আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমন্বয় চাই, চাই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার



সমন্বয় চাই, চাই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার ফকির ইলিয়াস ----------------------------------------------------------- বাংলাদেশে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। বেশ কিছু সহিংসতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন শতাধিক আসন পেয়েছে। একটি বিষয় ভাবার মতো। আর তা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের ভিত্তি। বেশ কিছু আসন পেয়েছে এই দলটি।

যদিও বলা হয়ে থাকে উপজেলা চেয়ারম্যান ব্যক্তিইমেজেই নির্বাচিত হন, তবুও বলতে হবে, জামায়াতের এভাবে আসন পাওয়ার কথা ছিল না। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক মাসের কম সময়ের মধ্যে হলো এই উপজেলা নির্বাচন। যার ফলে মানুষের মাঝে আগ্রহ ছিল কম। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়েছে। কেন এমন হলো তাও ভাবার বিষয়।

কারণ স্খানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টির। নির্বাচিত সরকারের অধীনে এটাই ছিল একটি বড় নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। বেশ কিছু সাংসদ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি, ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছে।

বিষয়টি আলোচিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিনই ‘ভয়েস অফ আমেরিকা’ থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক দিলারা হাশেম। তিনি সংক্ষিপ্ত একটি সাক্ষাৎকার নিলেন আমার। সেই সাক্ষাৎকারেও আমি স্পষ্ট বলেছি, মানুষ বড় আশা করে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। শেখ হাসিনার উচিত হবে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সৎ ও মহৎভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা।

বলেছি, মৎস্য ও পশুসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে­ এর সুষ্ঠু তদন্ত করা হোক। দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্খা নেয়া হোক। এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা। তা আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখেছি। ২৬ জানুয়ারি নিউইয়র্ক সময় সকাল আটটার চ্যানেল আই সংবাদে দেখলাম, সে অভিযোগ অস্বীকার করছেন মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস।

মন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, প্রভাব খাটাতে চাইলে তিনি ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে বসেই খাটাতে পারেন। এজন্য এলাকায় যাওয়ার দরকার কি? মন্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। তবু এর প্রেক্ষাপটে প্রশ্নও আছে অনেক। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য তো আরও অনেকে আছেন। এর মধ্য থেকে বিশেষভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে কেন? তার স্বশরীরে সেখানে উপস্খিত থাকাবে কারণই-বা কি? এই বিষয়টি আরও ব্যাপক তদন্তের দাবি রাখে।

প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, তিনি কোন পেশিশক্তিকে প্রশ্রয় দেবেন না। এই প্রত্যয়ের বাস্তব প্রতিফলন প্রয়োজন। কেবিনেটে যেই থাকুন না কেন, সরকারি বিধিনিষেধ তাকে মানতেই হবে। প্রটৌকলের ঊর্ধ্বে তো কেউ নেই। এ ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীকে।

আমরা দেখেছি, একটি সরকারকে অস্খিতিশীল করে তুলতে ঘরে-বাইরে দুটি চক্র তৎপর থাকে। বাইরের চক্রটি সম্পর্কে বেশ কিছু আগাম গোয়েন্দা রিপোর্ট আঁচ করতে পারলেও ঘরের শত্রদের চেনা বড় দায়। আর এরাই ক্ষমতাসীনদের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। দেশে আর ক’দিন পরই বিশ্ব এজতেমা শুরু হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা নিচ্ছে সরকার।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনার কথা বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। সেজন্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে। কিন্তু কেউ যদি সরকারের ভেতরে থেকে কলকাঠি নাড়ে, ষড়যন্ত্র করে তাদের রুখবে কে? বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে সর্বোতভাবে। দুই. এদিকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। তারা রাষ্ট্রপতির ভাষণ বয়কট করে ওয়ার্কআউট করেছে।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সংবিধান লঘন করেছেন। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন দেননি। বিষয়টি আসলেই হাস্যকর। কারণ এই রাষ্ট্রপতি বিএনপিরই মনোনীত। তাদের ঘরানার লোক।

তারাই তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। সেই স্বপ্নে গুড়েবালি দিয়ে আসে ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ পরিবর্তন। দেশকে দু:শাসনের হাত থেকে বাঁচাতে অপরিহার্য ছিল এই ওয়ান-ইলেভেন। আজ সেই রাষ্ট্রপতির ‘ইমপিচমেন্ট’ চাচ্ছে বিএনপি! এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে। এই ঘটনার মাধ্যমে বিএনপি প্রমাণ করল, তারা ষড়যন্ত্র করেই ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের পদে।

তিনি তাদের মতলব হাসিল করতে পারেননি বলেই তাদের এত ক্ষোভ! স্পীকার আবদুল হামিদ ও ডেপুটি স্পীপকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী নির্বাচিত হওয়ার পর সংবিধান সংশোধন করে নতুন ডেপুটি স্পীকারের আরেকটি পদ সৃষ্টি করতে চাইছে সরকার। বিএনপি বলেছে তারা এই ‘অনুকম্পা’ গ্রহণ করবে না। সঙ্গত কারণেই সরকারি দল আরেকটি ডেপুটি স্পীকারের পদ সৃষ্টি করতে চাইছে। কারণ স্পীকারের অবর্তমানে ডেপুটি স্পীকার দায়িত্ব পাবেন। এক্ষেত্রে সরকারি দল, বিরোধী দলের হাতে স্পীকারের একক ক্ষমতা দিতে চায় না।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, শেখ হাসিনা হয়তো নিজেও জানতেন না তারা ব্রুট মেজরিটি পাবেন। এই ব্রুট মেজরিটিই অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। সংবিধান সংশোধনের একক শক্তি চলে এসেছে আওয়ামী লীগের হাতে। বাংলাদেশের জনগণ হয়তোবা তেমনটিই চেয়েছেন। তারা চেয়েছেন সংবিধান সংশোধন করে ঘাতক-দালালদের বিচার সুনিশ্চিত হোক।

তারা চেয়েছেন সংবিধান সংশোধন করে জাতিরজনক হত্যার বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত করা হোক। শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হোক। সব ধর্মের অধিকার সমানভাবে প্রতিষ্ঠা করা হোক। রাষ্ট্রের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে এই রায় দিয়েছেন। তাই বর্তমান সরকারের উচিত হবে ভেবেচিন্তে মানুষের প্রত্যাশাকে মূল্যায়ন করা।

স্খানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রণালয়ে দু’জন করে মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী যারা এই মন্ত্রণালয়ে আছেন তারা প্রায় সবাই নতুন। নতুনদের কর্মস্পৃহা থাকে অদম্য। তারা তা কাজে লাগিয়ে প্রজন্মের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজটিকে এগিয়ে নেবেন বলেই প্রত্যাশা করা যায়। সরকার পরিচালনায় প্রধান প্রয়োজনটি হচ্ছে সমন্বয় সাধনের।

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মন্ত্রণালয় একে অন্যের সম্পূরক। কর্মের পথ সব সময়ই পঙ্কিল। এরপর রয়েছে বিরোধীদলের নানা ধরনের উৎপীড়নের সম্ভাবনা। বিরোধীদল বলেছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশটি অধ্যাদেশের সরাসরি বিরোধিতা করবে। তারা তা করতেই পারে।

কিন্তু অধ্যাদেশ পাশের আগে সরকারি দলকে ভাবতে হবে, প্রণীত আইনটি বৃহত্তর মানুষের কতটা কাজে আসবে। কিংবা আদৌও কাজে আসবে কি না। রাষ্ট্রক্ষমতার সদ্ব্যবহার করাটা সবসময়ই জরুরি। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তা অতি জরুরি। তাই এর ব্যত্যয় ঘটালে, প্রকারান্তরে বিরোধীদলকেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হবে।

নিউইয়র্ক ২৭ জানুয়ারি ২০০৯। --------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ । ঢাকা। ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.