যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
এক.
শীত আসার আগেই সাইবেরিয়া থেকে পাখিরা উড়তে শুরু করে। হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে চলে আসে উষ্ণ উপমহাদেশে। অর্ধেক ফিরতে পারেনা। সর্বভূক মনুষ্য পেটে প্রটিনের অভাব মেটায়।
শীত-গ্রীষ্ম নেই, উষ্ম অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ তাদের ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সঙ্কিত হয়ে জমি-জিরেত বেঁচে ছেলেকে ছেড়ে দেয় পশ্চিমের দিকে।
বাংলাদেশের কোন এক হতদরিদ্র গ্রামের ছেলেটি টানা লম্বা ভ্রমণ শুরু করে। এক সময় কিভাবে যেন সে পোল্যান্ড পৌঁছে যায়। সেখান থেকে রাতের আঁধারে কম্যুনিকেটর বা দালালরা তাদের ছেড়ে দেয় মায়া দেশ জার্মানীর পথে। রাতে বরফের ওপর জুতো পরে হাঁটলে শব্দ হতে পারে, বরফ দেবে যেয়ে নদীতে সলীল সমাধী হতে পারে!পায়ের শব্দে পুলিশ টের পেয়ে যেতে পারে! তাই শুধু মোজা পায়ে রওনা হয় ছেলেগুলো! হিমাঙ্কের নীচে দশ ডিগ্রী, এমন ঠান্ডায় অনভ্যস্থ ছেলেগুলো জীবন আর বেঁচে থাকার সুখস্বপ্নে এতটাই বিভোর থাকে যে খেয়ালই করে না তার পায়ের তালু বেয়ে শীতের মরণকামড় ধীরে ধীরে হাঁটু অব্দি উঠে এসেছে! কুড়িটি ছেলে যাত্রা করার পর বার্লিন বা অন্য কোন সীমান্তবর্তী ছোট শহরে যখন পৌঁছে, বেঁচে যাওয়া ছেলেটি পেছন ফিরে দেখে সে আর দুই জন! বাকি সতের জন নেই! সাইবেরিয়ার পাখিরাও অর্ধেক ফেরে!
মট মট করে পায়ের হাড় ভেঙ্গে জীবন-মরণ সন্ধীক্ষণে একটি ছেলেকে উর্দ্ধার করেছিল ন্যাটো সৈন্যরা। তাকে নিয়ে বিবিসি'র ফিচার।
দেখেছিলাম ১০/১২ বছর আগে।
মোরালঃ "রেমিট্যান্স এবার ভাল আসছে, তাই জিডিপি ছয়ের ওপরে থাকবে বাজেটে"!
দুই.
লন্ডনের হাউস অব কমন্স এ একটি বিল তুলেছিল তখনকার বিরোধী লেবার পার্টি। বিলটির বিষয় ছিল গরু ব্যবসায়ীদের অমানবিক কর্মকার্ন্ড নিয়ে। ফ্রান্স থেকে গরু আমদানী করে ট্রাকে তুলে সেই ট্রাক ফেরিতে করে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে গরুগুলোকে লন্ডনে নিচ্ছিল। ট্রাকে গাদাগাদি করে গরু রাখার কারণে একটি গরু পথিমেধ্য মারা গেছিল।
সেই মৃত গরুটির জন্য হাউস অব কমন্সে বিল! এই বিষয়টি নিয়ে সে সময় লন্ডনের পত্র-পত্রিকায়ও বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত "অমানবিক" ভাবে গরু পরিবহনের জন্য এবং পশুর প্রতি যথাযথ মানবিক না থাকার অপরাধে ওই গরু ব্যবসায়ীর শাস্তিও হয়েছিল!
মোরালঃ "প্রতি মাসে উত্তর বঙ্গের দিনমজুররা কম ভাড়ায় ট্রাকে বাড়ি ফেরার সময় ট্রাক উল্টে ঝাঁকে ঝাঁকে মারা যায়। তার পর এই ভূখন্ডের কোথাও কিছু ঘটে না!"
তিন.
পিলখানার ভেতরে যাওয়া বিডিআর সদস্যদের সাথে তাদের উদ্বিগ্ন পরিজন দেখা করতে পারছে না। তাদের সাহায্যের জন্য বাইরে একটি চিঠির বাক্স রেখে দিয়েছেন সেনা কর্মকর্তাগণ। কিন্তু বিডিআর ট্রাজেডীর সময়ের টিভি ফুটেজ দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়, আসলে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিজনদের প্রতি তেমন সহমর্মিতা ছিলো না সেনাসদস্যদের।
যখন পিলখানার গেটের বাইরে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা সেনাকর্মকর্তাদের লাশের সংবাদ জানতে অপেক্ষা করছেন, ঠিক তখন বাইরে সেনা ও জাওয়ান মওজুদ থাকলেও, এইসব উদ্বিগ্ন মানুষের জন্য সামান্য ছায়ার ব্যবস্থা করবার বোধটুকুও তাদের হয় নি। এইসব মানুষ, যারা ন্যুনতম মানবিকতাবোধ সম্পন্ন নয়, তারাই বিভিন্ন আব্দার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কাছে আব্দার করেছেন ছেলে ভুলোনো কায়দায়। সংবাদপ্ত্রের ভাষ্য এমনই।
সংবাদপত্র সমূহে আরো প্রকাশঃ এখনও দৃশ্যটা বদলায় নি, অনেক কিছুই আমাদের চর্মচক্ষুর অগোচরে ঘটে যাচ্ছে, তবে সেনাকর্মকর্তাদের পরিবার নয় এখন লিপখানার গেটে অপেক্ষারত বিডিআর জাওয়ানদের পরিজন। এবং সংখ্যা বিচারে তারা অগনিত।
অন্তত ৬০/৬২ জন নিহত সেনাকর্মকর্তার জন্য প্রায় ৫০০০ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। সেই সাথে অন্তত ৮ হাজার পরিবার জিম্মি। উন্মাদের হাতে পারমাণবিক বোমার সুইচ দিয়ে দেওয়া তেমন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাজ নয়, কিন্তু আবেগান্ধ চতুর, ক্ষমতালোভী সেনাব্যুরোক্র্যাসির হাতে সব ক্ষমতাই আদতে অর্পন করে নিরাপদে নিজের নাগরিকের নাগরিক অধিকার ও আইনি অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার তামাশা দেখছে প্রশাসন ও সরকার, মনে হতে পারে এ ছাড়া সরকারের বুঝি আর তেমন কিছু করণীয়ও ছিল না, বা নেই! ৯ তারিখে যে দুজন সেনা কর্মকর্তা হেলিকপ্টার ভেঙ্গেপড়ে মারা গেলেন তাদের জন্য ১১ তারিখ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হলো। আমরা মোটেই অবাক হব না যদি শুনি যে আহত কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছে, তিনি মারা গেলেও রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হবে। আমরা এ নিয়ে বিরুদ্ধপক্ষ নই।
আমরাও চাই যে যার মর্যাদা অনুযায়ী সন্মান পান। কিন্তু সেই তুলনায় বিডিআর দের নিরীহ পরিবারগুলোও কেন তাদের মানবিক প্রাপ্তিটুকু পাবে না? এর সাথে আসুন আমরা সেই হাউস অব কমন্সের ঘটনাটি মেলাই, কি পেলাম?
বিডিআর জাওয়ানদের কেউ চোখে দেখছে না, তাদের কণ্ঠ শুনছে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা। এবং সেই টেলিফোন বুথের সামনে বসে আছে নির্যাতকের দল। তারা সব কিছুই মনিটর করছে। আদতে তারা বুদ্ধিতে তেমন উচ্চ নয় বলেই অনেক অদ্ভুত কাজ করছে।
নির্বোধের তামশা দেখা আর সার্কাসের জোকারদের তামাশা দেখবার ভেতরে তেমন প্রভেদ নেই। কিন্তু এই তামাশায় আমরা হাসতেও পারছি না, অস্ত্রধারীদের "তামাশা" দেখে হাসলেও প্রাণদন্ড হয়ে যেতে পারে। কিংবা তাদের এই আচরণ তাদের কাছে অতি বুদ্ধিমান পদক্ষেপ মনে হচ্ছে।
যে ছেলেটির পিতা তার ছেলেটির বুকের ছাতি ৩৬ হয়েছে, লম্বায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি হয়েছে দেখলেই অভাবের তাড়নায় বিডিআর রিক্রুটিং সেন্টারে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেই পিতা নিজেকে গর্বিত ভাবে, তার ছেলে দেশ রক্ষার কাজে আছে। তার চেয়েও নিরাপত্তা পায়, তার ছেলে তিন বেলা পেট পুরে খেতে পাবে।
বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারবে। কেননা তার হাতে বিক্রির মত জমি ছিল না। থাকলে সে ছেলেকে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে জার্মানীতে পাঠাতে চাইত।
৬০/৬২ জন দেশের সূর্য সন্তানের মৃত্যুর দায় শোধ করছে হাজার হাজার বিডিআর এর নিরীহ পরিবার। দিনের পর দিন তারা পিলখানার আশেপাশে মিছে মরিচিকার আশায় ঘুরে ফিরছে।
তাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ। চুলোয় হাড়ি চড়ছে না। দুধের শিশুগুলো অবুঝ চোখে কেবলই মায়ের মুখে কি এক অনাগত সত্য হাতড়ে মরছে। রাষ্ট্র,সরকার,সুশীল সমাজ,বিবেকবান মানুষদের কাফেলা কিছুতেই আর হতদরিদ্র ওই বিডিআর সদস্য আর তাদের ভুখানাঙ্গা পরিবারদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। বিভিন্ন কর্পোরেট ব্যাপারীরা এই মওকায় পত্র-পত্রিকায় ফেনিয়ে বিবৃতি দিচ্ছে, কোটি কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করছে।
রাজার মুকুট হারিয়েছে তো কি? রানীকে বাঁচানোর জন্য সভাসদ আর আমর্ত্যবর্গ এন্তার কোশেশ জারি রেখেছে। কিন্তু যারা কোন দিনও রাইফেল স্ক্যয়ারে ঢোকার সাহস করেনি, কোন কালেও বাড়ির পাশের নিউ মার্কেটের গেট পেরোয়নি, গ্রাম্য আটপৌরে শাড়ির বদলে জর্জেট চোখে দেখেনি, নিজেদের কম্পাউন্ডের দামি স্কুলটাতেও বাচ্চা পড়ানোর ক্ষমতা রাখেনি, আজও তারা মানবিক বিচারের আবেদন রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না এত বড় এই ঢাকা শহরে। তাদের সারা জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়া একিভূত হয়ে ঠেকেছে চিরচেনা ওই পিলখানার লৌহ কপাটে। মাথাকুটে মরছে মানবতার আবেদন। নাভিশ্বাস উঠে গেছে আমাদের মানবতার নির্লজ্জ শ্রেণী বিভাজন দেখে দেখে।
মোরালঃ জাত-পাত, ধর্মাধর্মি, বর্ণবিভাজন, আঞ্চলিকতা,লৌকিকতা, সব কিছুর ওপরে শ্রেণী। শ্রেণী বিভক্তির নির্লজ্জ প্রকাশ যা রাষ্ট্রীয়ভাবে বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা সর্বসমক্ষে প্রচারিত। চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কি !!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।