আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপ্রকাশিত (অষ্টম পর্ব)

মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। তা হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন

মতি মিয়ার চায়ের দোকানে বিশাল জটলা। বিশাল এই অর্থে যে মতি মিয়ার দোকানটা অনেক ছোট। ৫-৬ জন মানুষ দাড়ালেই জটলা মনে হয়। উপস্থিত সবাই উত্তেজিত।

মনে হচ্ছে এলাকায় কিছু একটা হয়েছে। তাদের কথা বার্তা থেকে বিশেষ কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে তাদের উত্তেজনা থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে একটা কিছু হয়েছে। ১ম লোকঃ “ এইটার একটা বিহিত করতেই হবে। এইটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।

” ২য় লোকঃ “কত বড় সাহস একবার চিন্তা কর। এলাকায়তো আর থাকার মতন পরিবেশ থাকলো না। ” ৩য় লোকঃ “ঠিক বলছেন ভাইজান। পরিবার পরিজন নিয়ে এইখানে থাকা সম্ভব না। আমাদের পরিবারের কি নিশ্চয়তা আছে বলেন? এই ঘটনা যে আমার আপনার পরিবারের সাথে হবে না এটারতো কোনো নিশ্চয়তা নাই।

” লোক গুলো মধ্য বয়স্ক। তাদের কথা বার্তার ধরন থেকে মনে হচ্ছে এলাকার কোনো অল্প বয়স্ক প্রেমিক-প্রেমিকা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। নিশ্চয় অঞ্জন দত্তের রমা র মতন কেউ চিঠি লিখে রেখে চলে গেছে যেই চিঠির শেষ লাইন ইতি তোমার আদরের ...। মধ্য বয়স্ক মানুষ গুলো খুব অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়। কি জানি হয়তো ভয়ঙ্কর কিছুই হয়েছে।

মতি মিয়াকে দেখছি। চা বানাচ্ছে ঠিকই। কিন্ত মন আর কান দুটোই ওদের কথায়। লোকগুলোর মধ্যে অস্থিরতার কোনো কমতি দেখছি না। ৩য় লোকঃ “মতি মিয়া চা দাও আরেক কাপ।

আর একটা বেনসন দাও। আচ্ছা একটা না। একটায় হইব না। ৫টা দাও। ” ২য় লোকঃ “আমারেও দাও।

আচ্ছা তোমাদের কি মনে হয় কে করতে পারে এই কাজ?” ১ম লোকঃ “কেমনে বলি বলেন? এলাকার মানুষ জনের খবর তো তেমন একটা নিয়ে বেড়ানো হয় না। আর এমন কাজ করতে পারে এমন মানুষ নিশ্চয় খুব বেশি থাকে না তাই না। ” ৩য় লোকঃ “ওই মহল্লার রাস্তার ধারে কতগূলান ষন্ডা মার্কা পোলাপাইন খাড়াইয়া থাকে না, ওই গুলার কাজই হইব। ” ১ম লোকঃ “ঐ খানে এখন কি অবস্থা?” ২য় লোকঃ “পুলিশ না আসা পর্যন্ত ওই খানে কোনো অবস্থা নাই। ” ৩য় লোকঃ “পুলিশ আসার আগে ওইখানে কেউ হাত দিলেই ঝামেলায় পরবে বুঝলেন?” ১ম লোকঃ “ঠিক বলছেন।

যেই যুগ পরছে আজকাল। কারো বিশ্বাস নাই। ” কথা বার্তার এই ধরনটা কেমন যেনো। বাধ্য হয়ে মতি মিয়াকে জিজ্ঞেশ করলাম ঘটনা কি? যদিও জানি মতি মিয়া সোজা কথায় উত্তর দেবে না। “ মতি মিয়া।

কি হইছে এইখানে? তুমি কিছু জানো? ” মতিঃ “ভাইজান। ওই যে পাগলীটা আছে না। কয়দিন ধইরা নিখোঁজ ছিল। আজ তারে পাওয়া গেছে। কিন্ত অবস্থা বিশেষ সুবিধার না।

” “অবস্থা বিশেষ সুবিধার না মানে কি? হইছে কি খোলাসা কইরা বল। ” মতিঃ “যা হবার তাই হইছে ভাইজান। রাস্তায় পইড়া আছে। বাইচা আছে কিনা কে জানে? রক্তা রক্তি হইয়া একাকার অবস্থা। তাকানো যায় না।

আমি অবশ্য এখনো দেখি নাই। সবাই একই কথা কইতাছে। ” আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। এরা কি বলছে এসব? পাগলীটা নিখোঁজ হয়ে কোথায় ছিল? এখনইবা রাস্তায় কেন পড়ে আছে? এরা কেন এমন করছে। আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলাম না।

মতিঃ “ভাইজান মানুষ আর মানুষ নাই। এই পাগলীটা কি বোঝে কন? শেষ পর্যন্ত ওরেও ছাড় দেয় নাই। ” আমার মন কিছুতেই এই কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। কি ভয়ংকর একটা সত্যের মুখোমুখি আমি। কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

এদিকে মতি মিয়া কি কি যেনো বলেই চলেছে। আমার সেদিকে মন নেই। মতিঃ “ আগেও কয়েকবার দেখছি ভাইজান। ওই রাস্তায় খাড়াইয়া থাকে যেই পোলাগুলান,পাগলীটারে অনেক যন্ত্রনা দিত। তখন ভাবতাম লোকজনতো পাগল নিয়া কত মস্করা করেই।

এরাও সেই রকম কিছু করতাছে। ওই পোলা গুলা হইলো বদের হাড্ডি। আমার দোকানে ম্যালা বার খাইয়া ট্যাকা দেয় নাই। আল্লার গজব পড়ব ওগো উপর। হারামীর দল।

” আমি চায়ের কাপটা রেখে উঠে পড়লাম। একবার গিয়ে দেখা দরকার ওখানের কি অবস্থা। আমার চোখের সামনে শুধু পাগলীটার চেহারা ভাসছে। আমার পাশে বসে হাসতে হাসতে চায়ে চুবিয়ে বিস্কিট খাচ্ছে। বিস্কিটের একটা অংশ ভেংগে চায়ে পড়ে গেলে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।

চা খাওয়া শেষ করে মতি মিয়ার দিকে ভেংচি কেটে বলত “আমার কাছে ট্যাকা নাই”। মাঝে মাঝে হিন্দী গান করত। একটা অদ্ভুত রঙের শার্ট পড়ত। বিশাল আকৃতির। চুল কিংবা চোখ মুখে আর দশটা পাগলের সাথে তেমন কোনো তফাৎ ছিল না।

পাগলীটা রাতে কোথায় ঘুমাতো জানি না। বিকেলে মাঝে মাঝে দেখতাম ফুটপাতে নিজের মতন করে জায়গা করে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। শুধু ক্ষুধা লাগলে এর ওর বাড়িতে হানা দিত। হয়তো এই মানুষটা বিলীন হয়ে গেলেও কেউ এতটুকু টের পাবে না। তারপরো এই অগুরুত্বপূর্ণ প্রাণের মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া কি আমাদের পরাজয় নয়? রাস্তার এক ধারে ছোটখাট একটা জটলা।

আসে পাশে সব বাড়ির দরজা জানালা দিয়ে সবাই তাকিয়ে আছে। সবার দৃষ্টিতে একসাথে অনেকগুলো মিশ্র অনুভূতি। সংশয়, ঘৃনা, উদ্বেগ, অস্থিরতা। সবাই মনে প্রাণে চাইছে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান। হম্‌ম...সভ্য সমাজে এটা সমস্যাই বটে।

এই সমস্যার সমাধানও তারা করবে তাদের মতন করে। হয়তো এই ঘটনা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে। আমি ধীর পায়ে হাটছি। বিভৎস কোনো কিছু দেখতে তাড়া অনুভব করার কোনো কারন নেই। আসে পাশে সবাই নিজেদের মতন করে কানা ঘুষা করছে।

জটলার একেবারে কাছে পৌছে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম, ঠিক মাঝখানে আবর্জনার মতন একটা কিছু পড়ে আছে। এটা যে একটা মানুষের নিথর দেহ দূর থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। ছোটখাট দেহটি সেই বিবর্ন শার্ট দিয়ে ঢাকা। শার্টটি রক্তে মাখামাখি।

অনেকক্ষন থেকে এখানে পড়ে থাকায় ধুলো জমে গেছে। পাগলীটার মুখ দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্ত এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। আমি একটু এগিয়ে গেলাম। প্রাণের কোনো লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।

আমি যেনো নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলাম। যত এগিয়ে যাচ্ছিলাম তত একটা কেমন যেনো ভয়ের অনুভুতি বাড়তে লাগলো। একটা অদ্ভুত ভয়। মনে হচ্ছিল কাছে গিয়ে দেখবো পাগলীটা আর বেচেঁ নেই। তারপর কয়েকটা মুহুর্ত খুব দ্রুত কেটে গেলো।

অনেক খোজাঁ খুজিঁ করে আমি তার মাঝে অবশিষ্ট প্রাণের অস্তিত্ব খুজেঁ পেলাম। আমিও কিছুটা স্বস্তি পেলাম। খুব দ্রুত হাসপাতালে নেয়া দরকার একে। হঠাৎ মনে হলো এত সময় থেকে এখানে পড়ে আছে অথচ কেউ পাগলীটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার প্রয়োজন মনে করলো না? আরো একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। এখনো ঠিক আগের মতন সবাই এদিকেই তাকিয়ে আছে।

সবার দৃষ্টিতে সেই আগের অনুভূতি গুলো। শুধু কারো চোখে মুখে নেই এতটুকু সহানুভূতি। বুঝতে পারছি না, শুধু পাগলী বলেই কি এই মানুষটাকে এত অবহেলা? নাকি আজকাল চিন্তা ভাবনার ধরনটাই এমন হয়ে গেছে যে কোনো সমস্যা নিজের হলেই সমস্যা, আর নিজের না হলেই যে কোনো ধরনের সামাজিক সমস্যা গুলো হল বিরক্তিকর যন্ত্রনা। এদের মাঝে এমন একজন মানুষও কি নেই যে একবারের জন্য হাসপাতালে যাবার কথাটা ভেবেছে? আর এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সবার আগে হাসপাতালে যেতে হবে।

আমার সবচেয়ে কাছে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম “একটা ট্যাক্সি নিয়ে আসতে পারেন? একে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার” “ভাই। এটা পুলিশি কেইস। পুলিশ আসার আগে কিছু করতে গেলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। ” “পুলিশে খবর দিয়েছেন? কিংবা কেউ কি খবর দিয়েছে? অনেক সময়তো পার হয়ে গেলো। তাই না?” “আমি ঠিক বলতে পারছি না কেউ খবর দিয়েছে কিনা? ” “সবাই মিলে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছেন? একবারো এটা মনে হয়নি এত সময় ধরে এই মানুষটা কিভাবে বেচেঁ থাকবে? একে বাচিঁয়ে রাখাটাইতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

” “সবই বুঝি। যে যুগ পড়ছে। কে যাবে নিজের কাধেঁ ঝামেলা নিতে বলেন? ” “কোনটা ঝামেলা? একে বাচিঁয়ে রাখা? আপনি কি একটু কষ্ট করে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবেন প্লীজ?" লোকটা আমার আচরনে একটু হকচকিয়ে গেলো। একধরনের অস্বস্তিতে ভুগতে ভুগতে রওনা দিলো। আমি পাগলীর দেহ থেকে ধুলোবালি সরানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।

ক্ষানিক সময় পরে একটু চমকেই গেলাম বলতে হবে। ট্যাক্সির পরিবর্তে এম্বুলেন্স চলে এসেছে। পাগলীটাকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো। আমি রওনা দেবার আগে লোকটার দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টিতে একধরনের কাঠিন্য ছিল।

জানিনা সে বুঝতে পেরেছে কিনা? আমি তাকে শুধু এটুকু বোঝাতে চেয়েছিলাম, সে যেনো এতটুকু করে আত্নতৃপ্তিতে না ভোগে। খুব অল্পতেই আমরা আত্নতৃপ্তিতে ভুগি। আর এটাই বোধহয় আমাদের বড় কিছু করতে দেয় না। খুব বেশি সময় লাগলোনা হাসপাতালে পৌছাঁতে। এটা একটা প্রাইভেট ক্লিনিক।

তাই সবকিছু খুব দ্রুত এগুতে লাগলো। রিসিপশানে একজন সুন্দরী মহিলা বসে আছেন। একটা ফর্মে কি জানি লিখতে লিখতে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেশ করলো “রোগীর নাম কি? ” এবার আমি একটা সমস্যার মধ্যে পড়লাম। পাগলীটার নামতো জানি না। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।

“রোগীর নামটা কি খুব বেশী জরুরী? আসলে আমি ঠিক নামটা জানি না। আশা করছি এবার আপনি আমাকে রোগীর সাথে আমার কি সম্পর্ক সেটা জিজ্ঞেশ করবেন না। ” মহিলা অল্প হাসলেন। তারপর দেখলাম মোটামুটি যুদ্ধ শুরু করে দিলেন ফর্মের সাথে। বয়স, বিবাহিত নাকি অবিবাহিত...হেন তেন কত যে তথ্য।

আমি এখানেই আসে পাশে বসে পড়লাম। পাগলীটাকে নিয়ে গেছে ইমার্জেন্সি রুমে। আমি বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছু সময় পরে ভদ্র মহিলা আমার কাছে এগিয়ে এলেন। “এখানে একটা সই করুন।

আর আপনার ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার লিখুন। ” আমি লিখা শেষ করে ফর্মটা ফেরত দিয়ে দিলাম। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। কয়েক জায়গায় অবশ্য ফোন করতে হবে। আমার কাছে টাকা পয়সা খুব বেশি নেই।

মনোজ আর রঞ্জনকে বলতে হবে। পায়চারী করতে করতে এসব ভাবছি। হঠাৎ একটা ভরাট গলার আওয়াজ, “আপনি কি মিঃ মৃদুল? ” “জ্বী। ” “আপনিই নিয়ে এসেছেন পাগলীটাকে? ” “জ্বী। ” “কি অবস্থা এখানে? ” “এখনো ইমার্জেন্সি রুমে।

জানি না ভেতরে কি অবস্থা। ” “আমি এস,পি শাহিন। মিঃ মৃদুল, এটা একটা পুলিশ কেইসতো, তাই আপনাকে আমাদের সাথে একটু থানায় যেতে হবে। কিছু ফরমালিটিস আছে। ” “এখনি যেতে হবে? এখানে একজন মানুষতো থাকা উচিত, তাইনা? ” “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।

আমি ওদের বলে দেবো। এখানে কোনো সমস্যা হবে না। ” “তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। ” “আচ্ছা আপনি কি আলীম চৌধুরীকে চেনেন? ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি। ” “একজন আলীম চৌধুরীকে চিনি।

কিন্ত উনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কিনা তা জানি না। কিন্ত কেন বলেনতো? ” “নাহ্‌। তেমন কিছু না। উনি আপনার বিরুদ্ধে একটা মামলা করেছেন। পাগলীটাকে রেপ আর এটেম্প টু মার্ডার।

ওনার সাথে কি আপনার কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল? ” “কি জানি ছিল কিনা? তবে একবার তাকে কষে একটা চড় মেরেছিলাম এটা মনে আছে। আচ্ছা চলুন যাই। ” (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।