আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি, দুদক ও গত সরকারের প্রশাসনিক বন্দোবস্ত

আস সালাম - আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক

ভেবেছিলাম বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আর তেমন কিছু লিখব না। বর্তমানে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করছে সেই পুরোনো পরিচিত মুখেরা। সুতরাং তারা কোন পথে হাটবেন তা নির্ধারন করার জন্য খুব বেশী অভিজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। এমনকি নেহায়েৎ আনাড়ীদের কাছে তা কঠিন কিছু নয়। কোন নূতনত্ব নেই, যেরকম ভেবেছিলাম সব সেরকমই চলছে।

প্রথম দিকে যখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন দিন বদলের কথা, বিরোধী দলকে সংখ্যা দিয়ে বিচার না করার কথা, বিরোধীদলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেয়া, তখনই কিছুটা অবাক হই, কারন এসবের কোনটাই রাজনৈতিক দল বিশেষত আওয়ামী চরিত্রের সাথে খাপ খায় না। একমাসের মধ্যেই আমার সব আশংকা সর্বাংশে সত্য হল। বিরোধী দল সংসদে নেই, পাল্টা দোষাদোষি চলছে কে সংসদ অকার্যকর করেছে,ছাত্রলীগের ক্রশ ফায়ারকে ঝুকিমুক্ত করতে রেবের ক্রশ ফায়ার বন্ধ, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন গুলোর টেন্ডারবাজি, দলবাজি ইত্যাদির পরিচিত দৃশ্য দেখে বুঝলাম চেনা পথেই চলছে আমাদের রাজনীতি। ফলে এখনকার এই পরিচিত রাজনীতি আমাদেরকে আর কোন ভাবান্তর ঘটায় না। তবুও এর মাঝে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে।

গত ১৯ বছরে এবারই প্রথম যেখানে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। এর আগে ২০০১ এ জোটের ভূমিধ্বস বিজয় হলেও ভোটের গননায় বিরোধী দলের সাথে তাদের খুব ফারাক ছিল না। আর এবারে সেরকম হয় নি। কার্যত বিরোধী দল ভোটের আনুপাতিক হারে দাড়াতেই পারেনি। একচেটিয়া আর একতরফা ভোটের হিসেবে এবারের সংসদ আসলে পুরোমাত্রায় একদলীয়, যেখানে বিরোধী দলের খুব বেশী দায়িত্ব নেই।

মূল দায়িত্ব সরকারী দলের। সংসদকে এবার তাই আমরা প্রানবন্ত দেখছি না খুব স্বাভাবিক কারনেই। এদিকে কোন কোন পত্রিকা বিএনপির সংসদ অনুপস্থিতি নিয়ে খুব বেশী অস্থির হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ন কিছু নয়। ঠিক যে কারনে তারা সংসদে সামনের সারিতে জায়গা পায় না, সেই কারনেই কথা বলার সুযোগও পাবে না।

প্রধান মন্ত্রী মনে করেন, সামনের সারিতে বিএনপি দুটি আসনের বেশী পায় না। তেমনি কথা বলার ক্ষেত্রেও হয়ত দুই/এক মিনিটের বেশী পাবে না। তিন মিনিট কথা বললে, প্রধানমন্ত্রী হয়ত বলবেন, দুই মিনিটের বেশী এরা পায় না। এত সময় এদের কেন দেয়া হয়? তাই সংসদে তাদের ভূমিকা রাখার স্কোপ এমনিতেও খুব বেশী নেই। বিরোধী দলকে সরকারী দলের খুব বেশী প্রয়োজন মনে হয় না রয়েছে।

শোভা বর্ধনের জন্য সংসদে গেলেও যেতে পারে, তবে কোন গুরুত্ব বহ ইস্যুতে জনসাধারনকে সচেতন করার জন্য মাঠ পর্যায়ই শ্রেয়। সংসদে যেহেতু তাদের সুযোগ সীমিত, তাই সেখানে চাইলেও খুব বেশী ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে না। রাজনীতি নিয়ে লিখব না ভেবেছিলাম, কিন্তু মাঝে মাঝে যা ভাবি তা করা হয়ে উঠে না। বিশেষত এর মধ্যে বাংলাদেশে কিছু গুরুত্ববহ রাজনৈতিক মেরুকরন দেখতে পাচ্ছি। আমার এই লেখার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তনের আভাস।

বহুল আলোচিত টাস্কফোর্স বা সে জাতীয় কিছু আমার আজকের লেখার বিষয় নয়, কারন সেসব ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টের অংগীকার। আমার কাছে যে পরিবর্তনটি চোখে পড়েছে তা হল দুদক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরিচালক হাসান মাশহুদের মতবিরোধ। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হালকা আভাস দেয়া হয়েছিল, এসব কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলবে। নির্বাচন শেষ হয়েছে বেশী দিন হয় নি, তবে এখনই দুদকের ভাগ্যে দেখা দিয়েছে দুর্যোগের ঘনঘটা। এটাই প্রত্যাশিত চিত্র।

কারন খুব স্বাভাবিকভাবেই, দীর্ঘ সাত বছর পরে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগাররাও বিএনপির মত ক্ষমতার স্বাদ পুরোমাত্রায় চাইবে। সেপথে কাটা থাকলে সেটা সরানোর চেষ্টা করানো হবে। এদিক দিয়ে নির্বাচন কমিশনার সাহেব বেশ বুদ্ধিমান। বিএনপির কাছে তো এমনিতে নানা কর্মকান্ডে তিনি বিরাগভাজন। এদিকে আওয়ামী চোখ রাংগানির বিপদ দেখতে পেয়ে আগের বক্তব্য পাল্টে নিয়ে সুড়সুড় করে এখন বক্তব্য দিচ্ছেন, উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, অবাধ হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বোঝা যাচ্ছে, চাকুরী ধরে রাখতে তিনি সম্ভাব্য সবকিছুই করতে রাজী। যা হোক, তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের কোন সমস্যা নেই। দুদক চেয়ারম্যানের বিষয়টি আলাদা। তিনি সবার বিরাগভাজন। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে কোকো নিয়ে বক্তব্যের কারনে তার পেশাগত সততা নিয়ে বিএনপির লোকজন প্রশ্ন তুলেছে।

কোকো দুর্নীতিবাজ হতে পারে, সেজন্য মামলা করা যেতে পারে, কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে আগে প্রেস কনফারেন্স করে এভাবে ঢোল পেটানোর একটাই মানে থাকতে পারে। তা হল, তিনি নিজের পেশাগত অবস্থানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছেন। সম্ভবত খালেদা জিয়ার তখনকার অন্তবর্তীকালীন ফখরুদ্দিন সরকারের ঢালাও সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে তিনি এই কাজটি করেন। কোকোর দুর্নীতির বিষয়টি আরেকবার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়ে মানুষজনের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করার সুযোগটি নেন। বিশেষত সেই সময়টাতে খালেদা জিয়ার ক্লান্তিহীন নির্বাচনী প্রচারনায় বিএনপি অনেকটাই ঘুরে দাড়ায়।

হাসান মাশহুদের চাল ব্যর্থ হয় নি। আবারো মানুষের বিরক্তির উৎপাটন হয় বিএনপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আওয়ামী দুর্নীতির কথা তাদের স্মরনে থাকে না। ফলে বিএনপির ঘুরে দাড়ানোর প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায়। অবশ্য বিএনপির পরাজয়টা তাদের আত্মশুদ্ধির জন্য মোটামুটি প্রয়োজন ছিল।

জনগন কতৃক এরকম বেধরক বাড়ি না খেলে এই দলটির কোন পরিবর্তন হত না। এই সবই এখন অতীত। এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী কর্মীরা দুদককে তাদের বাধা বলে মনে করবে। দুদকের কার্যক্রম তাদের বিরুদ্ধে যায়। ফলে হাসান মাশহুদ বলতে গেলে দুকূলই হারিয়েছেন।

তার প্রতি সহানুভূতি জানানোর মত মানুষ খুব বেশী পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না - কারন তিনি ততটা নিষ্ঠার পরিচয় দেন নি। বরং দুদককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিষটিকে উড়িয়ে দেয়া যায় না - বিশেষত বিভিন্ন মামলার বাদীদের পরবর্তী বক্তব্যে এটা স্পষ্ট। সুতরাং তিনি নিজেকে যতটা ক্লিন ভাবছেন, দুর্ভাগ্যবশত আমরা তাকে ততটা ক্লিন ভাবতে পারছি না। তিনি যাদের ধরেছেন তারা দুর্নীতিবাজ, তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দুদককে যখন ব্যবহার করা হয়, তখন তিনিও তার বিশ্বাস যোগ্যতা হারান। হাসান মাশহুদের পদচ্যুতি সময়ের ব্যপার মাত্র।

অথবা তিনি যদি ঠুটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে চান - সেটা আলাদা। চাকুরী টিকিয়ে রাখতে চাইলে নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টান্ত অনুসরন করা ব্যতীত তার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। আরেকটি যে ইস্যু বর্তমানে সংবাদ মাধ্যমে দেখছি - তা হল বিএনপির পরাজয় নিয়ে তৃনমূল কর্মীদের মূল্যায়ন। তৃনমূল কর্মীরা মনে করছেন নির্বাচনের ভরাডুবি আসলে নেতাদের দুর্নীতির কারনেই হয়েছে। কিন্তু এই একটা ইস্যুতে কেন যেন আমি একমত হতে পারছি না।

অনেক কারনের একটি কারন দুর্নীতি হতে পারে - মূল কারন নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, যারা দেশে অবস্থান করে দেশের প্রতিটি ইস্যুকে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছে, মূল্যায়ন তো তাদেরটাই সঠিক হবার সম্ভাবনা বেশী। এই প্রসংগে একটা গল্প বলছি। যারা ইলেকট্রিক্যাল কিংবা ফিজিক্সে পড়েছেন, তারা জানেন ডিফারেন্সিয়াল এমপ্লিফায়ারের কথা। নয়েসের ভিতরে প্রায় চাপা পড়া সিগনালকে বাচিয়ে তোলে এই যন্ত্র।

যখন নয়েস খুব বেশী থাকে, নয়েসটাকে সবাই সিগনাল ভেবে বসে থাকে। তৃনমূল কর্মীদের হয়েছে এই অবস্থা। দেশের পত্রপত্রিকাগুলো যেহেতু আওয়ামী লীগের পক্ষে, সেজন্য মানুষজনের কাছে এই মেসেজ পৌছে দেয়া গেছে যে,বিএনপি দলটিই আসলে দুর্নীতিবাজ। এদের সরালেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও এই সুরে সুর মেলানোতে সব কিছুই হয়ে উঠে ছন্দময়।

অভাবনীয় সাফল্য পাওয়ার আনন্দে নির্বাচনের পরে এক উপদেষ্টা আনন্দে গদ গদ হয়ে বর্ননা করেন, "এই রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায়। " কিন্তু মিডিয়ার এত পক্ষপাতিত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এতসব চেষ্টাতেও শুভংকরের ফাকি রোধ করা যায় না। আওয়ামী লীগ বিগত মইনের সরকারের কাছে দুর্নীতিমুক্ত একটি দল হতে পারে, কিন্তু এই একই বিষয় সবার কাছে সত্য নয়। এই আওয়ামী আমলেই দেশ প্রথম টিআইবি রিপোর্টে দুর্নীতিতে প্রথম হয়। দ্বিতীয় বারের রিপোর্টের অনেকাংশে ছিল আওয়ামী শাসনকাল।

ফলে সেটার দায়ও তাদের নিতে হয়। কথা উঠতে পারে, আওয়ামী লীগে এখন আর কোন দুর্নীতিবাজ নেই। ওয়েট এ মিনিট। এই পক্ষপাতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারও যে দুর্নীতিবাজদের তালিকা দেয়, তাতে প্রথম তালিকার ১৬ নং নামটি ছিল জাহাংগীর কবীর নানকের। তাকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং তিনি এখন মন্ত্রী।

কই, তার দুর্নীতি নিয়ে তো কাউকে উচ্চকিত দেখি না। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষত, স্থানীয় নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন, তারা প্রায় সবাই টাউট বাটপার এবং বড় সড় দুর্নীতিবাজ। তাদের দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো বেশী সরব ছিল না। সুতরাং দুর্নীতি কোনভাবে মূল কারন হতে পারে না। বরং প্রশাসনিক বন্দোবস্তই ছিল বিএনপির নির্বাচনে ভরাডুবির মূল কারন।

খালেদা জিয়ার ক্লান্তিহীন নির্বাচনী প্রচারনায় বিএনপি প্রায় ঘুরে দাড়িয়েছিল। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে গত সরকার দুটো কাজ করে: এক, কোকোর দুর্নীতিকে লাইম লাইটে নিয়ে আসে এবং দুই, টাকাসহ এক প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করে তা ফলাও করে মিডিয়াতে প্রচার করে এ টাকা ছিল ভোট কেনার জন্য। যার ফলে, যাও বা ঘুরে দাড়িয়েছিল বিএন পি, সেটাও নস্যাৎ হয়। এছাড়া নির্বাচনী কোড লংঘনের নামে যত্র তত্র চলে জোট সমর্থকদের গ্রেপ্তার। ফলে চার দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনা চালানোর লোকেরও ছিল কমতি।

সবমিলিয়ে প্রশাসনিক বন্দোবস্ত পাকাপাকি করা হয়। তবে গত সরকার আওয়ামী লীগকে যতটা সহজভাবে নিয়েছিল, ততটা সহজভাবে নেয়া তাদের চরম ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ইনট্যুইশন বলছে, হাসান মাশহুদ সহ আরো কিছু পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব, যার জন্য গত সরকারের লোকজনদের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। আর আওয়ামী সরকার জনগনের ভোটে অধিষ্ঠিত, ফলে তার বিরুদ্ধে কোন অপচেষ্টা সাধারনের কাছে গ্রহন যোগ্য হবে না। এখন ভবিষ্যত বলে দেবে আগামী রাজনীতি কোন পথে যাবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.