মনের কথা ব্লগে বলে ফেলুন,নয়তো মনে কথার বদহজম হবে চলুন অসাধারন মেধাবী ও দেশপ্রেমিক এক চিকিৎসকের কথা জানি। চলুন শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বির কথা জানি। ছোটবেলা থেকেই সবার মতন দুরন্ত চঞ্চল ছিলেন ডাঃ ফজলে রাব্বি। আবার সবার থেকে একটু আলাদাও । তার গভীর চোখজোড়ায় মাঝে মাঝেই তাই ভেসে উঠত দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন ।
মা মনিটার চোখ এড়িয়ে, রোদের সাথে বুক মিলিয়ে, গলির মলের পুল পেরিয়ে তাই মাঝে মাঝেই ফজলে রাব্বি হারিয়ে যেতেন কোন অজানায় ! একটু পরেই আবার ফিরতেন, হয়ত একটা সবুজ ছোট্ট ফড়িং বা লাল বনফুল হাতে নিয়ে। ভাবটা এমন, যেন মায়ের জন্যে নিয়ে এলেন অমুল্য কোন উপহার !
১৯৩২ সালে পাবনায় জন্ম নেয়া অসাধারন মেধাবী এই মানুষটি ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছিলেন সারা পাকিস্তানে সবার চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে, জয় করেছিলেন স্বর্ণপদকও । ভাবলেও অবাক লাগে, ১৯৬২ সালে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন ডাঃ ফজলে রাব্বি, তাও একটি নয়, ইন্টারনাল মেডিসিন এবং কারডিওলজি- এই দুই বিষয়ে দুটি, যা লন্ডনের রয়াল কলেজের ইতিহাসেও রেকর্ড । অসাধারন মেধার পরিচয় দিয়ে ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিনের অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তার প্রবন্ধগুলো সেই সময়ে অসাধারন আলোড়ন তুলতো, যার ভেতর অন্যতম ছিল- Spirometry in Tropical Pulmonary Eosinophilia and A Case of Congenital Hyperbilirubinaemia (Dubin-Johnson Syndrome).
তরুন বয়স থেকেই শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন তিনি।
৫২'র ভাষা আন্দোলন তার চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল। স্বনির্ভর গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পক্ষে লড়াই করে যাওয়া ডাঃ ফজলে রাব্বি তাই স্বাধীনতাকামী তরুন চিকিৎসক সমাজের কাছে হয়ে উঠেছিলেন এক অনুকরণীয় আদর্শ । ১৯৭০ সালে অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বি "Pakistan best professor award" এর জন্যে নির্বাচিত হন। কিন্তু পশ্চিমাদের শোষণের প্রতিবাদে তিনি সেই অ্যাওয়ার্ড গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানান। আর সেদিন থেকেই তিনি পরিনত হন শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূলে ।
২৭ মার্চ,১৯৭১।
কিছু সময়ের জন্যে কার্ফু স্থগিত হলে ডাঃ রাব্বি তার স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাসা থেকে।
চলে আসেন তার প্রিয় মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই এলাকায় ঘটে যাওয়া কালরাত্রির নৃশংসতা নিজের চোখে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন তার মেধা দিয়ে দেশের সঙ্কটে কিছু করার ।
পরবর্তী ৯ মাস অবস্থান করেন ঢাকায়। দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ থাকা সত্তেও একটিবারের জন্যেও সে কথা না ভেবে কাজ করে যান দেশের জন্যে। কি চিকিৎসায়, কি টাকা-পয়সার প্রয়োজনে, গেরিলা যোদ্ধারা তাকে চেয়ে পায়নি, এমন দিন বিরল ! ছোটবেলার সবুজ ফড়িং- লাল বনফুলের মত চিকিৎসা-আশ্রয়-সহায়, যা যা সম্ভব তাই নিয়ে সেদিন দেশমাতৃকার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক ডাঃ ফজলে রাব্বি । স্বাধীনতার নেশায় মগ্ন হয়েছিলেন যেন তিনি !
দেশসেবায় তন্ময় ডাঃ রাব্বি এভাবেই কাটিয়ে দিলেন স্বাধীনতার ৯টা মাস। দেখতে দেখতে চলে এলো ডিসেম্বর, বিজয় তখন শুধুই যেন সময়ের অপেক্ষা।
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। ২ ঘণ্টার জন্যে কার্ফু স্থগিত হল। সেই সুযোগে স্ত্রীর নিষেধ না মেনে ডাঃ রাব্বি পুরান ঢাকায় এলেন অবাঙ্গালী এক রোগীকে দেখতে । ফেরারসময় দিনের বাজারটা সারতে ভুল করলেন না। তারপর, দুপুরের খাওয়া শেষে দখিন খোলা জানালার পাশে ইজি চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেন, স্ত্রী ডাঃ জাহান আরার শত অনুনয়েও রাজী হলেন না কয়েকদিনের জন্যে বাড়িটা ছেড়ে অন্য কথাও যেতে।
শুধু বারবার একটা কথাই বলছিলেন সেদিন- "ছেলেরা এসে যদি আমাকে না পায় ?? আর মাত্র কটা দিন হয়ত জাহানারা, তার পরেই আমরা বিশ্বের বুকে নাম লেখাব, দেখো। সকালের ঘুম ভেঙ্গে হাতে হাত রেখে দেখব স্বাধীনতার লাল সূর্য"।
কথা শেষ না হতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। না, ফজলে রাব্বির যোদ্ধা ছেলেরা নয়, এবার বাড়ি ঘিরে ধরেছে রাজাকার-আল বদরের দল,সাথে পাক সেনারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ফজলে রাব্বিকে নিয়ে চলে গেল রাজারবাগের দিকে ।
৩ সন্তানকে বুকে আঁকড়ে হতবাক দাড়িয়ে রইলেন জাহান আরা। কি হতে যাচ্ছে তা বুঝেও যেন অবুঝ হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আর একটা রাত পেরুলেই স্বাধীনতা , কিন্তু সেই সূর্যোদয় আর দেখা হলনা ডাঃ রাব্বির।
১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে পাওয়া গেল ডাঃ ফজলে রাব্বির লাশ।
। চোখ উপরানো , হাত মুচরে পেছনে বাঁধা, সারা শরীরে বেয়োনেটের চিহ্ন । হয়ত স্বাধীনতার স্বপ্ন ভরা সেই চোখদুটির সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি ঘাতকের, হয়ত মায়ের জন্যে ছোট্ট হাতে করে সবুজ ফড়িং,লাল বুনোফুল উপহার আনার সৌভাগ্য হয়নি সেই জারজ দালালের- হয়ত তাই, এই অদ্ভুত নির্মমতার স্বীকার হয়ে প্রান দিলেন তিনি।
তথ্যসূত্রঃশুভাশিস চয়ন এর ব্লগ
১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-পর্যন্ত শহীদ ডাঃ ফজলে রাব্বি সহ: শিক্ষক-৯৯০ জন । সাংবাদিক-১৩ জন ।
চিকিৎসক-৫০ জন । আইনজীবী-৫০ জন । লেখক , প্রকোশলীসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবী-১৮ জনকে, স্বাধীনতার মাত্র ২ দিন আগে এঁদের কে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় ।
শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকা :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* এ.এন.এম. মুনির চৌধুরী, ডা: জি.সি. দেব, মুফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জোতীর্ময় গুহ ঠাকুর, আব্দুল মুক্তাদীর, এস.এম. রাশিদুল হাসান, ডা: এ.এন.এম ফাইজুল মাহি, ফজলুর রহমান খান,এ.এন.এম মনিরুজ্জামান, ডা: সেরাজুল হক খান, ডা: শাহাদাত আলী, ডা: এম.এ. খায়ের, এ.আর. খান কাদিম, মোহাম্মদ সাদিক, শারাফত আলী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, আনন্দ পবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ
* প্রফেসর কাইয়ূম, হাবিবুর রহমান, শ্রী সুখ রঞ্জন সমদ্দার,এম.সি.এ, মশিউর রহমান, আমজাদ হোসেন আমিনুদ্দিন, নাজমুল হক সরকার, আব্দুল হক, সৈয়দ আনোয়ার আলী, এ.কে. সর্দার
সাংবাদিক
* সিরাজুদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দিন আহমেদ ,এ.এন.এম. গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সরকার আব্দুল মান্নান (লাদু), নাজমুল হক, এম. আখতার, আব্দুল বাশার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসাধন চক্রবর্তী, সেলিনা আখতার.
চিকিৎসক
* মো: ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলীম চৌধুরী, সামসুদ্দিন আহমেদ, আজহারুল কবীর , সোলায়মান খান, কায়সার উদ্দিন, মনসুর আলী, গোলাম মর্তোজা, হাফেজ উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল জব্বার, এস.কে. লাল, হেম চন্দ্র বসাক, কাজী ওবায়দুল হক, আল-হাজ্ব মমতাজউদ্দিন, ঘাশিময় হাযরা, নড়েন ঘোষ, জিকরুল হক, শামসুল হক, এম. ওহমান, এ. গফুর, মনসুর আলী, এস.কে সেন, মফিজউদ্দিন, আমূল কুমার চক্রবর্তী, আতিকুর রহমান, গোলাম সারওয়ার, এর.সি. দাস, মিহির কুমার সেন, সালেহ আহমেদ, অনীল কুমার সিনহা, গুনীল চন্দ্র শর্মা, এ.কে.এম. গোলাম মোস্তফা, মাকবুল আহমেদ, এনামুল হক, এনসুর (কানু), আশরাফ আলী তালুকদার, লেফ: জিয়াউর রহমান, লেফ.ক. জাহাঙ্গীর, বাদল আলম, লেফ: ক. হাই, মেজর রেজাউর রহমান, মেজর নাজমুল ইসলাম, আসাদুল হক, নাজির উদ্দিন, লেফ: নুরুল ইসলাম, কাজল ভাদ্র, মনসুর উদ্দিন
শিক্ষাবিদ
* জহির রায়হান, পূর্নেন্দু দস্তিদর, ফেরদৌস দৌলা, ইন্দু সাহা, মেহেরুন্নিসা
শিল্পী ও পেশাজীবি
আলতাফ মাহমুদ, দানবীর রানাদা প্রসাদ সাহা, জোগেষ চন্দ্র ঘোষ, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত,সামসুজ্জামান, মাহবুব আহমেদ, খুরশিদ আলম, নজরুল ইসলাম, মাহফুজুল হক চৌধুরী, মহসিন আলী, মুজিবুল হক
তথ্য সংগ্রহঃ ব্লগার আইরিন সুলতানা এবং ফিরোজ খান তুষার
কারা জাতির এই সূর্য সন্তানদের হত্যা করেছিল?
উত্তর-বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি:
পাকিস্তান সেনাবাহিনী:
সদর দপ্তর - পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড
প্রধান মার্শাল ল প্রশাসক - লে: জে: টিক্কা খান (৬ মার্চ থেকে আগস্ট, ১৯৭১); লে: জে: এ এ কে নিয়াজী (আগস্ট থেকে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১)
উপদেষ্টা - মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী
চিফ অফ স্টাফ - ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী
আঞ্চলিক প্রধান - মেজর জেনারেল নাজির হোসেন শাহ, মেজর জেনারেল এস এইচ আনসারি, মেজর জেনারেল রাহিম খান
আঞ্চলিক সহযোগী দলসমূহ:
শান্তি কমিটি:প্রতিষ্ঠা - এপ্রিল ১৯৭১
কনভেনর - খাজা খায়রুদ্দীন
সংগঠকবৃন্দ - অধ্যাপক গোলাম আযম, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা সৈয়দ মাসুম
রাজাকার:
প্রতিষ্ঠা - মে ১৯৭১ (খুলনা)
অধ্যাদেশ জারী - জুন ১৯৭১
কনভেনর - মাওলানা এ কে এম ইউসুফ
পরিচালক - এ এস এম জহুরুল হক
আল বদর:
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সদস্যরা এই বাহিনী গঠন করে।
আল শাম্স:
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ-এর সদস্যরা এই বাহিনী গঠন করে।
অধিকৃত বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসন
গভর্নর - লে: জে: টিক্কা খান (মার্চ - আগস্ট, ১৯৭১); ড: আবদুল মোতালেব মালিক (সেপ্টেম্বর - ডিসেম্বর, ১৯৭১)
প্রধান সচিব - শফিউল আযম, কাফিলুদ্দীন মাহমুদ
সর্বমোট সামরিক শক্তি:
নিয়মিত সেনাবাহিনী - ৮০,০০০
রেঞ্জার এবং মিলিশিয়া - ২৪,০০০
বেসামরিক বাহিনী - ২৪,০০০
রাজাকার, আল-বদর, আল-শাম্স - ৫০,০০০ (আনুমানিক)
তথ্যসূত্র:
Click This Link - মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট।
দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করে যারা জাতির অপূরনীয় ক্ষতি করলো-তাদের আর যাই হোক ক্ষমা করা যায় না। তাই’ত আপামর জনতার একটাই দাবি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।