আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ষোড়শ শতকের একটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বৃষ্টি ডাকার গান ও তার বাংলা অনুবাদ

প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি

দল বেঁধে এ গান করলে খরার সময় দেবতাদের রাজা সরালেল বৃষ্টি নামিয়ে দেবেন এটা মণিপুরীদের প্রাচীন লৌকিক বিশ্বাস। লৌকিক ধর্মের বিভিন্ন দেবতার স্তুতি করে বৃষ্টি আবাহন করার এ গানটি বরন ডাহানির এলা নামে পরিচিত। মণিপুরীদের বৈষ্ণবধর্ম গ্রহনের বহু আগে, ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত ও গীত হতে শুরু করেছে। এই গীতিকাব্যে বৈদিক বা ভারতীয় দেবদেবীর কোন উল্লেখ নেই, ঘুরে ফিরে কেবল প্রাচীন লোকধর্মের দেবদেবীদের নামই এসেছে। কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট এ গানটিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কাব্যসাহিত্যের প্রাচীনতম নির্দশন হিসাবে ধরা হয়।

এই গানের নিজস্ব সুর রয়েছে যা বর্তমান মণিপুরী কীর্ত্তন বা পালার সুর থেকে ভিন্ন। গানটির পটভুমি এরকম - মণিপুরীদের আদিভূমি মণিপুরের খুমোল বংশের রাজা মৈরাং বংশের রাজার নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পুনরায় শক্তি পরীক্ষার আহবান জানালে খুমোল রাজার ছোট ভাই চমেই তাতে আপত্তি জানায়। এতে খুমোলের রাজা তাকে রাজ্য থেকে বের করে দেন। দুঃখে অপমানে চমেই রাজ্য ছেড়ে বের হয়ে যায়। সাথে পিছু নেয় তার বেটি বা চাকরানি।

পরবর্তী তিন বছর খুমোল রাজ্যে দেখা দেয় তীব্র খরা। চারিদিকে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। জ্যোতিষিরা অনুমান করেন, চমেই এর অপমান দেখে দেবতা পাহাংপা ক্রুদ্ধ হয়ে বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়েছেন। চমেই ও পাহাংপা-কন্যা বেটিকে সন্তুষ্ট করলেই তবে বৃষ্টি হবে ইত্যাদি । জ্যোতিষিদের কথা শুনে প্রজারা চমেই বেটিকে সন্তুষ্ট করে রাজ্যে ফিরিয়ে আনে।

পাহাংপাও খুশি হয়ে দীর্ঘ তিন বছর পর বৃষ্টি নিয়ে আসেন। খুমল রাজ্যে চলে কৃষিকাজ ও লসু দিয়ে মাছ ধরার আয়োজন। ৯টি পদো তে বিভক্ত গানটির প্রথম ৬টি পদো বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করলাম। বরন ডাহানির এলা ১. সরালেলতে রাজারো লেইপাক কুমৌ কইলো । লেইপাকে মাড়ায় মাখঙে খইমুরে জাঙাল দিলো।

খুমলর মাটি হুকেইলো, বরন দিয়াদে দৌরাজা । লুকোঙ মাহেই লুকুলিল, বরন দিয়াদে দৌরাজা । ২. হরিয়ো রামো লেইমেলতে কুংগই পিত করে । লেইমেল মানা নুংশিপা দনলো বেনুর আতে দিলো । যুকর ধ্যান করেরনায় লসমনে ফুলর লেইরাঙ দিলো ।

লেইকেইরো কালারো ডাহিয়াউ দেই কাদিয়াউ খেয়নায়ে । ৩. তাম্ফারো আপারো হরেইগা দলে দুমেয়ে য়েইচিল কইল । হিলঙ লালরে হিলরো সরা গঙ্গায় লালইলীয়ে । না যেইগা গাটে বুলিয়াহো কারঙ্গ লেইমায়া ধরিয়া থামেইলো । হাবি দৌয়ে হুনো মইরাঙ পাচায় নাহুনকা নুংশিয়ে হয়ো ।

৪. আনতারা গিরিরো জিলক য়েইমাপীরে আনতারা । তাম্পাকে নুনা পেইতেগা লেইতেঙে নুনা চায়োরে । লেইতেঙরে হিরিয়ো মেঙকো কইলো । জমজমাদে যেইরিগা ধনর কইরেঙরে । ৫. ফিজাপিনা লাঙজাপি মাদই ওয়াঙখেলে।

মাদই ওয়াঙখেলে হো হুনার লাংচাক বেড়র জ্বালাত থইলে। ৬. চমেইয়ো বেটী থকুরারে। কহনিগো দিবঙতা ঘরে জনম আরো। কালা কালা আঙারা দলা দলা লেঙোলো হয়ো। দনতো চারি চিলালো পাহাঙপায় বারিয়া নাদিলো।

বৃষ্টি ডাকার গান (বাংলা অনুবাদে যা দাঁড়ায়) ১. সরালেল তুমি দেবতাদের রাজা, একটু দয়া করো খইমু ঘাসে আর নানান জিনিষে তৈরী করেছে বাঁধ খুমোলের মাটি খরায় ফেটে যায়, বৃষ্টি দাও হে দেবরাজ খা খা করে আজ খুমোলের ভুমি, বৃষ্টি দাও হে দেবরাজ ২. তুমি বলো এ নিদানে কে পারবে কিছু খেতে বা ঘুমাতে [আমি] আমরা সকল আনন্দ-শোক সপেঁছি বেণুর হাতে হে কালা, চির প্রতিবেশী আমাদের, সবাইকে দাও ডাক এসো এইখানে একত্রে সবে কাঁদি সবকিছু পড়ে থাক ৩. ও বাবা তাম্ফা, দেখেছো দুমেই জোতিষবিদ্যা গুনে গঙ্গা আসছে, তবু পাহাংপা-কন্যা কারঙ্গ বাধা দেয় শুনে সকল দেবতা জানে নিশ্চয় দুর্দশা আমাদের শুধু অনুরোধ মইরাঙ যেন পায়নাকো কিছু টের ৪. জ্যোতিষিরা বলে এ অনাবৃষ্টি পাহাংপার কারণে চমেইয়ের অপমানে যে ক্ষুব্ধ হয়েছে দারুন মনে চমেই ও বেটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও রাজ্যে যথারীতি কন্যা পৌঁছায় ওই সুবিশাল প্রান্তরে মঙ্গলকর বার্তাধ্বনিতে জগৎমুখর করে ৫. মাদই পরিধেয় বুননের জন্য হয়েছে বহিস্কৃত বেটির কাছে সে নানান সময়ে হয়েছে অপমানিত। ৬. চমেই আসতে করছে ইতস্তত মেয়েরা মিলে সবে তার সাথে হয়েছে দুর্বিনীত ক্রুদ্ধ বয়সী লোকেরা তাদের বলছে স্বাগত নয় বরং কয়লা আর বালু দিক ছিটিয়ে সে পথময় এটাই ভাগ্য পাহাংপা প্রভু দেয়নি তাদের শান্তি এখনো, কভু। সরালেল - দেবতাদের রাজা। মণিপুরী মিথলজীতে তাকে জগতসংসারের সৃস্টিকর্তা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাহাংপা - মতান্তরে পাখাংবা।

সরালেলের পুত্র এবং প্রলয়কারি দেবতা। পদো - বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গানের পংক্তির হিসাব বরন-ডাহানির-এলার ইংরেজী ভার্সন এখানে দেখুন ছবি: রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহের পেইন্টিং তথ্যসুত্র : ১. The BpM Language / Dr. K.P. Sinha, MA Phd, D Lit,1984 ২. বি.ম. ভাষাতত্ত্বর সমীক্ষা / শ্রীমংগলবাবু সিংহ, বি.ম.সা.প. ১৯৯০ ৩. মণিপুরী সাহিত্য সংগ্রহ / শুভাশিস সিনহা, ঐতিহ্য ২০০৭

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।