সুখি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বিবেক হীন হওয়া।
আফ্রিকার দেশ ঘানার দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল কেপকোস্টের ‘ এলমিনা’ নামক স্থানে অবস্থিত ক্যাসলটির নাম ‘ সেন্ট জর্জ এলমিনা' ; তবে ইতিহাসবিদ এবং পর্যটকদের নিকট এটি ‘ এলমিনা ক্যাসল’ হিসাবেই অধিক পরিচিত।
কেপকোস্ট শহরটি অবস্থান রাজধানী আক্রা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পশ্চিমে। সড়ক পথে আক্রা থেকে কেপকোস্ট যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের ‘ TRANS ATLANTIC SLAVE TRADES’ অর্থাৎ ক্রীতদাস ব্যবসার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসাবে অ্যাটলান্টিকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এ দুর্গটি।
যারা এ অঞ্চলের দাস ব্যবসার ইতিহাস জানেন তারা এখানে এসে দুর্গের অন্ধকার কুঠুরিতে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে অনুভব করতে পারবেন কি অবর্ণনীয় আর মর্মান্তিক ছিল সে সব ভাগ্যাহত ক্রীতদাসদের জীবন কাহিনী। দুর্গের দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায় আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলা ক্রীতদাসদের আহাজারি আর ক্রন্দনের ধ্বনি – প্রতিধ্বনি।
ইউনেস্কো কর্তৃক এ ক্যাসলটিকে ‘ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৯০ সালে ঘানা সরকার স্থাপনাটির প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে। এটিকে এখন পরিনত করা হয়েছে এদেশের জাতীয় জাদুঘরে।
এলমিনা শহরটি মূলত একটি মৎস্য আরোহণ কেন্দ্র। ক্যাসলের ছাদে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে সারি সারি হাজার হাজার জেলে নৌকা।
উর্বর কৃষি ভূমি , সোনা, আইভরি আর মূল্যবান কাঠের লোভে আফ্রিকার এই উপকূলে সর্ব প্রথম ১৪৭১ সালে পদার্পণ করে পর্তুগীজরা। পর্তুগীজ প্রিন্স হেনরি ছিলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি এ এলাকার নাম দেন ‘ গোল্ড কোস্ট’ ; পর্তুগীজদের উদ্দেশ্য ছিল ইন্ডিয়া হয়ে এশিয়ায় তাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য দক্ষিণের এ পথটিকে উন্মুক্ত করা, যাতে আরব বণিকদের এ অঞ্চল থেকে হটিয়ে বিদেয় করা যায়।
বাণিজ্যের পাশাপাশি এ অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার ও ছিল তাদের আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এলমিনা ক্যাসলটি অবশ্য ক্রীতদাস ব্যবসা পরিচালনার জন্য নির্মাণ করা হয়নি। প্রাথমিক অবস্থায় এটি নির্মিত হয় সোনা, আইভরি, টিম্বার ইত্যাদি ব্যবসা পরিচালনার জন্য। এ কারণে অত্যন্ত সুরক্ষিত করে তৈরি করা হয় এ দুর্গ টি
ইউরোপিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী আর শত্রু ভাবাপন্ন আফ্রিকানদের নৌ পথের আক্রমণ ঠেকাতে দুর্গটির ছাদে চারিদিকে স্থাপন করা হয় কামান।
মূল দুর্গে যেতে হলে লোহার পাটাতনের মত একটি ব্রিজ পার হয়ে যেতে হয়।
অধিক নিরাপত্তার জন্য রাত্রি বেলায় এ ব্রিজটিকে সরিয়ে বিছিন্ন করে দেয়া হত দুর্গের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ । ১৪৮১ সালে পর্তুগীজ রাজা জোআও – ২ এলমিনা ক্যাসল নির্মাণের অভিপ্রায়ে ডিয়েগো আজাম্বুজা’র নেতৃত্বে যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী ভর্তি জাহাজের বহর গোল্ড কোস্টে প্রেরণ করেন । ঐতিহাসিকগণ দাবী করেন ওই নৌবহরে নাকি নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও ছিলেন। আজাম্বুজা ক্যাসল নির্মাণে স্থানীয় লোকজন ও উপজাতীয় গোত্রের বাধার মুখে পড়েন। কিছু প্রাণহানিও ঘটে তখন।
কিন্তু আফ্রিকান রাজা ও স্থানীয় গোত্র প্রধানদের সাথে দেন দরবার করে আজাম্বুজা তড়িঘড়ি করে ক্যাসল নির্মাণকাজ শুরু করতে সমর্থ হন। নৌ বহরে পর্যাপ্ত জনবল এবং রেডিমেড নির্মাণ সামগ্রী থাকায় ক্যাসল নির্মাণে তাকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
এত শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্বেও ১৬৩৭ সালে এলমিনা ক্যাসল পর্তুগীজদের নিকট থেকে হাতছাড়া হয়ে যায়। এটি চলে আসে ডাচদের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতার পালা বদলে এটি পরবর্তীতে ব্রিটিশ মালিকানায় আসে ১৮০০ সালে।
যাদের হাতেই এসেছিল ক্যাসলটির নিয়ন্ত্রণ, ভাগ্য বিড়ম্বিত আফ্রিকান ক্রীতদাসদের জীবনে তা বয়ে আনেনি কোন পরিবর্তনের ছোঁয়া।
ক্যাসলের প্রবেশ মুখেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। এক ভদ্র মহিলা বসে টিকেট বিক্রি করছেন। জনপ্রতি টিকেটের দাম ১৪ সেডি, প্রায় ৭ ডলারের মত। আমরা বাঙ্গালী, তাই সবখানে দরদাম করার স্বভাবটা মজ্জাগত।
দরদামে কাজও হল অবশ্য । ভদ্র মহিলা বললেন- ‘ ঠিক আছে, তোমরা জনপ্রতি ৭ সেডি করে দাও। আমি তোমাদের স্টুডেন্ট টিকেট দেব’ ; বাহ, ছাত্র জীবনে কোনদিন বাসে হাফ ভাড়া দেয়ার সুযোগ মেলেনি। আজ বিদেশের মাটিতে একটা চান্স পেয়ে ভালই লাগল।
ক্যাসলের ভেতরে প্রবেশ করেই দেখা গেল নীচতলায় অনেক গুলো ছোট ছোট কক্ষ।
বাইরে থেকে জোগাড় করা সব ক্রীতদাসদের এসব কক্ষেই গাদাগাদি করে রাখা হত। আফ্রিকার রাজা এবং বিভিন্ন গোত্র প্রধানগণ জামা কাপড় আর ঘোড়ার বিনিময়ে পর্তুগীজদের ক্রীতদাস সরবরাহ করতেন। একেকটা ছোট কুঠুরিতে প্রায় ২০০ জন করে লোক রাখা হত। ঐ সব কক্ষে শোয়া তো দূরের কথা , তিল ধারণের কোন জায়গা থাকতো না। ছিল না পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ কিংবা পয়ঃ নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা।
মাঝে মধ্যে ছোট একটা জানালা দিয়ে কিছু খাবার ছুঁড়ে দেয়া হত ভেতরে। অনাহারে, অর্ধাহারে, নোংরা পুতিগন্ধময় পরিবেশে কি নিদারুণ কষ্টে কাটতো তাদের অন্ধকার কুঠুরির এ অভিশপ্ত জীবন, ভাবলে এখনো গা শিউরে উঠে।
ক্রীতদাসদের এ দুঃসহ জীবনের কিছুটা ফিলিংস দেওয়ার জন্য আমাদেরকে একটা কক্ষে ঢুকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। উফ, সে এক দম বন্ধ করা অনুভূতি! ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক ফুট দূরের কোন বস্তুও দেখা যাচ্ছিলোনা না। ভেতরে একেবারে পিন পতন নিরবতা।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকলাম একেবারে স্ট্যাচুর মত। চোখ বন্ধ করে ক্ষণিকের জন্য চলে গেলাম সেই ১৫ শ শতাব্দীতে। খানিক পর দরজা খুলে দেওয়া হলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বন্দী শিবিরের এক কোনায় কয়েকটা রুমের ভেতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ চলে গিয়েছে কিছুদূর।
সুড়ঙ্গটিকে অনুসরণ করে আমরা পৌঁছে গেলাম ছোট একটা দরজার কাছে।
এর নাম ‘ ELMINA’S DOOR OF NO RERURN’। এ দরজা দিয়ে যে একবার বাইরে বের হত সে আর কখনো ফিরে আসতো না।
এটা ছিল ক্রীতদাস চালানের এক্সিট পয়েন্ট। দরজাটি দিয়ে বছরে প্রায় ৩০,০০০ ক্রীতদাস চালান করা হত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ব্রাজিল, ক্যারিবিয়ান এলাকা সহ অন্যান্য সকল পর্তুগীজ কলোনিতে। দরজা দিয়ে বের করে তাদের তোলা হত নিকটবর্তী অ্যাটলান্টিক পাড়ে অপেক্ষমাণ ছোট ছোট নৌকায়।
পরবর্তীতে এসব নৌকা গিয়ে ভিড়ত দূরে গভীর মহাসাগরে অপেক্ষমাণ বড় জাহাজে।
নারী ক্রীতদাসদেরও একই ভাবে নীচতলার কক্ষে আলাদাভাবে রাখা হত। তাদের কক্ষ গুলোর সামনে একটা খোলামেলা করিডোর আছে, যেখানে এনে ছেড়ে দেওয়া হত নারী ক্রীতদাসদের। উপরে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গভর্নর তার পছন্দ নির্বাচন করতেন। গভর্নর যাকে পছন্দ করতেন তাকে নিয়ে যাওয়া হত তাঁর বেডরুমে।
নারী ক্রীতদাসদের রুম থেকে দোতলায় উঠার একটা আভ্যন্তরীণ সিঁড়ি আছে যা সরাসরি গিয়ে মিলেছে গভর্নরের শয়ন কক্ষে। সিঁড়িটা সব সময় একটা ঢাকনি দ্বারা তালাবদ্ব থাকত। শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় উন্মুক্ত করা হতো ওটা।
কোন ক্রীতদাস বন্দিনী গভর্নরের শয্যাসঙ্গী হতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে সেই খোলা করিডোরে পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হত।
এই লৌহ গোলকের সাথেই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত অবাধ্য ক্রীতদাসীদের
এসব দেখে অন্যরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আর গভর্নরের অবাধ্য হওয়ার দুঃসাহস দেখাতো না।
দোতলায় গিয়ে গভর্নরের ড্রয়িং রুম , শয়ন কক্ষ এক নজর দেখে নিলাম। রুম দুটো একদম খালি।
গভর্নরের ড্রয়িং রুম
কোন আসবাব পত্র নেই। শয়ন কক্ষের একটা ভাঙ্গা জানালা মেরামতহীন অবস্থায় রুমের এক কোনে পড়ে থাকতে দেখলাম। এই শয়নকক্ষে কত ক্রীতদাসীদের জীবনে চরম সর্বনাশ ঘটেছে তার কোন হিসাব দিতে পারবেনা কেউ।
দোতলায় আরও আছে অফিসার্স মেস, লাইব্রেরী আর একটা বিক্রয় কেন্দ্র।
লাইব্রেরীতে আছে ট্র্যান্স অ্যাটলান্টিক স্লেভ ট্রেড ইতিহাসের উপর অনেক বই আর সিডি। বিক্রয় কেন্দ্রে দেখলাম পেইন্টিং আর ট্র্যাডিশনাল শো পীচ আইটেমের পসরা।
এরপর ক্যাসলের ছাদে চলে গেলাম। ছাদ থেকে দূরের নীল মহাসাগর আর মৎস্য আহরণ কেন্দ্রের সারি সারি নৌকা দেখে অদ্ভুত ভাল লাগায় মনটা ভরে গেল।
ছাদের কোনায় কোনায় দুর্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে পরিত্যক্ত কামান এখনো দাঁড়িয়ে আছে। জং ধরে একেবারে লাল হয়ে গেছে কামান গুলো।
খানিকটা সময় ছাদে কাটিয়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম নীচে। ততোক্ষণে আমার ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জ ও ফিনিশ। ইউরোপীয় বেনিয়াদের এ বর্বরোচিত, অমানবিক ব্যবসার ইতিহাস জানতে পেরে তাদের প্রতি এক ধরণের ঘৃণাবোধ জন্ম নিলো মনে।
ইতিহাসের সে সকল কুলাঙ্গারদের এক রাশ অভিসম্পাত বর্ষণ করে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসি এলমিনা ক্যাসল থেকে।
আমেরিকায় ক্রীতদাস ব্যবসার অবসান ঘটে ১৮০৭ সালে। ঐতিহাসিক ওয়াল্টার রুডনি’র মতে ইউরোপে INDUSTRIAL REVOLUTION এর কারনে তারা অত্যধিক যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়ে; ফলে তাদের ক্রীতদাস ব্যবসায়ও পড়ে ভাটা। কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিক অবশ্য রুডনি’র সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের মতে INDUSTRIAL REVOLUTION নয়; বরং মানবাধিকার এবং আর্থ - সামাজিক দৃষ্টিকোণ বিবেচনায়ই যবনিকাপাত ঘটে এই অমানবিক TRANS ATLANTIC SLAVE TRADE এর।
এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পরিদর্শন করতে পেরে আমার ঘানা ভ্রমণ পরিপূর্ণ সার্থক মনে হল। সেই সব ভাগ্য বিড়ম্বিত ক্রীতদাসদের অতৃপ্ত আত্মার প্রতি একরাশ শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে ফিরে এলাম কেপকোস্টের ওয়েসিস বীচ হোটেলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।