সময় পোড়া বাতিঘর। ঘাটের এই পারে বসে আছি ঐ পারে যাওয়ার অপেক্ষা। মুসাফিরের ব্লগ। প্রথমঃ
বাদশার খাসকামরা পরিচ্ছন্ন করছে বাদি। সুন্দর চন্দন কাঠের পালঙক।
ফরাশের উপর পরচ্ছন্ন নকশাদার চাদর বিছানো। পুরো ঘর পরিস্কার করা হলে একসময় বাদি ক্লান্ত হয়ে বিছানার ওপর গা এলিয়ে দেয়। আর নিজের শরীর প্রতারণা করে নিজের সাথে। নরম বিছানার আবেশে বাদী ঘুমিয়ে পড়ে। ঠিক এ সময় রাণীমাতা ঘরে প্রবেশ করেন।
বাদিকে নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়েন। সাথে সাথে বাদীর চুল ধরে চাবুক দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। একসময় রাণীমাতা ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত হন।
এ সময় বাদশা রুমে প্রবেশ করেন। ক্ষমাশীল বাদশা ক্রন্দনরত বাদীকে সান্ত্বনা দেন।
বাদশা বলেন-
কাঁদিস না, খুব কষ্ট পেয়েছিস।
জ্বি , খুব কষ্ট পাচ্ছি। খুব যন্ত্রণা পাচ্ছি। তবে নিজের জন্য না।
নিজের জন্য না, তবে কার জন্য।
আপনার আর রাণী মাতার জন্য।
তার মানে, আমাদের জন্য তুই কষ্ট পাবি কেন?
আচ্ছা রাণীমা,আমি কতক্ষণ বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলাম, বলতে পারেন?
রাণীবলেন, হয়তোবা দু মিনিট হবে।
আর আমাকে কতবার চাবুক দিয়ে আঘাত করেছেন?
জানিনা, হবে হয়তো ২০ বার।
সেই জন্যই এতো যন্ত্রণা পাচ্ছি। শুধু দুমিনিটের ঘুমের জন্য যদি ২০ বার আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করেন, তবে এ বিছানায় কত বছর যে আপনারা ঘুমাচ্ছেন তার জন্য কত সহস্র চাবুকের আঘাত যে আপনাদের জন্য বিধাতা রেখে দিয়েছেন, তা চিন্তা করেই বাদশা নামদার এতো যন্ত্রণা পাচ্ছি।
দ্বিতীয়ঃ
একজন মুসাফির বাদশার দরবারে এসেছেন সাহায্যের জন্য।
এসে দেখেন, বাদশা প্রাসাদে নেই। বাদশা মসজিদে প্রার্থণারত। মুসাফির মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব নির্জন মসজিদে একাকি বাদশা আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বসে আছেন।
মুসাফির বাদশার প্রার্থণার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বাইরে অপেক্ষায় থাকে। একসময় বাদশার প্রার্থণা শেষ হয়। বাইরে এসে দেখেন জনৈক মুসাফির মসজিদ প্রাঙন থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। বাদশা মনে করলেন- কেউ হয়তোবা তার সাথে সাক্ষাতে এসেছিলেন। তাই, পিছন থেকে ডাক দেন।
ডাক শুনে মুসাফির বাদশার সামনে এসে সালাম করেন।
আপনি কি আমার কাছে কোনো সাহায্যের জন্য এসেছিলেন?
জ্বি, বাদশা। সাহায্যের জন্যই এসেছিলাম।
তবে, সাহায্য না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন কেন?
কারণ,আমার ভুল ভেঙে গেছে। আর আমি ভুল জায়গায় এসেছি।
তার মানে।
কারণ, আমি যার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলাম, সেইতো দেখি দু হাত তোলে আরেকজনের কাছে ভিক্ষা চাইছে। যে নিজের জন্য ভিক্ষা চাইছে,সে আমাকে কি সাহায্য করবে। বরং সে যার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছে,আমারও উচিত শুধু তার কাছেই সাহায্য চাওয়া। তাই ফিরে যাচ্ছি।
তৃতীয়ঃ
এক বনে ছোট তিনটি চারা গাছ ছিলো।
প্রথম চারা গাছের স্বপ্ন ছিলো-বড় হয়ে সে জন্য সবচেয়ে মহামূল্যবান রত্নকে বুকে ধারণ করে। সোনা, মণি, মানিক রাখার যেন সে পাত্র হয়।
২য় চারা গাছের স্বপ্ন ছিলো-পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত বাদশাকে যেন সে বহন করে।
৩য় চারা গাছের স্বপ্ন ছিলো-সে যেন সবচেয়ে উচ্চাসনে সমাসীন হয়।
একসময় তিনটি চারা গাছ বড় বৃক্ষে পরিণত হলো। একদিন বনে কাঠুরিয়া আসলো। প্রথম বৃক্ষটিকে কেটে কাঠের কারখানায় এনে পশুর খাবার খাওয়ার জন্য বড় বাক্স তৈরী করলো। এতে প্রথম বৃক্ষ খুব অসন্তুষ্ট হয়।
২য় বৃক্ষকে কাঠুরিয়ারা কেটে এনে ছোট একটি নৌকা বানিয়ে ছোট একটি খালে রাখে।
২য় বৃক্ষটিও খুব অসন্তুষ্ট হয়।
আর ৩য় বৃক্ষটিকে কেটে কাঠুরিয়ারা কিছুই করলোনা, বনে ফেলে রেখে অন্য গাছ কাটতে চলে গেলো। ৩য় বৃক্ষটিও খুব অসন্তুষ্ট হয়।
অনেকদিন পর, বৃক্ষরা তাদের নিজ নিজ স্বপ্নের কথা ভুলে গেছে।
গবাদি পশু মারা যাওয়ার পর খাবারের পাত্রটি আছে একেবারে পরিত্যক্ত হয়ে।
এসময় দরিদ্র কিষাণীর ঘরে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক সন্তান। কিন্তু এতো দরিদ্রযে, শিশুর জন্য বাজার থেকে দোলনা কিনার কোনো অর্থ তাদের নেই। তাই তারা গবাদি পশুর জন্য খাবারের পাত্রটিকেই নতুন শিশুর জন্য দোলনা হিসাবে ব্যবহার করলো। প্রথম বৃক্ষটি খুব আনন্দিত হয়। তার স্বপন পূরণ হলো, এর চেয়ে নিজের বুকে ধারণ করার জন্য মহামূল্যবান ধন আর কি হতে পারে।
একজন পতিতা নগর ছেড়ে এক বছর পর একটু নির্জন এলাকা দিয়ে একা একা হেঁটে গ্রামে ফিরছে। হঠাৎ ঝোপের আড়ালে শুনে বাচ্ছার কান্নার আওয়াজ। পতিতা কান্নার শব্দ শুনে বাচ্চার কাছে আসে। তারপর আদর করে কোলে নেয়। বুকের সাথে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে।
একসময় খালের পাশে আসে। পাশে এসে নৌকার মাঝিকে জিগ্গাসা করে, শিশুর জন্য দুধ কোথায় পাওয়া যায়। নৌকার মাঝি বলে, খালের ঐ পাড়ে গোয়ালিনীর ঘর আছে, সেখানে । পতিতা বাচ্চাটিকে নিয়ে নৌকায় ওঠে। ২য় বৃক্ষটির স্বপ্ন এবার পূরণ হয়।
বনের নির্জনে পথের ধারে ফেলে যাওয়া নবজাত শিশুকে যে কুড়িয়ে পরম মমতায় বুকে আগলে ধরে সে সম্রাট না হতে পারে, কিন্তু সে যে পৃথিবীর বড় সম্রাগ্গি । ২য় বৃক্ষ সেই মহান সম্রাগ্গিকে বুকে নিয়ে বহন করছে এর চেয়ে বড় আনন্দ তার আর কি হতে পারে।
গভীর রাত। কাঠুরিয়ার বউ ওঠোনের চুলোয় খাবার চাপিয়ে বসে আছে। রান্নার জন্য কোনো জ্বালানি কাঠ নেই।
অভুক্ত শিশুরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এমন সময় কাঠুরে জ্বালানি কাঠ নিয়ে ঘরে আসে। চুলোয় জ্বালানি কাঠ জ্বলতে থাকে। ৩য় কাঠ জ্বলে জ্বলে ধোঁয়া হয়ে ওপরে ওঠে। ৩য় কাঠের আনন্দের আর শেষ নেই।
তার স্বপ্নও যে পূরণ হয়েছে।
চতুর্থঃ
দরবেশ তার শিষ্যদের নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় দেখেন-এক মহিলাকে তাড়া করছে কিছু পুরুষ। মহিলাটি দরবেশের কাছে এসে আশ্রয় চায়।
দরবেশ লোকদের থামিয়ে জিগ্গাসা করেন-
কী হয়েছে, তোমরা এ মহিলার পিছু নিয়েছো কেন?
লোকদের সর্দার বলে-এ মহিলা বড় গুনাহের কাজ করেছে, তাই একে পাথর ছুড়ে মৃত্যু দন্ড দিবো।
,
দরবেশ বলেন- পাথর ছুড়বে কে?
লোকগুলো বলে, কেন আমরা সবাই।
এবার দরবেশ বলেন- মহিলা গুনাহ করেছেতো, তাই তোমরা পাথর ছুড়ে ওকে মারবে। তাহলে, তোমাদের মাঝে এমন একজন পাথর হাতে তুলে নাও যে কোনো গুনাহ করোনি ?
পন্চমঃ
সাধুবাবা, গভীর বনে নির্জনে ধ্যানে মগ্ন। এমন সময় তার সামনে দিয়ে ছুটে চললো এক ক্ষ্যাপা। সাধু বাবার ধ্যান ভগ্ন হলো।
উনি ক্ষ্যাপাকে তিরষ্কার করা শুরু করলেন-
তুই আমার ধ্যান ভাঙালি কেন?
আপনি কার ধ্যান করেন সাধু বাবা?
কেন? শ্রষ্ঠার ধ্যান, বিধাতার ধ্যান।
আহারে, সাধু বাবা! আমি সাধারণ এক নারীর ধ্যানে পাগল হয়ে আপনাকে দেখিনি, আর আপনি পরম শ্রষ্ঠার ধ্যানে সাধু হয়ে আমাকে দেখলেন?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।