ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...
'রহস্য-পত্রিকা' ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় ছাপা হওয়া গল্পের 'অ-(পরি)মার্জিত' ও 'অ-(পরি/সং)শোধিত' সংস্করণ.....
আগের পর্বের লিংক -আমিই খুনী! - ২,
আমিই খুনী! - ১
৬.
আমিই বহ্নিকে খুন করে পরে পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালিয়েছি - এমনটাই শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় আদালতে। ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পিতভাবে খুন করার শাস্তি হিসেবে ফাঁসির সাজা হয় আমার।
সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করেও কোন কাজ হয় না।
পরকীয়া প্রেমের জের ধরে খুনের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে আমি দিন গুনি ফাঁসির। বাবা-মা শেষ পর্যন্ত লড়ে গেলেও চূড়ান্ত রায়ের পর তারা আমার সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেন।
আসে না ছোট ভাই বা কোন আত্মীয় বা বন্ধুও। দীর্ঘদিন কেটে যায়- পরিচিত কারো মুখ দেখি না আমি।
তাই একদিন কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা অবস্থায় যখন শুনি আমার ভিজিটর এসেছে ,অবাক হই। বাবা কি শেষ দেখা দেখতে এসেছেন?
ভিজিটরস রুমে গিয়ে দেখি, শামীম ভাই। শামীম ভাইকে দেখে আমার দুচোখ দিয়ে পানি চলে আসে।
-‘শামীম ভাই, এতদিনে আপনি এলেন। কতবার আমি আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি, আলাদাভাবে কথা বলতে চেয়েছি! বিশ্বাস করেন, শামীম ভাই, আমি বহ্নিকে খুন করিনি। ’
‘উহু, তুমি মিথ্যে বলছ পরাগ। তুমি নিজ হাতে গুলী করে খুন করেছ বহ্নিকে। ’
‘শামীম ভাই, বহ্নিকে খুন করার কোন প্রয়োজনই তো ছিল না আমার।
এমনও তো হতে পারে, অন্য কেউ খুন করে আমার উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। পিস্তলে আমার হাতের ছাপ রেখে, আমার মোবাইল চুরি করে সেখানে রেখে আসতে পারে। ’
‘অন্য কেউ করেনি পরাগ, খুনটা তুমিই করেছ। ’
‘আপনি কিভাবে এত নিশ্চিত হন শামীম ভাই? আপনিও তো তখন ঘরে ছিলেন না। ’
‘তা ছিলাম না, কিন্তু আমার মতো নিশ্চিত এ দুনিয়ায় আর কেউ-ই না।
কারণ, খুনটা আমিই তোমাকে দিয়ে করিয়েছি। ’
এই মুহূর্তে বহ্নি জীবিত অবস্থায় আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও এতোটা অবাক হতাম কি না সন্দেহ। অবিশ্বাসে মুখ হাঁ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারি না। - ‘আপনি, কিন্তু কিভাবে? আপনিই আমাকে বুড়িগঙ্গা ব্রীজ থেকে ফেলে দিয়েছিলেন?’
ডানে বায়ে মাথা নাড়ান শামীম ভাই।
‘পরাগ, আমি তোমাকে ভাল ছেলে বলেই মনে করেছিলাম। আমার স্ত্রীর ব্যাচমেট, তার সাথে এক হাসপাতালে কাজ করতে, তার খুব ভাল বন্ধু বলেই তোমাকে গ্রহণ করেছিলাম। এজন্যই আমার বাসায় তোমার যাতায়াত ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই। কিন্তু তুমি এর সুযোগ নিয়েছ। আমার ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে তুমি বহ্নির সাথে রিলেশন গড়েছিলে, তাই না?’
আমি কিছু বলতে পারি না।
মুখ নিচু করে থাকি।
বলে চলেন শামীম আই- ‘তুমি ব্যাচেলার মানুষ, অফুরন্ত সময় তোমার। সে সময় দিয়েই তুমি বহ্নিকে অধিকার করেছিলে। কোন নৈতিকতাবোধ তোমার মনে কাজ করেনি। যা-ই হোক, তোমার মতো নীচ প্রকৃতির একটা জানোয়ারকে আর কি উপদেশ দেব।
’
মুখ বুজে গাল হজম করি। মিথ্যে তো কিছু বলছেন না তিনি।
‘আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে তোমার এক বন্ধু থাকে। তার বাসায় যাওয়ার নাম করে আমার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার বাসায় যেতে। আমি টের পাইনি আগে।
একদিন হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায় চেম্বার থেকে আগেই বাসায় ফেরায় আমি ব্যাপারটা টের পাই। অ্যাপার্টমেন্টের একটা চাবি বহ্নির কাছে, একটা আমার কাছে থাকতো। সেদিন এমনিই কলিংবেল না বাজিয়ে আমি চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। বহ্নিকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উল্টো আমাকেই চমক দিয়েছিলে তোমরা দুজন সেদিন।
আমি তোমাকে আমার বেডরুমে দেখেছি সেদিন, বহ্নির সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। ’
কোন দিনের কথা বলছেন, মনে করতে পারি না আমি।
‘সে অনুভূতি বোঝার সাধ্য তোমার কোনদিন হবে না। নিজের স্ত্রীকে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর একজন পুরুষের মনের অবস্থা কি হতে পারে, তা তোমার জানা নেই। মনে হয়েছিল, তখনই তোমাদের দুজনকে শেষ করে দিই।
কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে বের হয়ে আসি সেদিন। ’
নির্বাক শ্রোতা আমি। মাথা নিচু করে শামীম ভাইয়ের কথা শুনে যাই।
‘ঠান্ডা মাথায় ধীরে ধীরে প্ল্যানটা করি আমি। খুব কষ্ট হয়, তবু বহ্নির সাথে, তোমার সাথে আগের মতোই স্বাভাবিক ব্যবহার করি।
মাস দুয়েকের জন্য বিদেশ গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে, মনে আছে? বহ্নি তখন ছিল ওর মায়ের বাসায়?’
মনে আছে আমার। বহ্নি মারা যাওয়ার মাসখানেক আগে তিনি ফিরেছেন ইংল্যান্ড থেকে।
‘এ দু মাস আমি হিপনোটিজম শিখেছি লন্ডনে। স-ম্মো-হ-ন-বি-দ্যা। প্রচুর খরচ হয়েছে, কিন্তু আমার প্ল্যানের জন্য হিপনোটিজম শেখাটা ছিল সবচেয়ে জরুরী।
এখন তোমাকে বলি সেদিনের ঘটনাটা। বিকেলে তোমার দাওয়াত ছিল আমাদের বাসায়। আমি আগেই সাইলেন্সার লাগানো একটা পিস্তল যোগাড় করেছিলাম। পিস্তলটা ছিল চুরির মাল। চোরাই মার্কেট থেকে ছদ্মপরিচয়ে সেটা আমি যোগাড় করেছিলাম।
ঐ পিস্তলের সাথে আমাকে জড়ানোর কোন পথই ছিলনা। তুমি যখন এলে, বহ্নি ছিল রান্নাঘরে। তোমাকে হিপনোটাইজ করা আমার জন্য তখন কয়েক মিনিটের কাজ। হিপনোটাইজড অবস্থায় তোমার মস্তিষ্ক তখন আমার অধিকারে, তোমার মন-মনন-চিন্তাশক্তি-কাজ তখন পুরোপুরিভাবে আমার নিয়ন্ত্রণে। আমি যা বলবো, তুমি তা-ই করবে।
তোমার নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তখন নেই। আমি তোমার হাতে পিস্তলটা তুলে দিলাম। নির্দেশ দিয়ে গেলাম খুন করার, পিস্তল আর মোবাইল ওখানে ফেলে যাওয়ার, তারপর সিএনজি নিয়ে কাঁচপুর গিয়ে নদীতে লাফ। আমি চলে গেলাম অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে। যেহেতু আমাদের গেটে সাইন করার ব্যাপার নেই, তাই তোমার ঢোকা আর আমার বেরুনোর ৬-৭ মিনিটের ফাঁকটুকু কারো অত ভালভাবে খেয়াল নেই।
বাইরে গিয়ে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকলাম। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের দুজনকে পেলাম। আমার স্বাক্ষী তৈরী হয়ে গেল। ’
আমি তখন শ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে গেছি। সম্মোহিতের মতো কোন সিনেমার রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছি যেন।
আমার ভূমিকা এখানে কি? আমি কি এই সিনেমার নায়ক - না ভিলেন?
‘আমার প্ল্যানটা ছিল, পরকীয়া প্রেমিক তার প্রেমিকাকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করেছে, ব্যাপারটা এরকমটা দাঁড় করানো। কিন্তু গুবলেট করে দিল বুড়িগঙ্গা ব্রীজের লোকগুলো। তারা তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালো। সেজন্য মামলার এ দীর্ঘ প্রক্রিয়াটার ভেতর দিয়ে যেতে হলো আমাকে। তোমারও কষ্ট হলো বেশ।
সে-ই তো মরতে হচ্ছেই, তবে বেশ ভুগে আর সবাইকে বেশ ভুগিয়ে মরছো।
এ কথাগুলো তুমি নিজে কখনোই মনে করতে পারতে না। হিপনোটাইজড অবস্থায় তুমি কি করেছো তা মনে রাখার নির্দেশ আমি দেই নি, তাই। এই শেষ সময়ে, মৃত্যুর আগে, মনে হলো, তোমার জেনে যাওয়া উচিত কি কারণে তুমি মারা যাচ্ছ। তাই বলে গেলাম।
আর একটা কথা - তোমাদের অতি গোপন চিঠিগুলোর কথাও আমি হিপনোটিজমের মাধ্যমে বহ্নির মুখ থেকে বের করি ঘটনার কয়েকদিন আগে। হিপনোটাইজড অবস্থায় ও বলে দেয়, কোথায় লুকানো আছে চিঠিগুলো, বলে তোমাদের সম্পর্কের আরো অনেক কথা। ’
আমি শামীম ভাইয়ের দিকে তাকাই। তার দুচোখে তীব্র ঘৃণা। ঐ দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারি না।
মুখ ঘুরিয়ে নেই। আমার কি এখন কিছু বলা উচিত? আমি কোন ভাষা খুঁজে পাই না।
‘উঁহু, আমাকে খুনী বলো না। আমাকে পাপী বলো না। খুন তুমি করেছো।
এ খুনের রাস্তাটাও তোমার তৈরী। তোমার আর বহ্নির। তোমরা তোমাদের পাপের শাস্তি পেয়েছ। ’
আমাকে নির্বাক অবস্থায় রেখেই চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন শামীম ভাই।
....... সমাপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।