নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত করতে না পারলে
ফকির ইলিয়াস
========================================
পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জাতি এখনও নিথর। শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানরা সুবিচার প্রার্থনা করে মানববন করেছে। সড়কে নেমে এসেছে তাদের সহপাঠীরা। সবার দাবি, ঘাতকদের দৃষ্টান্তমলক শাস্তি চাই। ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা খবর প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় দেখছি আমরা।
এ পর্যন্ত কয়েকজন ডিএডিসহ বিডিআর জওয়ানদের বেশ কয়েকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেপথ্য নায়কদের সóáর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেছে কিনা তা জাতি জানছে না এখনও। এদিকে ব্যাপক তদন্তের স্বার্থে জাতীয় তদন্ত কমিটি আরও এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে।
দ্রুত খুনিদের বিচার হোক এই দাবি আপামর মানুষের।
তবে সেই সঙ্গে এর মল পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করতে চায় দেশের মানুষ। তারা জানতে চায়, কারা, কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটাল? এটা দেশবাসীর জানা, বাংলাদেশে নেপথ্যের হুকুমদাতারা অতীতেও পার পেয়েছে। তারা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যার ফলে তারা বারবার ছোবল দেয়ার সাহস পাচ্ছে এবং পেয়েই যাচ্ছে। এদের শিকড় কেন উপড়ে ফেলা হয়নি?
পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখি, জাতির জনককে যারা সপরিবারে হত্যা করেছিল তাদের বিচার তো হয়ই নি বরং তাদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়েছিল।
ইনডেমনিটি আইন করে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল। কেন করা হয়েছিল, কারা করেছিল তা দেশবাসীর সবই মনে আছে। খুনি তো খুনিই। সে রাষ্ট্রীয় মদদ পাবে কেন?
হ্যাঁ, খুনিদের ব্যবহার করা হয়েছিল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। খুনিরা ব্যবহৃত হয়েছিল ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে।
২০০৯-এর ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ড ঠিক আগের মতোই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার কোন দুরভিসি ছিল কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতি আশা করছে, অন্তত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটি যেন নেপথ্যের রাঘব বোয়ালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সমর্থ হয় এই আশা করব।
না, এর অর্থ এই নয় সরকারি তদন্ত কমিটি তা পারবে না। তারাও পারবে।
তারপরও কথা থেকে যায়, সরকারি তদন্তটি প্রধান বিরোধীদল বিএনপির শেষ পর্যন্ত পছন্দ নাও হতে পারে। তারা এটাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রচার শুরু করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কর্তৃক তদন্ত রিপোর্টটি তাদের কাছেও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে কিংবা হতে পারে বলেই আমি মনে করি।
দুই.
২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে বেশ জটিল বক্তব্য দিয়েছেন বেগম জিয়া। তার ভাষ্য মতে বোঝা গিয়েছিল তার কাছে এ বিষয়ে প্রচুর তথ্য রয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেনও যদি তার কাছে কোন তথ্য থাকে তবে তা তদন্ত কমিটিকে জানানোর জন্য।
খালেদা জিয়া শেষে সভা করে বলেছেন, তার কাছে কোন তথ্য নেই। এর কারণ কি? তাহলে এত বেশি বেশি কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল?
মনে রাখতে হবে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যা বলা হয় তা খুব ভেবে চিন্তেই বলা দরকার। কারা ২৫ ফেব্রুয়ারির খুনি তা জানতে দেশবাসী যখন উদগ্রীব তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের এমন বক্তব্য গোটা জাতিকেই নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।
বেগম জিয়া আরও একটি ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন চলতি সপ্তাহে। বিএনপির শীর্ষ সিনিয়র নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর পুত্র ইরাদ সিদ্দিকী বলেছেন, মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম জিয়া নাকি ইরাদের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেছেন।
বেগম জিয়া সরাসরি অর্থ চাইবেন সে বিশ্বাস আমিও করি না। তবে দল চালাতে কিংবা নির্বাচন করতে অর্থের ছড়াছড়িকে খালেদা জিয়া ঢালাওভাবে উৎসাহিত করছেন তা প্রমাণিত হয়েছে এই ঘটনার মাধ্যমে, যা একটি জাতির জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এই ঘটনায় বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটি চৌধুরী তানভীর সিদ্দিকীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। কারণ চৌধুরী তানভীর তার পুত্রের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে উপস্খিত ছিলেন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরমভাবে ভরাডুবির পর বিএনপিতে গৃহদাহ চলছে তা দেশবাসীর অজানা নয়।
তাই বলে এখন অনৈতিকভাবে কালো টাকার দাপটকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে হবে তা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে জামায়াত নেতারা বারবার বক্তব্য পাল্টিয়েছেন। এর আগে থেকেই তারা বলে আসছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়টি নাকি মীমাংসিত ইস্যু। জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক লন্ডনে মিডিয়াকে বলেছিলেন, ‘ওয়েট এন্ড সি’। এসব রহস্যজনক বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার।
এফবিআই এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। দেশী-বিদেশী তদন্ত কাজ সমন্বয় করার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে প্রধান সমন্বয়কারী নিয়োগ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বিদেশী গোয়েন্দাদের কাছ থেকে ঘটনার নমুনা, ধরন এবং ঘটনাস্খলের দরকারি তথ্য পাওয়ার সাহায্য মিললেও, নেপথ্যের গডফাদারদের সóáর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া নাও যেতে পারে। তা খুঁজে বের করতে হবে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদেরই।
বাংলাদেশের মানুষের শোক শেষ না হতেই আরেকটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দু’জন সেনাকর্মকর্তা, যা খুবই বেদনাদায়ক।
জাতির এই যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নেয়া খুবই কঠিন। এর মাঝে যদি ষড়যন্ত্রকারী এবং নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত না করা যায়, তবে তারা বারবারই আক্রমণ করবে। দু’চারজন চুনোপুঁটিকে ফাঁসির কাঠগড়ায় তাৎক্ষণিক দাঁড় করালেই এ সমস্যার সমাধান হবে না।
উপমহাদেশের চারদিকে মৌলবাদ নামক দানবটি ধেয়ে আসছে। এরা ঈদে মিলাদুন্নবীর মাহফিলেও বোমা হামলা করছে।
আর কি বাকি থাকল? এদের হাতে কোন শুভশক্তিই যে নিরাপদ নয় তা বলার আর দরকার পড়ে না। এর চির অবসান চাইলে, সবাইকে দাঁড়াতেই হবে সম্মিলিতভাবে। না হয় এরা সময় সুযোগ মতো কামড় দেবে যে কাউকেই।
নিউইয়র্ক, ১১ মার্চ ২০০৯
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ঢাকা।
১৩ মার্চ ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।