ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন...
'রহস্য-পত্রিকা' ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় ছাপা হওয়া গল্পের 'অ-মার্জিত' ও 'অ-পরিশোধিত' সংস্করণ.....
১.
ব্যাপারটা একদমই বুঝতে পারছি না। ডাক্তার বলছেন, আমি নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। অদ্ভূত! আমি কেন আত্মহত্যা করতে যাব? যিনি বলছেন, তিনি রসিকতা করছেন বলে মনে করার কোন কারণ নেই। ঢাকা মেডিক্যালের ইমারজেন্সী বিভাগের ডাক্তার তিনি। আমার পরিচিত, একই মেডিক্যাল থেকে পাস করেছেন, আমার কয়েক বছরের সিনিয়র।
তার সাথে আমার রসিকতার সম্পর্ক না। তিনি বলছেন, কয়েকজন লোক কিছুক্ষণ আগে আমাকে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেছে। তারা জানিয়েছে, আমি নাকি কাঁচপুর ব্রীজ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলাম নিচে বুড়িগঙ্গা নদীতে। কয়েকজন আমাকে লাফ দিতে দেখে ফেলায় দ্রুত উদ্ধার করে।
হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছে।
সুতরাং, আমি সরাসরি তাদের সাথে কথা বলতে পারছি না। যদিও আমার সারা শরীর এখনো ভেজা, আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না ঘটনাটা। কিছু মনেও পড়ছে না। আমাকে কি ছিনতাইকারী ধরেছিল? মারধর করে ব্রীজ থেকে ফেলে দিয়েছিল? তাহলে তো লোকজন দেখতে পেত। যারা উদ্ধার করেছে, তারা তো বলেছে, আমি স্বেচ্ছায়ই ঝাঁপ দিয়েছিলাম এবং আমার সাথে তখন কেউ ছিল না।
পকেটে হাত দিলাম। মোবাইলটা নেই। নদীতে পড়ে গেছে? নাকি যখন আমি অচেতন অবস্থায় ছিলাম, তখন পকেট থেকে কেউ মেরে দিয়েছে?
ডাক্তার জানালেন, শারীরিকভাবে আমার তেমন কোন বিপদের আশংকা নেই। কাল সকালেই বাসায় চলে যেতে পারবো।
বাসা! ওহহো! বাসায় তো কোন খবরই দেয়া হয়নি।
জরুরী বিভাগের দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত বাজে এগারোটা। এখনও চাইলে বাসার দিকে রওয়ানা দেয়া যায়। কিন্তু এতো রাতে আর বাসায় না গিয়ে হাসপাতালে বিশ্রাম নেয়ারই সিদ্ধান্ত নিই। ডাক্তার ভাইটির ফোন থেকে বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিই, আজ হঠাৎ ডিউটি পড়েছে, রাতে আসবো না। আসল ঘটনা জানাই না।
কি দরকার বাবা-মাকে অযথা দুশ্চিন্তায় ফেলে? তেমন গুরুতর কিছু তো ঘটেনি। এক রাতেরই তো ব্যাপার।
বহ্নির কথা মনে পড়ল। আজ বহ্নির বাসায় যাওয়ার কথা ছিল আমার। সন্ধ্যায়।
গিয়েছিলাম? ওকে একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু মোবাইলও তো নেই। পকেটে কোন টাকা-পয়সাও দেখছি না। ডাক্তার ভাইয়াটির কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বহ্নিকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। তিনি এমনিতেই অনেক করেছেন।
বাইরে থেকে খাবারও কিনে আনিয়েছেন আমার জন্য। খেয়ে ডক্টরস কেবিনে- যেখানে ডাক্তাররা রোগী হিসেবে এলে ভর্তি থাকেন- সেখানে গিয়ে ঘুম দিলাম। ঘুম এমনিতে আসছিল না। একটা ঘুমের ওষুধ খেতে হলো।
২.
সকালে উঠে বাসায় চলে এলাম দ্রুত।
বেসরকারী একটা হাসপাতালে চাকরী করি। সেখানে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, আজ আসতে পারবো না। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি।
খাওয়া-দাওয়া শেষে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বসলাম, আসলে ঘটনাটা কি ঘটেছিল কালকে।
কাল সকালে হাসপাতালে গিয়েছি।
ডিউটি সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। তারপর ফিরেছি বাসায়। সন্ধ্যায় বহ্নির বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। বহ্নি একই হাসপাতালে চাকুরী করে আমার সাথে। ওদের বাসা সেগুনবাগিচায়।
...
কলিং বেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ে। কিছুক্ষণ পর ছোট ভাই এসে জানায়, পুলিশ এসেছে। আমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
পুলিশ! আমার সাথে! কি ব্যাপার?
দরজায় গিয়ে দেখি, চারজন পুলিশ। পুলিশদলের নেতাটি জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি ডাঃ মাহবুব আলম পরাগ?’
আমি মাথা ঝাঁকাই- ‘জ্বি, কি ব্যাপার?’
শান্ত স্বরে পুলিশটি ঘোষণা করে , ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেষ্ট।
’
আমি বিস্মিত হই। অ্যারেষ্ট? আমি? তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে নিশ্চয়ই।
‘কেন?’
‘ডাঃ হুমায়রা নাজনীন বহ্নিকে খুন করার অভিযোগ আছে আপনার বিরুদ্ধে। তার স্বামী মামলা করেছেন। আমরা ওয়ারেন্ট নিয়েই এসেছি।
এই যে, দেখতে পারেন। ’ - বলে পুলিশটি একটা কাগজ মেলে ধরে আমার সামনে।
প্রচন্ডভাবে চমকে যাই আমি। কাগজের দিকে চোখ যায় না। বহ্নি খুন? মানে বহ্নি মারা গেছে? কখন? হত্যার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে কেন?
আমি কি বলবো বুঝতে পারি না।
কিছু একটা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশটি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘প্লীজ, আপনার যা বলার থানায় গিয়ে তারপর বলুন। আমাদের সাথে কো-অপারেট করুন। নইলে শুধু শুধু হাঙ্গামা হবে। ’
আমি কো-অপারেট করি।
বাসায় বাবা নেই তখন। মা পুলিশের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বহ্নি কে, মা এটা জানেন না। মা-কে শান্ত করার চেষ্টা করে বলি, ‘হয়তো কোন ভুল হয়েছে উনাদের। আমি থানায় যাচ্ছি।
কোন অসুবিধা হবে না দেখো। বাবাকে খবর দাও। ’
হাতকড়া না পড়ানোর অনুরোধ রাখে পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় দেখি চারপাশে এলাকার লোকজনের কৌতুহলী দৃষ্টি।
৩.
থানায় ঢোকার মুখেই ঘন ঘন ক্যামেরার ফ্লাশ চোখ ঝলসে দেয়।
এদিক-ওদিক থেকে অজস্র প্রশ্ন ছুটে আসে। পুলিশ সাংবাদিকদের সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু খুব একটা সফল হয় না।
‘ডাঃ পরাগ, ডাঃ বহ্নিকে আপনি হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?’ ‘আপনি কাল ডাঃ বহ্নির বাসায় গিয়েছিলেন?’ ‘ডাঃ বহ্নির সাথে আপনার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল, তা কি সত্যি?’ ‘ডাঃ বহ্নি আপনার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করাতেই আপনি কি তাকে খুন করেছেন?’ ‘আপনি পিস্তল কোথায় পেলেন?’
আমার মাথা গুলিয়ে যায়।
বহ্নি মারা গেছে, এটা বিশ্বাস করতেই এখনও কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু এতো লোকের ভীড়, সাংবাদিকদের তীব্র শ্লেষ মেশানো প্রশ্ন, গায়ে বিছুটি-পাতা ডলে দেয়ার অনুভূতি ছড়ানো মন্তব্য আমাকে তা সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য করে। একই সাথে অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমার ভেতরেও। বহ্নিকে পিস্তলের গুলীতে মারা হয়েছে? আমার সাথে ওর সম্পর্কের বিষয়টা এরা জানলো কিভাবে?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোন উত্তর দেই না আমি। অনবরত প্রশ্ন আর চিৎকার উপেক্ষা করে এগিয়ে যাই।
টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও দেখি আমার চেহারার দিকে তাক করা। মুখের সামনে হাত নিতে গিয়েও সরিয়ে ফেলি। আমি তো খুনী নই। চেহারা লুকানোর কি আছে! বেশ ধাক্কাধাক্কি করে ভীড় সরিয়ে পুলিশ আমাকে লক-আপে নিয়ে রাখে।
আমি আবার চিন্তা করতে বসি।
কাল আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম? কেন? বহ্নি খুন হয়েছে? কিভাবে? এবং সেটাই বা কেন?
আমি কাল বিকেলে বহ্নিদের বাসায় গিয়েছিলাম। সেগুনবাগিচায় একটা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের সাত তলায় বহ্নির বাসা। বহ্নি আর বহ্নির স্বামী ডাঃ শামীম আহসান থাকেন সেখানে। দুবছর হয় বিয়ে হয়েছে তাদের। কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই।
ডাঃ শামীম একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার চেয়ে বয়সে ৮-৯ বছর বড়। বহ্নি আমার সমবয়সী। একই হাসপাতালে চাকরী করার সুবাদে ওর সাথে পরিচয়। সেই সূত্রেই পরিচয় ডাঃ শামীমের সাথেও।
হ্যাঁ, কাল বিকেলে আমি গিয়েছিলাম ওদের বাসায় - মনে পড়ছে। কিন্তু ঐ বাসায় কি হয়েছিল? সেখান থেকে আমি কাঁচপুর গেলাম কিভাবে? মনে পড়ছে না, মনে পড়ছে না। ভেতরের অস্থিরতা চেহারায় ফুটতে দেই না আমি।
........................... (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।