শিরদাঁড়া নেই, বহু শরীরেই নিজেদের মানাতে মানাতে.......
(পূর্ব প্রকাশের পর)
‘কবর খানায় কি? তুই কি কবরের পাহারাদার?’
সন্ন্যাসী কাচুমাচু মুখে বলে, ‘না মানে বাড়িরতে মনে হলো যেন কবর খানায় কারা ঢুকে কবর খুঁড়ছে। তাই এট্টু দেখতে আসলাম। আমার বউডার তো আবার দুদিন হলো কবর দেয়া। ’
‘যা দেখে আয়। একা একা ভয় পাসনে যেন।
একে তো কবর খানা। তারপর তোর বউ তো এনডিন খেয়ে মারা গেছে। কষ্ট পেয়ে মরেছে। দেখ কবর ফুঁড়ে উপরে উঠে বসে আছে কিনা। ’
সন্ন্যাসী যেন একটু সাহস করে বলে ওঠে, ‘আপনারা কোন খানতে?’
‘আমরা? আমরা তো ঘেরের জন্য চুন আনতে গিয়েছিলাম।
জানিসই তো ঘেরের কাজ। রাত বেরাতের কাজ। এই বস্তা ভর্তি করে চুন নিয়ে যাচ্ছি। যা যা তোর কাজে যা। আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
ঘেরে চুন দিতে হবে। ’
যাক একটা ফাঁড়া তো কাটল।
ফাঁড়া যে কাটেনি পরদিন দুপুরে বুঝলাম। রাতে লাশ নিয়ে ফিরে সারারাত জেগে ফুটন্ত চুনের পানিতে লাশ সিদ্ধ করে মাংস ছাড়ানোর মত বিভৎস ব্যাপার স্যাপার। মাংসগুলো রাক্ষুসে আফ্রিকান মাগুরের মুখে ছেড়ে নিশ্চিহ্ন করা।
পরিস্কার ধবধবে সাদা এক মানুষ ফ্রেশ হাড় গোড় নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। আমার সাধাসিধে মা উচ্ছংখল ছেলেদের ব্যাপারে নাক গলান না। কাজেই কংকালের বস্তা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাত জাগা ঘুম দিলাম।
পুলিশের ডাকে ঘুম ভাঙল। পুলিশের সাথে আব্বাও আছেন।
আছে ইয়াছিন, বাবুল ও সন্ন্যাসীও। পুলিশ কি জন্য এসেছে মুহুতের্ই বুঝে গেলাম। চোখ মুখ ধুয়ে ভাল একটা শার্ট পরে ভদ্র হয়ে ড্রয়িংরুমে এলাম। আব্বা পুলিশের সাথে কথা বলছে। ইয়াছিন উঠে গেছে ডাব গাছে।
ডাব পাড়তে। একজন কে যেন ছুটেছে বাজারে গরম গরম মিষ্টি আনতে।
আব্বা নিজেও এখনও লাশের ব্যাপারটাতে কিèয়ার না। ইয়াছিন, বাবুলের কথা কিছুই বুঝেনি। শুধু এটুকু বুঝেছে ছোট ছেলেকে বাঁচাতে যা করার তাই করতে হবে।
বড়টার মত ওটাকেও ফেরারী হতে দেয়া যাবে না।
পুলিশের সামনে ব্যাপারটা আমি খোলাসা করলাম। ডাক্তারী পড়তে মানুষের হাড়গোড় লাগে পুলিশও জানে। শুধু মাত্র পড়াশুনার জন্য যে আমি কবর খুঁড়ে লাশ তুলেছি শুনে পুলিশ আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আমি এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি যে ঢাকায় লাশ পাওয়া খুব দুষ্কর।
যারা ডাক্তারী পড়ে তারা গ্রাম দেশ থেকে কবর খুঁড়ে লাশ তুলে নিয়ে যায়।
আমার কথা ওরা বিশ্বাস করল। ইতিমধ্যে গরম গরম ছানার জিলাপী ও ডাবের পানি চলে এসেছে। আব্বার সাথে পুলিশ দুজনের কোন একটা চুক্তি হয়ে গেছে। সম্ভবত চুক্তি হয়ে গেছে সন্ন্যাসীর সাথেও।
সন্ন্যাসী বারান্দায় উবু হয়ে বসে পুলিশের সাথে সাথে একখানা গরম জিলাপী গলাধঃকরণ করল। আর হে হে করে জানাল, ছোটকর্তা পড়ার জন্য আমার মরা বউয়ের লাশ তুলেছে জানলে কে আর ছোট কর্তার বিরুদ্ধে কথা বলতে আসে। ছোটকর্তা তার বউয়ের লাশ পড়ে বড় ডাক্তার হয়ে গ্রামের সেবা করুক সেটাই সবাই চায়। ’
সন্ন্যাসীর এত হে হে করে চাটুকারিতার কারণ আছে। আব্বার তহবিলের নগদ কিছু ক্যাশ সন্ন্যাসীর পকেটে গেছে।
সাথে আশ্বাসও। আবার একটা বাগদী মেয়ে বিয়ের সব খরচখরচা আব্বা দেবে। তাছাড়া কোন একটা ঘেরের কামলার কাজে টাজেও লাগিয়ে দেবে হয়তো। সন্ন্যাসী তো মহাখুশী। যে বউ বেঁচে থাকতে একটা পয়সা ঘরে আসেনি সেই বউ মরে যাওয়ায় এত টাকা-পয়সা, সুযোগ আসবে কে জানত! মরা বউ বড় পয়া!
বাদ দেয়া যাক কংকাল নিয়ে আমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাবার ঝামেলা। ঝামেলা বলতে গাড়িতে পুলিশের চেক, জেরা। যখন জানতে পারে কংকাল আমি ব্যবসা করতে নিয়ে যাচ্ছি না, যাচ্ছি পড়তে। তখন পুলিশ আমাকে একটু সমীহের চোখেই দেখে। আমাদের দেশে এখনও শিক্ষিত শ্রেণীর কিছুটা মর্যাদা অবশিষ্ট আছে।
পুলিশ সমীহ করলেও প্রাপ্য ছাড়তে ভোলেনি। হাতের ফাঁকে কিছু টাকা গুঁজে দিতে হয়েছে। আর এ বিষয়টা আব্বার দেখাদেখি আমি কিছুটা শিখে নিয়েছি। থ্যাঙ্কস গড ফর করাপশন। আর টাকা এমন এক জিনিস তা যখন মুখ খোলে তখন অন্য সবাই চুপ করে থাকে।
ভ্রমণ বৃত্তান্তের মত ঢাকায় বসবাসের কিছুদিনও বোধ হয় এড়িয়ে গেলে আমার গল্পের উনিশ বিশ হবে না। টাকা পয়সার সমস্যা না থাকায় বেশ ভাল একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে উত্তরার দিকেই উঠেছি। আমাদের বেসরকারী মেডিকেল কলেজটা ওখানেই। অবশ্য আমি একা না। আমার মেডিকেলের আরও কয়েকজন বন্ধুর সাথেই।
ডাক্তারী এমন পড়া যা একা একা পড়ে ওঠা সম্ভব নয়। সবাই মিলে ডিসকাশন করেই পড়তে হয়।
মেডিকেলে বেশ সময় চলে যাচ্ছে। প্রচুর পড়া। পড়ার চাপে আর ওসব ডাইল, গাঁজা ছাইপাশ গেলার সময় পাচ্ছি না।
আর এখানে এসে আবিষ্কার করলাম আসলে আমি ড্রাগ এডিক্ট নই। হাতের কাছে পাওয়া যেত বলে গিলতাম। আর এখানে তেমন সঙ্গী সাথী পাচ্ছি না বলে ওসব খাওয়া হয়ে উঠছে না। তাতে যে আমার সময় খুব একটা খারাপ কাটছে তা নয়। বরং ভালই কাটছে।
মিঃ হাইডের মধ্যেও বোধ হয় ডক্টর জেকিল সুপ্ত থাকে।
মেডিকেলে অস্বাভাবিক তেমন কোন ঘটনাও ঘটে না। প্রথম প্রথম লাশ কাটতে যেয়ে একটু খারাপ লাগতো। মেয়ে গুলো ‘ওহ শিট, ওহ শিট’ করতো আর ফর্মালিনের ঝাঝাঁলো আঁচে চোখ দিয়ে পানি ঝরতো। মাঝে মধ্যে মর্গের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উৎকট গন্ধে বমি করে ফেলতো।
অবশ্য আমাদের টিচাররা লাশ কাটার প্রথম কয়েক মাসে মাংস জাতীয় কিছু না খাওয়ার অনুরোধ করতেন। খেলে বমি টমি হতে পারে। আমাদের ব্যাচের অনেক ছেলেরাই নাকি বমি করেছে।
মেডিকেলের প্রচলিত গল্পটা আমরা এসেও শুনি।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুর সাথে বাজি ধরে যে, সে যদি মেডিকেলের মর্গের ভেতর এক রাত কাটাতে পারে তাহলে পরদিন তাকে শহরের সবচেয়ে ভাল চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে খাওয়াবে।
বাজির বন্ধু অতি উৎসাহী হয়ে সাহস দেখিয়ে বলল যে, সে শুধু রাতে থাকবে তাই নয়, মর্গের প্রতিটি সাদা চাদরে ঢেকে রাখা লাশের শক্ত ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের মধ্যে একটা করে চিনির তৈরি বাতাসা রেখে আসবে। যাতে সকালে এসে সবাই দেখে বুঝতে পারে সে সত্যিই রাতে মর্গে গিয়ে থেকেছিল। ফাঁকি দেয়নি।
কথামত বাজির দিন রাতে বাজির বন্ধু মর্গে চলে আসে।
গভীর রাতে মর্গের চাবি নিয়ে এসে মর্গের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে বাজির বন্ধু।
বুক ঢিব ঢিব করলেও সাহসে ভর করে সে টেবিলের উপরে রাখা সাদা চাদরে ঢাকা হত কুচ্ছিত লাশগুলোর মুখে একে একে বাতাসা গুঁজে দেয়। চারটি লাশের মুখে বাতাসা গুঁজে পাঁচ নম্বরের সাদা চাদর সরিয়ে প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে শুয়ে থাকা লাশের মুখে বাতাসা পুরে দিতেই সে অবাক হয়ে দেখে লাশটি কড়মড় করে বাতাসাটা অতিদ্রুত গলাধঃকরণ করে ফেলেছে। ভয়ে দাত কপাটি লেগে যাওয়ার অবস্থা তার।
ঠিক সেই মুহুৃর্তে লাশটা ভূতের গলায় বলে ওঠে, ‘বাঁতাসা ঁিক আঁর একঁটা হঁবে?’
আর কিছু শুনতে পায় না বন্ধুটি। তার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
বলা বাহুল্য, লাশের ভেক ধরে থাকা বাতাসা চাওয়া লাশটা ওর বাজি ধরা বন্ধু। ( চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।