আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তালা



মুখের দাঁড়ি প্রায় ইঞ্চিখানেক লম্বা এবং অর্ধেকের বেশী পাকা। চেহারায় একটি নির্লিপ্ত ভাব সব সময় লেগে থাকে। কিন্তু গতকাল রাতে, সে তালা খুলে ঘরে ঢুকে যেই বাতি জ্বাল্‌ল, ঠিক তারপর থেকেই চেহারার বিপরীত পরিবর্তন। নির্লিপ্ততার কোন ছাপই নেই সেখানে। কপালে দুশ্চিন্তার ভাব স্পষ্ট।

বাসাটা সে ভাড়া নিয়েছিল বছর আটেক আগে। সেই তখন থেকে এই আজ অবধি কোনো সমস্যা ছাড়াই পার করেছে সে। এতদিন পর আজ হঠাৎ ছন্দপতন। অগোছালো ঘরটা সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। মুসা মিয়া পুরোপুরি নিশ্চিত দরজায় তালা দিয়েই বের হয়েছিল সে এবং ঘরের ভিতর প্রায় সবকিছুই এলোমেলো করে রাখা ছিল।

খাবার দাবারে রুচি হলোনা তার। নিজেকে উদভ্রান্তের মত মনে হচ্ছে, কোনদিকে খেয়াল নেই। ক্ষুধা আর দুশ্চিন্তাকে সাথে নিয়ে আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গেল সে। বাড়ীর মালিকের উপর প্রচন্ড রাগ হল তার, এই কাক প্রীতি বড্ড বেশী বাড়াবাড়ি। ওদের কি খাবারের অভাব আছে? কি দরকার সাজ সকালে রুটি খাওয়ানোর।

মনের ভিতর অসম্ভব তোলপাড় চলছে। মুসা মিয়ার পরিষ্কার মনে আছে, কাল সে অবশ্যই সাথে করে তার সরঞ্জামগুলো নিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে কিনা তার ঘরেই চোর ঢুকলো! কিন্তু এ আবার কেমন চোর, কোন কিছুতো নিলই না উল্টো সবকিছু কেমন সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। না না .. তার মাথাটা কেমন আউলা লাগে, এ আবার কেমন কথা.. লোকে শুনলে বলবে কি, অবশেষে তার ঘরেই কিনা . . . সে আর ভাবতে পারছে না। লোকের কথা না হয় বাদই গেল, তার বউ ছেলেরাই বা কি ভাববে.. অবশেষে কিনা তার ঘরেই . . ।

আহা বউ.. ছেলে.. হঠাৎ বউ আর ছেলের কথা মনে হতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ভুস্‌স্‌স্‌ করে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল নিজের অজান্তেই। প্রায় দু’মাস যোগাযোগ নেই পরিবারের সাথে। বউটা বড় বেশী মায়াবতী। হয়তো সে দেরীতে বিয়ে করেছে বলে মায়াটা একটু বেশীই লাগে।

ছোটখাট গড়নের বউটা তার বাহ্যিক পৃথিবী সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। লেখাপড়াও তেমন শিখেনি। একদিন দুজনকেই সাথে করে নিয়ে আসবে শহরে, কয়েকদিন রেখে সারা শহর ঘুরিয়ে দেখাবে। অবশ্য বছর দুয়েক আগে ছেলে তার নানার সাথে একবার এসেছিল। তাও মাত্র একদিনের জন্য।

তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি সেবার। হাসমত ব্যপারীর সাথে গোপনীয় কাজ ছিল। ছেলে এখন বড় হচ্ছে, ইদানিং তার কেমন জানি সংকোচ বোধ হয়। সে অবশ্যই ছেলেকে এ পেশায় আনবে না, লেখাপড়া শেখাবে। তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে.. ।

বার বছরের ছেলেটাকে মনে হয় বার মাসের। অনেক দিন পর পর বাড়ী যায়, ছেলেকে কোলে বসিয়ে আদর করে। হঠাৎ তার হাসি পেয়ে গেল, বাপ কোলে বসিয়ে একটু আদর করছে আর তাতে ছেলের কি লজ্জা. . . . । চালের উপর কাকদের খেম্‌টা নাচ অসহ্য লাগছে। না তার আর কিছুই ভালো লাগছে না, সে চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।

তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে বেরুতে হবে. . পরিবার তাকে চুম্বকের মত টানছে। আজই সে বাড়ী যাবে। মুসা মিয়ার পরনের কাপড় বলতে একটা লুঙ্গি, মোটা কাপড়ের একটি প্যান্ট আর দুটো শার্ট। সে মুখহাত ধুয়ে প্যান্ট শার্ট পরেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। নাস্তার কথা মনেই নেই তার, যেভাবে কাল রাতে খাবারের কথাও মনে ছিল না।

তর সইছে না যেন আর। চট করে রাস্তার মোড় থেকে বাস ধরে স্টেশনের দিকে চলল সে। দেরী হলে ট্রেন মিস্‌ হতে পারে। বাসে জায়গা নেই, ড্রাইভারের পাশে ইন্জিনের উপর ছোট্ট একটা বসার জায়গা করে নিল সে। তার সামনের সিটে একটি যুগল বসা।

কর্তার কোলে বছর খানেক বয়সের একটি ছেলে। ছেলেটার নাকের নীচে কি যেন চকচক করছে। হঠাৎ কেন যেন ঈসা মিয়ার জন্মের কথা মনে পড়ে যায় তার। ওফ্‌ কি ধকলটাই না সে সময় গিয়েছিল। মাঝরাত, ধাত্রী মুখ কালো করে কামরার এক কোণে বসা।

বউয়ের মুখে প্রচন্ড যন্ত্রণার ছাপ। সে এক দৌড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে হাসেম আলীকে তার ভ্যান গাড়ীসহ নিয়ে আসে। তারপর অনেক অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে হাসপাতালের পথে যাত্রা। ডাক্তার বলল, 'অবস্থা সুবিধার না, আল্লা আল্লা করেন। ' এই কথা শুনে মুসা মিয়ার সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে।

চোখে কিছুই যেন দেখতে পায় না সে। তার মনে হয় সে যেন সে একটি পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সামনে অনন্ত জলরাশি। দুরে কোন এক একাকী ডাহুক ডাক দিল কি করুণ স্বরে? মনের মধ্যে কু ডাকে তার। অবশেষে ভোর রাতে তীব্র চিৎকার.. ওঁয়া.. ওয়াঁ.. ওয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁয়াঁ..... আহ্‌ কিযে প্রশান্তি লাগছিল তখন। পরদিন ভোর পর্যন্ত বউটার জ্ঞান ফেরে না, সে তখনো নার্সদের দখলে।

মুখের ভেতরটা কেমন নোনতা লাগে তার। বউটাকে দেখে না অনেক্ষণ। এই দীর্ঘ একটি দিন একটি রাত তার কাছেই ছিল ঈসা মিয়া। মাঝে মাঝে একজন নার্স এসে কোথায় যেন নিয়ে যায় আবার কিছু পরে এসে দিয়ে যায়। ক্ষণে ক্ষণে কান্না আর ছটফটানি।

শেষের দিকে সে তার নির্ঘুম চোখগুলোকে আর শাসাতে পারছিল না যেন, কেমন অসার হয়ে আসছিল সারা শরীর। তারপর একসময় তার মনে হলো সাদা শাড়ী পড়া এক মহিলা এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল কোনখানে। তারপর, তারপর আর কিছুই জানে না সে। দুপুরের দিকে চোখ খুলে দেখে, সে হাসপাতালের ফ্লোরে একটি বিছানার উপর শুয়ে। একপাশে ভয়ে ভয়ে তাকায়.. দেয়াল, অন্য পাশে.. একটি খাটের মত দেখতে.. আবছা আবছা দেখা যায়... খাটের উপর কে যেন বসে, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

আরে বউ না.. ওমা কোলে ওটা কে। ধরফর করে উঠে বসে সে। তারপর, পঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁঅঁ.. ট্রেনের হুইসেলের শব্দে চমকে ওঠে মুসা মিয়া। তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে বাস থেকে নেমেই দৌড় শুরু করে। এক লাফে ফুটপাত প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে শেষ বগিটাতে উঠে বসে।

এখানে ভীড় অনেক কম। কোলাহল সে সব সময় এড়িয়ে চলে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিসের যেন একটি বাজে গন্ধ এসে গোঁফগুলো কুঁচকে দিচ্ছিল। হা হা হা হা .. . বউটা মাঝে মাঝে লজ্জায় ফেলে দেয় তাকে। অনেকদিন পর পর বাড়ীতে যায় সে, তখন বউ তার মাথাটা পর্যন্ত আঁচড়ে দেয়।

হা হা হা এমনকি.. এমনকি গোঁফগুলো পর্যন্ত.. যাহ্‌। সে ভাত খাওয়ার সময় বউটা পাশে বসে তার ভাত খাওয়া দেখে আর তাল পাতার পাখাটা অনবরত... আহ্‌ কখন যে ট্রেনটা.. । তার ইচ্ছে করছে যেন উড়ে চলে যায়। অবশেষে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আর মিনিট দুয়েকের অপেক্ষা। হঠাৎ বাঁ পাশে বগির এক কোণে নীচের দিকে কালো কি যেন চোখে পড়ে তার।

আরে ওটা কি, চিতল পিঠার উল্টো পিঠের মত দেখতে? তার উপর দিয়ে আবার মাছি ভনভন করছে। ট্রেন থেকে নামার আগে মুসা মিয়ার গোঁফগুলো আরেকবার কুঁচকে ওঠে। বাড়ীর উঠানে পা দিতেই ঈসা মিয়া তাকে দেখতে পায়। হাতে যন্ত্রপাতির মত কতগুলো কি যেন। ওসব ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে এসে লাজুক ঈসা মিয়া বাবার পেট জড়িয়ে ধরে চেঁচাতে থাকে, ‘বাজা....ন.. বাজান আইছে।

’ অনেকদিন পর তিনজনে এক সাথে ভাত খেতে বসেছে। রুই মাছের লেজটা মুসা মিয়ার পাতে তুলে দিতে দিতে বউ বলল, 'ডেকচি গুলান নিয়া আইলানাযে?' প্রশ্ন নিয়ে বউয়ের দিকে তাকায় মুসা মিয়া। বউ বলল, 'কাইল সোআলে আব্বায় আইছিল পুষ্কুন্নির মাছ নিয়া, আৎকা সাধ জাগছিল, তায় আব্বা আর মিয়ারে নিয়া তুমার ওআনে গেছ্‌লাম। ' মুসা মিয়ার ভাতের গ্রাস শূন্যেই রয়ে যায়, অবাক ভাব কাটেনা। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুটে বের হয়ে আসে, 'কিন্তুক - তা-লা-ডা!?'বউ ফিক্ করে হেসে ফেলে।

মুসা মিয়ার মুখ আগের মতই হা হয়ে থাকে। গত রাতের দুশ্চিন্তার রেখা আরো ঘনিভূত হয়ে ওঠে কপালে। বউ বলল, 'মিয়াই খুলছে তালা, ছেলেডা হামেশা তুমার মতো ডাক পারে। 'হঠাৎ ছেলে মুখ লুকিয়ে নীচু স্বরে ডেকে ওঠে, 'তালাছাবি ঠিক করাইবেন. . তা. . লাআআআ...। ' মিটিমিটি হেসে বাবার দিকে তাকায় সে তারপর ভাতের মধ্যে ধান খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পায় মুসা মিয়া এবং পরক্ষণেই তার চেহারাটা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হয়ে যায়। মুখের অভিব্যক্তিতে অনুভূতি চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। নাকের দু’পাশ ফুলে উঠল কি পূত্র গর্বে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।