ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...
'রহস্য-পত্রিকা' ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় ছাপা হওয়া গল্পের 'অ-মার্জিত' ও 'অ-পরিশোধিত' সংস্করণ.....
আগের পর্বের লিংক - আমিই খুনী! - ১
কিছুক্ষণ পর আরেকজন পুলিশ এলেন। ইন্সপেক্টর পদবীর। নাম জানালেন ফরিদ। তার কাছ থেকে জানা গেল ঘটনাটা।
বহ্নিকে কাল বিকেলে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে।
সে সময় বহ্নি বাসায় একা ছিল। তার স্বামী ছিলেন বাইরে। তিনি ফিরে এসে মাথায় গুলীবিদ্ধ অবস্থায় স্ত্রীকে রান্নাঘরে পড়ে থাকতে দেখেন। ততক্ষণে সে মৃত। দরজা খোলাই ছিল।
ড্রইংরুমের সোফায় পাওয়া গেছে একটা সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। আর পাওয়া গেছে আমার মোবাইল। আমার মোবাইলের স্ক্রীনেই আমার নাম ভেসে ওঠে। শামীম ভাই মামলা করেছেন থানায়। মামলার একমাত্র আসামী আমি, ডাঃ পরাগ।
বিপদটা আমি পরিষ্কার টের পাচ্ছি। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। অনবরত ঘামছি আমি। চেহারায় ভয়ের ভাবটুকু আর লুকিয়ে রাখতে পারছি না। পুলিশ আমাকে জেরা করা শুরু করে।
কিন্তু আসলেই কিছুই মনে করতে পারছি না আমি। খুন আমি করিনি, কিন্তু ঐ সময়টুকুতে আমি কি করেছি, সেটাও আমার মনে পড়ছে না। পুলিশ এ উত্তরে সন্তুষ্ট হয় না। বহ্নির সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বলি, পেশাগত বন্ধুত্ব।
বাবা আসেন কিছুক্ষণ পরে। তাকে বলি, এটা মিথ্যা অভিযোগ।
৪.
পরদিন পুলিশের পাহারায় আদালতে যেতে হয়। সেখানে আমাকে রিমান্ডে আনার জন্য পুলিশ আবেদন করে। আবেদন মঞ্জুর হয়।
জিজ্ঞাসাবাদ চলে কয়েকদিন। ভদ্র ভাষায়, হুমকি দিয়ে, এমনকি কয়েক দফা শারীরিক আঘাতও করে। অপমানে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। আমি ওদিনের ঘটনা যতটুকু জানি বলি। বহ্নির সাথে, শামীম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়ের কথা বলি।
কিন্তু বহ্নির সাথে আমার গড়ে ওঠা গভীর সম্পর্কের কথা অস্বীকার করি।
শামীম ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার,কথা বলার চেষ্টা করি বাবার মাধ্যমে, উকিলের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি কোন কথা বলতে রাজী নন আমার সাথে। পত্রিকার লোকজন কথা বলতে আসে। আমি কিছু বলি না।
তারা পুলিশের কাছ থেকে বক্তব্য নেয়। বাবা-মা-ভাই দেখা করতে আসেন জেলে। পত্রিকায় আমার নামে কি কি ছাপা হচ্ছে তাদের কাছ থেকে জানতে পারি। বন্ধু-বান্ধবরা দুই-একজন আসে। তাদের চেহারা দেখে ঠিক বোঝা যায় না, আমি খুন করিনি- একথা তারা বিশ্বাস করে কিনা।
৫.
মামলার শুনানী শুরু হয় আদালতে। বাবা নামকরা উকিল ঠিক করেছেন। টাকা-পয়সা খরচ করেন অজস্র। কিন্তু মামলার প্রতিটা তারিখে আমার বিরুদ্ধে এমন সব প্রমাণ হাজির হতে থাকে যে আমি নিজেই নতুন করে বিস্মিত হই প্রতিদিন।
বহ্নিদের অ্যাপার্টমেন্টের গেটে গেস্ট বুকে আমার নাম লেখা।
প্রবেশের সময় ৫ টা ৩০ মিনিট। বাহির- ৫টা ৫০। ভবনের সিকিউরিটি গার্ড স্বাক্ষ্য দেয়, এ সময় শামীম ভাই বাইরে ছিলেন। পাশের অ্যাপার্টমেন্টের আরও দুই বাসিন্দাও একই স্বাক্ষ্য দেয়। ঐ সময়টায় তারা দুইজন কাছের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কেনাকাটা করার সময় শামীম ভাইয়ের সাথে দেখা হয়।
আমি বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে, ছয়টা-সোয়া ছয়টার দিকে তারা তিনজন একত্রেই ফেরেন। তাদের সময়ের ঘন্টা-মিনিট লেখা নেই। কারণ, ঐ ভবনের বাসিন্দারা তা না লিখলেও চলে।
বহ্নির বাসা থেকে উদ্ধার করা পিস্তলে আমার হাতের ছাপ পাওয়া যায়। ফরেনসিক রিপোর্ট জানায়, ঐ পিস্তল থেকে ছোঁড়া গুলীতেই মারা গেছে বহ্নি।
ও বাড়িতেই পাওয়া আমার মোবাইল আর বহ্নির মোবাইল চেক করে দেখা যায়, আমার মোবাইল থেকে বহ্নিকে শেষ কল করা হয়েছে ৫টা ২৫ এ। আমার মোবাইলে বহ্নির পাঠানো অনেক মেসেজ সেভ করা ছিল। ঐ মেসেজগুলো পড়লে যে কোন স্কুলের ছেলেও বুঝবে আমাদের সম্পর্ক কি ছিল।
শুধু ঐ মেসেজগুলোই নয়, বহ্নিকে লেখা আমার কয়েকটা চিঠিও আদালতে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। আমি খুবই অবাক হই।
নিয়মিত দেখা, ফোনে কথা, এসএমএস বিনিময় হলেও বহ্নি নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত একটা করে চিঠি লিখতো আমাকে। ও খুব চাইতো যেন আমিও চিঠি লিখি। এই এসএমএস-ই-মেইলের যুগে ওর চাপাচাপিতেই আমি চিঠি লিখতাম। কিন্তু ওগুলো খুবই গোপনে রাখতো ও। কোথায় আছে চিঠিগুলো সেটা আমার আর বহ্নি ছাড়া কারো জানার কথা না, খুঁজে পাওয়ারও কথা না।
শামীম ভাই এগুলো কিভাবে পেলেন বুঝতে পারলাম না। তিনি অবশ্য আদালতে বলেন, বহ্নি মারা যাওয়ার পর তিনি এগুলো খুঁজে পান, এগুলো পড়ে জানতে পারেন আমাদের সম্পর্কের কথা।
আমার বিশ্বাস হয় না। শামীম ভাই কি আমাদের সম্পর্কের কথা টের পেয়েছিলেন? আমরা যেভাবে চলতাম, তাতে তার মতো ব্যস্ত মানুষের টের পাওয়ার তো কথা না। বহ্নি কি বলে দিয়েছিল সব? মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, তিনিই খুন করে আমার উপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন নাতো।
অথবা অন্য কেউ। শামীম ভাই, বহ্নি বা আমার কোন শত্র“? ঐ ভবনের অন্য অ্যাপার্টমেন্টের কেউ? আমার উকিলের সাথে এ নিয়ে আলাপও করি। কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। সব স্বাক্ষ্য-প্রমাণ খুনী হিসেবে পরিস্কারভাবে আমাকেই নির্দেশ করে।
মাঝে মাঝে আবার শামীম ভাইয়ের জন্য দুঃখ হয় আমার।
স্ত্রীকে ভীষণ ভাল বাসতেন তিনি - এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। স্ত্রীর মৃত্যু যেমন তাকে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছে, তেমনি গোপনে অন্য কারো সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল এ তথ্যটাও তাকে কম কষ্ট দিচ্ছে না।
শামীম ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয় শুধু আদালতের দিনে। সেখানেও তিনি আমার সাথে কথা বলেন না। বাইরে দেখা করেন না।
কিভাবে তাকে বোঝাই যে, তার স্ত্রীকে আমি খুন করিনি। হ্যাঁ, বহ্নির সাথে আমার যা ছিল, তার নাম পরকীয়া, কিন্তু বহ্নিকে খুন করার মতো কোন ধরণের পরিস্থিতিই কখনো হয় নি। আমরা দুজনেই গোপনে চমৎকারভাবে আমাদের সম্পর্কটা চালিয়ে নিচ্ছিলাম। শামীম ভাইয়ের সাথেও আমার সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল। শামীম ভাইকে বহ্নি ভালবাসতো না।
অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ ছিল ওদের। শামীম ভাইকে অপছন্দ করার কোন কারণ নেই, কিন্তু ভালবাসা বলে যে ব্যাপারটা, তা শামীম ভাইয়ের জন্য অনুভব করতো না বহ্নি। বয়সের ব্যবধানটাও একটা ফ্যাক্টর ছিল। কিন্তু দৃশ্যমান কোন ঝগড়া বা খারাপ সম্পর্ক তাদের মাঝে ছিল না। যে কেউ দেখে বলবে, সুখী দম্পতি।
কিন্তু ঐ যে ভালবাসার অনুভূতিটুকুর অনুপস্থিতি, এর ফাঁক গলে বহ্নির জীবনে আমার চলে আসা।
........................................................... চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।