মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ফাঁসি কার্যকরের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দুই প্রতিমন্ত্রীর ঢাকঢোল পেটানো, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে স্থগিতাদেশ হওয়া এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় সরকারের ভেতরের সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে।
মাত্র একজন আদালত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এত বড় স্পর্শকাতর মামলার আদেশ কীভাবে হলো, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে-বাইরে প্রশ্ন উঠেছে। কাদের মোল্লার আইনজীবীও স্বীকার করেছেন, এত বড় মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুপস্থিতিতে আদেশ হওয়ার নজির নেই।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে যা হয়েছে, তাতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
গতকাল বুধবার তিনি নিজ কার্যালয়ে যাননি।
আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা এখন আর এ বিষয়ে কথা বলছেন না। প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে পেরে তাঁরা গতকাল দূরে দূরে থেকেছেন।
কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করার জন্য সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেও চেম্বার বিচারপতির আদেশে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। রায় কার্যকর করার সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু প্রথা ভেঙে সংবাদ সম্মেলন করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় জানিয়ে দেন।
এর পরই কাদের মোল্লার আইনজীবীরা আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির বাসায় গিয়ে রায় বাস্তবায়নের কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন করেন। আদালত রাষ্ট্রপক্ষের অনুপস্থিতিতে আবেদন মঞ্জুর করেন।
কারাগারের সূত্র জানায়, চেম্বার বিচারপতির নির্দেশ গত মঙ্গলবার রাতে কারাগারে পৌঁছানোর পর করণীয় জানতে কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করার সাহস পাননি। সরকার প্রধানের মতামত ছাড়াই একপর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে আদালতের আদেশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনার পর গতকাল বুধবার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনকে কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। গত কয়েক দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাঈনুদ্দিন খন্দকার কারা মহাপরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন।
কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিতের ঘটনাটি গতকাল দিনভর আলোচনায় ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে আগ্রহীরা এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর তাঁর ফাঁসির দাবিতে তৈরি হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা আবারও শাহবাগে জড়ো হন।
চলমান রাজনৈতিক সংকট, অবরোধ ও সহিংসতার মধ্যে বিষয়টি নতুন মাত্রা যুক্ত করে।
জানতে চাইলে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তারা তো আর জানত না যে আসামিপক্ষ চেম্বার বিচারপতির কাছে যাবে। চেম্বার বিচারপতি একটি আদেশ দিয়েছেন, এখন শুনানি শেষে সিদ্ধান্ত হবে। ’
এই আইনজীবী আরও বলেন, কাদের মোল্লার একটি বিষয় নিয়ে স্ববিরোধিতা আছে।
তিনি বলছেন, ক্ষমা চাইবেন না, আবার রিভিউ আবেদন করেছেন। অবশ্য তিনি এ-ও বলতে পারেন, ক্ষমা চান না, আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চান।
চেম্বার বিচারপতির আদেশ দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন আদালত কর্মকর্তা ইসলাম উদ্দিন। তিনি ওই আদেশ কারাগারেও পৌঁছে দেন। জানতে চাইলে তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আদিষ্ট হয়ে তিনি চেম্বার বিচারপতির বাসায় গিয়েছেন।
একইভাবে তিনি আদিষ্ট হয়েই কারাগারে আদেশটি পৌঁছে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে কাদের মোল্লার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে এত বড় মামলার আদেশ হওয়ার নজির নেই, এটা সত্য। কিন্তু এত তাড়াহুড়া করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার চেষ্টা করারও নজির নেই। তা ছাড়া, যেভাবে জেল কোড উপেক্ষা করে দুই প্রতিমন্ত্রী মৃত্যুদণ্ডের সময় ঘোষণা করলেন, তারও নজির কেউ খুঁজে পাবে না। এ অবস্থার মধ্যে আদালত মানবিক কারণে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওই সিদ্ধান্ত নেন বলে তিনি দাবি করেন।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইন উপদেষ্টা, আইন প্রতিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মঙ্গলবার দিবাগত রাত বারোটায় ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
ওই সভায় উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করা হয়েছিল। তাঁর সম্মতি পাওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত জানানো হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।
কাদের মোল্লার আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক প্রথমে আদেশের যে আইনি সনদ নিয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন, তা ছিল দুই লাইনে সাদা কাগজে লেখা। এতে আইনজীবী হিসেবে তাঁর সই ছিল, কিন্তু সিল ছিল না। কারা কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে।
কাদের মোল্লার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, চেম্বার বিচারপতি আদেশ দেওয়ার পর যেহেতু রাত বারোটার মধ্যে এটি পৌঁছে দিতে হবে, সেহেতু নকলের জন্য অপেক্ষা না করে মূল রায় পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আবদুর রাজ্জাক লইয়ার্স সনদ নিয়ে জেলখানায় গেলে তা গ্রহণে জেল কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে।
এরই মধ্যে আদালত কর্মকর্তা মূল রায় জেলখানায় পৌঁছে দেন।
চেম্বার বিচারপতির বাসায় যা হয়েছিল: দুই প্রতিমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য শুনে তিন আইনজীবী কাকরাইলে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাসায় যান। তাঁরা জরুরি আবেদন (আর্জেন্ট পিটিশন) নিয়ে এসেছেন বলে বিচারপতিকে জানান। একই সঙ্গে তাঁরা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এম কে রহমানকে মুঠোফোনে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ওই দুজনকে মুঠোফোনে না পেয়ে তাঁরা মিনিস্টারস অ্যাপার্টমেন্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের বাসায় যান।
সেখানে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, আধা ঘণ্টা আগে তিনি বাইরে গেছেন।
এ সময় কাদের মোল্লার আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে ফোন করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে আবেদনের কপি দিতে না পারার কথা জানান তাঁরা। এরপর রেজিস্ট্রার একজন আদালত কর্মকর্তাকে পাঠান। তাঁর উপস্থিতিতে বিচারপতি আদেশ দেন।
তবে এম কে রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সঙ্গে কেউ কোনো যোগাযোগ করেননি। মুঠোফোনে কোনো নম্বর থেকে ফোন আসেনি। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তিনি কোর্টে ছিলেন। সন্ধ্যা সাতটা থেকে ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে এম কে রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের অনুপস্থিতিতে এত বড় রায় হওয়ার নজির তাঁর জানা নেই।
তা ছাড়া যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা-ও বাঞ্ছনীয় ছিল না।
উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, সরকারের দায়িত্ব ছিল মৃত্যুদণ্ডের রায় বাস্তবায়ন করা এবং সরকার তা করবে। তবে চেম্বার বিচারপতি একটি আদেশ দেওয়ায় তা নিয়ে শুনানি হচ্ছে। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতের যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা নিয়ে আর কোনো বিতর্কের সুযোগ থাকবে না বলে মনে করছে সরকার।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।