বৃথা হয়রানি
লক্ষ্মীছাড়া সুজনটা এখনো গান গায়। সুরের তালে এজিবি কলোনির এপার থেকে ওপার কাঁপে। সেই আলোড়নে লনের দুব্বা ঘাসগুলোও ঘুম ঘুম চোখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। তারপর ‘ও সুজন’ বলে মুখ গুঁজে নেয় মাটির ওমে। তিন শ দুইয়ে তিন বছর জেল খেটে এখন আবার গান ধরেছে।
মরার গান!
চৈতি ছিল এফ-ফাইভের ছাদে। হিমেল একবার চৈতির দিকে তাকায় আরেকবার সুজনের গানের কথাগুলো ধরার চেষ্টা করে। চৈতিটা দেখতে দেখতে কতো বড়ো হয়ে গেল। এই তো সেদিন, ওর বাবা আরফান সাহেব সাদা ফুটফুটে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে এলেন, এখন ওরই কোল ভরবার সময় হয়ে এসেছে। চোখাচোখি হতেই ‘হিমু চাচা হিমু চাচা’ বলে হাত নাড়ালো।
হিমেল হাসলো। অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে। টেলিগ্রাম অফিসের চাকরি। সারা দিনেও দু’শ টাকার টেলিগ্রাম হয় না। তারপরও হিমেল হন্তদন্ত হয়ে অফিস যায়।
চারদিকে টাস্কফোর্সের হইচই, কখন কোন প্যাঁচে পড়ে। এফ-ফাইভের পেছন দিয়ে ডি-নাইনের নর্দমা ধরে শর্ট-কাট যে রাস্তাটা গেছে আরামবাগের দিকে, সে পথেই এগুচ্ছিল হিমেল। সান্টুদের দেয়ালে অনেক শেওলা পড়েছে। অনেকদিন থরো রিপোয়ারিঙের কাজ হয় না। শেওলাগুলো কেমন আগ্রাসী রূপ পেয়ে বসেছে।
মনে হয় পুরো দালানটাকে একসময় গিলে ফেলবে। সাজনা গাছটা কতো বড়ো হয়ে গেছে। সান্টুদের তিন তলার কোয়ার্টারটার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল সাজনা গাছের দিকে। গাছের ডালে দুটো বুলবুলি। বুলবুলি দেখেই তার মনে হলো ছেলেবেলার সেই অপত্য বাণীটা: বুলবুলি তোর পুটকি লাল।
হেসে ওঠে হিমেল। হিমেলের হাসি দেখেই যেন সান্টুদের বারান্দায় সেই বারো বছরের ছোট্ট সান্টুটা এসে দাঁড়ালো। মাথা ভর্তি ‘গোবরা চুল’। শব্দটা শাহেদের। যার মাথায় গোবর বেশি তার চুল নাকি তত ঘন হয়।
এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ সান্টু। সান্টুর মাথা হয় ফাঁপা না হয় গোবর জাতীয় পদার্থে ভরপুর। বেশি মাথাওলা ছেলেকে কখনোই ভালো চোখে দেখতো না হিমেল। তাই সান্টুকে সবসময় কাছাকাছি রাখত। সান্টু কানখাড়া কুকুরের মতোই হিমেলকে কাভার দিয়ে রাখত।
হিমেল এখনো যেন সান্টুর গা থেকে ঘামের দুর্গন্ধ পাচ্ছে। সান্টু কাছে এলেই মাধবী ওড়না দিয়ে নাক ঢেকে নেয়। কিন্তু বাইক তো মোটে একটা। তাই মাধবী আর হিমেলের মাঝামাঝি বসাতে হয় সান্টুকে। সান্টুর দু-চোঁয়া মদের মতো ঘামগুলো মাধবীর শরীরে লাগে।
রাগে হিমেলের শরীর চিড়মিড় করে। ইচ্ছে হয় গাধাটাকে ছুড়ে মারতে রাস্তায়। অস্বস্তি আর উত্তেজনা কিছুটা হেলে পড়ে চন্দ্রিমার সবুজ লনে এসে। জুৎসই একটা আড়াল দেখে বসে পড়ে দু’জন। আর কান-খাড়া দুটো চোখ থাকে দু’দিকের গেটে।
‘ইশ, এরকম করতাছিস ক্যান?’ মাধবী বিরক্ত হয়ে হিমেলের চুল ধরে টানে।
হিমেল গোঁ-ধরা বালকের মতো মাধবীর বুক থেকে কিছুতেই মাথা সরায় না।
শেষমেশ মাধবী পিছলে যায়।
অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসা মাধবীর হাত ধরে টানে হিমেল।
‘তুমি আমারে এতো দিনেও বুঝলা না।
’ অপ্রস্তুত হিমেল সব গুলিয়ে ফেলে; কি প্রসঙ্গে কথাটা বলল ঠিক করতে পারে না। ‘এরকম করলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পামু মাধবী। ’ অনুগত সৈনিকের মতো যেন মহারানীর কাছে ধরণা দেয়। রাগে লাল হয়ে যাওয়া মাধবীর গালে আলতো হাত ছোঁয়ায়। ‘তুমি যদি বুঝতা তোমারে আমি কত্ত ভালোবাসি।
’
বর্ষায় বিস্ফারিত ঝিলিমের মতো ফেটে পড়ে মাধবীর দুই চোখ।
সজোরে একটা চড় দেয় হিমেলের গালে।
‘এ্যাই জানিস না আমি হিন্দুর মেয়ে। ’ তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ভিজিয়ে দেয় হিমেলের বুক। এমনই একটা হিট সিনে ক্যামরা জার্কিং দিয়ে যেন ঢুকে পড়ে সান্টু।
‘দোস্ত চল চল আজরাইলগুলা...’
পাততাড়ি গুটিয়ে ছুট দেয় তারা তিনজন। ডাবল এক্সেল পঙ্খীরাজ। মগবাজার-রাজারবাগ-খিলগাঁও সাঁই সাঁই করে উড়ে যায় দুই পাশে। তারা যেন উড়ে চলে বৈজয়ন্তীর পথে। ভালোবাসার বৈজয়ন্তীর পথে।
তারপর গোলাপশাহ’র মাজার। সন্ধ্যার ফিনফিনে আলোয় ‘গুডবাই মাধবী’। মাধবী চলে যায়। আবার আসে। একদিন দুদিন গ্যাপ দিয়েই মাধবী আসে।
ডি-নাইনের দোতলার মাধবী। সান্টুকে দিয়ে খবর দিলেই আসে। কিন্তু একদিন খবর এলো মাধবী আসবে না। মাধবী আর আসে না। ডি-নাইনের পেছনের সাজনা গাছটার তখন শৈশব।
পুরোটা আকাশ হুমড়ি খায় বিরাণ চত্বরে। এতো আলোর মাঝেও বিকেলে একটা পান্ডুর মুখ এসে দাঁড়ায় দোতলার ব্যালকনিতে। হিমেলের বুক ফেটে যায়। কিন' বোবা দুটো চোখ তাকিয়ে থাকে সেই মুখটার দিকে।
লিউকেমিয়া নামটা তখনো চাউর হয়নি মুখে মুখে।
শুধু মানিকের দোকানে গেলে শোনা যায়; সুধীর কাকার মেয়েটা বোধ হয়
‘বিধাতা যদি পাশের পাড়ার কোনো মাস্তান হত, মায়ের দুধের কসম, শালার নলা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিতাম। ...এ কোন খেলায় নামালে আমারে। ’ হিমেল মনে মনে ভাবে। ঔষধ কম্পানিতে কাজ করে মগবাজারের আফজাল ভাই। একদিন তার কাছে গিয়েছিল।
মাধবীর বিষয়টা বলতেই বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায় সে। হিমেলের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘মাইয়াটার আশা ছাইড়া দাও। কঠিন রোগ। যতদিন বাঁচব অন্যগোরে মাইরা বাঁইচব। ’
‘মানে কইতাছেন ও বাঁচব?’
‘বাঁচব না ক্যান? পয়সা খরচ করলে অবশ্যই বাঁচব।
তয় চিকিৎসাটা বড়ো এক্সপেনসিভ। পত্তেক দিন মনে করো তিন হাজার টাকার ইনজেকশন দেয়া লাগব। ’
হিমেল কিছু বলার আগেই যেন কোমরের নাইন এমএম-টা বলে ওঠে, ‘ইউরেকা। ’
টাকাই তো কথা! সে টাকা কামাবে। এই শহরের আকাশে টাকা পক্ষির মতো উড়ে।
খালি পুট্টুস কইর্যা গুলি মাইর্যা নিতে হয়।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক নিয়তি করে বসে আরেক খেলা।
’৮৮। বছরটা বড়ো যাদুময়। আট মামলার আসামী হিমেল ঢাকা মেইলের সেকেন্ড ক্লাসে।
তারপর টাইগারপাসের ঘুপচি ঘরটায় দিবাবন্দি। রাত হলে বের হয়। ট্রাংক কল। ওপারে সান্টুর মেয়েলি কণ্ঠ। ‘তোর মাধবী আর বাঁচবো না বন্ধু’
‘কিছু একটা কর সান্টু।
’
ওপারে বসে সান্টু শুধু ভাবেই। প্রতিদিন নতুন নতুন প্ল্যান দেয়। এর মধ্যে একদিন শুনে শাহেদ ফুট। পাম গাছের গোড়ায় জল দিতে মালয় গেছে। সুজনের সঙ্গেও কথা হয় মাঝে মাঝে।
রাতে গাঁজায় চুর হয়ে থাকে। কথা ভেঙে যায়। তারপর যতটুকু বোঝা যায়, সুজনরা ট্রাই করছে একটা কনসার্ট আয়োজনের। গুরু রাজি হয়েছেন। পাড়ার মেয়ে বলে কোনো টাকা নেবেন না।
খালি দু-বোতল এলবোলো’র খরচ দিলেই হবে। এভাবেই আলো-অন্ধকারে একটি বছর কাটল। শেষের দিকে এসে সান্টুও আর ফোন ধরে না। পিডাব্লুতে চাকরি হয়ে গেছে তার। মাস্টার রোলের চাকরি।
তাই চাকরির মায়ায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগটা শিথিল করে দিয়েছে।
৮ টা মামলার ওয়ারেন্ট নিয়ে একদিন এজিবি কলোনিতে হাজির হয় হিমেল। সুধীর বাবুর বাসায় একটা শীতল নিস্তব্ধতা। শরতের শেষ বিকেলে ড্রইংরুমের দেয়ালে তাজমহলের ছবিতে এক টুকরো রোদ এসে পড়ে। তাতে ছবিটার পাণ্ডুর ভাব যেন আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
তার নীচে একটা ফ্যাকাসে বিবর্ণ মুখ। মাথায় বীজতলার চারার মতো কচি কচি চুল। হিমেলের বুকের ভেতর একটা হাহাকারের ঝড় ওঠে। ‘মাধবী, মাধবী আমার!’ সাজনা গাছের মাথা থেকে বুলবুলি দুটো উড়ে গেছে। এখন শুধু সুজনের গান ছাড়া কোনো শব্দ নেই চারপাশে।
... তোমারই জন্য নতজানু আমি দুই হাত প্রসারিত
অস্ফুটে যদি ভালোবাসা ঠোঁট আড়ালেতে ডেকে নিত...
হিমেল যেন ফিরে যায় ৮৭-তে। ডি-নাইনের নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ওই শালা সান্টু, নাম্। ’
তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়ানো পিচ্চিটা ফিক করে হেসে ভেতরে চলে যায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।