ট্রে কোনো স্থাপত্য শিল্প ভেঙে দেয়া কিংবা একটি চিত্র শিল্পকে ব্যান করার
দাবীও তুলেছে এইসব কালো শক্তি । স্থাপত্যশিল্পকে এরা মূর্তির সাথে তুলনা করে ধর্মীয় উন্মাদনার স্রোত তৈরি করতে চাইছে কৌশলে।
মানুষ তার নির্মিত সমাজের কল্যাণে বিভিন্ন পথ তৈরি করেই যাচ্ছে। সেই পথগুলোর কুসুমাস্তীর্ণ দিক যেমন আছে তেমনি আছে কণ্টকাকীর্ণ দিকও। বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ভার্চুয়াল জগৎটিকে এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায়।
ইন্টারনেটের কল্যাণে সব বয়সী মানুষ এখন ক্রমেই ঝুঁকছে এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের দিকে। নেটের জানালায় বসে দু’জন আড্ডা দিচ্ছে বিশ্বের দুই প্রান্তে বসে। অনেক সময় এরা নিক নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত মানুষটি সম্পর্কে থেকে যায় সম্পুর্ণই অজ্ঞ। তারপরও কথা চলে, আড্ডা চলে। বিনিময় হয় ভাব।
মতবিনিময়। এমনকি প্রেমও। এই ভার্চুয়াল জগতেরও ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। রয়েছে অনেক আত্মবিধ্বংসী কর্মকান্ডও। সন্ত্রাসীচক্র তাদের হুমকি কিংবা অপকর্মের দায় স্বীকার যেমন ইন্টারনেটে করছে, একজন গবেষক-বিজ্ঞানী তার নতুন আবিষ্কারটিও জানিয়ে দিতে পারছেন গোটা বিশ্বকে এ আন্তর্জালের কল্যাণেই।
পথের এই যে বিবর্তন ঘটছে, এর যোগাত্মক দিকগুলো ধারণ করাই আজ হওয়া উচিত প্রজন্মের প্রধান প্রত্যয়। কারণ সমাজে নষ্ট কীটদের অভাব আগেও ছিল না, এখনো নেই। ইন্টারনেটের ধূপচুল্লিতে পুড়েই হোক আর সোঁদা মাটির উষ্ণতা বুকে ধারণ করেই হোক, প্রজন্মকে চলতে হবে নিজেকে বাঁচিয়ে। কারণ চলমান পথের যে কোনো দুর্জন সহযাত্রী যে কাউকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিতে পারে। সংঘবদ্ধ হয়ে এরা হতে পারে কোনো রাষ্ট্রের-জাতির জন্য শংকার কারণ।
আমার কেন জানি মনে হয় , গোটা বিশ্বের মানব সমাজই এখন ছোট ছোট
গর্তের মুখোমুখি। বেড়েই চলেছে অচেনা সহযাত্রীর সংখ্যা।
-------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সমকাল । ঢাকা। ১০ এপ্রিল ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি - ক্যাথি রীড
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।