গুগল সার্চ করলে সাপ, ব্যাং পাওয়া যাবে । চেষ্টা করে দেখুন, ইংরেজি ও বাংলায় ।
আমার নিরীক্ষার আগ্রহে আন্যান্য যে ব্যাপারগুলি এই পাঠকৃতিটি তৈরি করার সময়ে ছিল, তার মধ্যে প্রধান দুটি হল দীর্ঘ কবিতার কাঠামোয় স্পিড বা গতি আনা, এবং তাকে চিৎকার-নির্ভর করা । এই দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলা কবিতায় তার আগে, বোধ হয় পরও, বিশেষ কাজ হয়নি । উদ্দেশ্য ছিল পাঠবস্তুটিকে ইলেকট্রিফাইং করে তোলা এবং পাঠককে তুমুল বৈদ্যুতিক প্রবাহে আটক রাখা, যা থেকে সে ছাড়াবার চেষ্টা করবে কিন্তু পারবে না ।
ছুতার দ্যোতকটি শিল্প-বিরোধিতার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে । কবিতাটিতে চিৎকারের খেলা বজায় রাখার জন্য অভিব্যক্তিকে শ্বাস-পংক্তিতে সংকুচিত ও প্রসারিত করা হয়েছে । শেষ তিনটি পংক্তিতে ধাতস্হ করা হয়েছে শ্বাসকে ও স্তিমিত করা হয়েছে চিৎকারকে । অর্থাৎ অভিব্যক্তির বিনির্মাণ, বুর্জোয়া অহংবোধের সমাপ্তি, এবং লিখিত শব্দকে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াস, হাংরি আন্দোলনের সময়ে যে নিরীক্ষাগুলো করতাম, তা এই পাঙবস্তুতে চেষ্টা করেছিলাম প্রয়োগ করতে । তিন থেকে পাঁচের দশক পর্যন্ত গড়ে-ওঠা পাতিবুর্জোয়া চেতনার মডেলটি আমি আমূল বদলে ফেলতে চেয়েছিলাম ।
এই কবিতাটি লেখার সময়ে আমি মার্কসবাদ ত্যাগ করেছি । বাংলা কবিতাকে যে সেন্টিমেন্টাল নার্সসিসিজম পেয়ে বসেছিল তখন, তাকে আমি জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছিলাম । কবিতার ঐতিহাসিকতাকে এভাবে বিপর্যস্ত করা মনে হয়েছিল শ্রেয় ।
প্রেম এই পাঠবস্তুটির স্ট্র্যাটেজি, কেন্দ্র নয় । পাঠবস্তুটিতে কোনো কেন্দ্র নেই ।
না আছে আঙ্গিক । না আছে বিষয় । না আছে থিম । না আছে বক্তব্য । না আছে ছন্দ ল না আছে প্রতীক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ।
মেইনস্ট্রিম কবিতার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসাবে আমি এই লেখাটির প্রান্তিক অবস্হান নির্ধারিত করতে চেয়েছিলাম মাগধি ও ভোজপুরি ইথসের সাহায্যে । তখনকার আলোচক ও বুদ্ধিজীবিরা ওই ইথসকে বরদাস্ত করতে পারেননি । তাঁরা তখন হয় ইউরোপ নতুবা রাশিয়ার দাপটে পীড়িত ছিলেন । রচনাটিতে এভাবে ঔপনিবেশিক ও উত্তরঔপনিবেশিক সংঘাতক্ষেত্র গড়ে ওঠে । মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক রাজনীতির সংঘাত ।
প্রতিষ্ঠিত বাইনারি বৈপরীত্যগুলোকে, ছয়ের দশকের আগেকার বাংলা কবিতা যা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকত, অর্থাৎ ভালো/খারাপ, প্রেম/ঘৃণা, শ্লীল/অশ্লীল, পুরুষ/প্রকৃতি, মিতকথন/অতিকথন, শরীর/মন, শুরু/শেষ, আমি/তুমি, সুন্দর/কুতসিৎ, ইত্যাদি, আমি তাদের ভন্ডুল করে দিতে চেয়েছিলুম । ভন্ডুল করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে যৌনতা এবং অন্তর্ভাবাত্মক স্বরধ্বনি ল কবিতায় এভাবে সঘোষ অব্যয় প্রয়োগ সেসময়ে অকল্পনীয় ছিল , আস্বাভাবিক ছিল । কবিতাকে শাসন করার চালু অ্যাকাডেমিক কেন্দ্রটিকে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে প্রসৃত অব্যব প্রয়োগে, এবং তাকে বেদখল করা হয়েছে ঐক্য, রৈখিকতা, আদল এবং আনুমানিক মর্মার্থের মূল্যবোধসমূহের মসনদ থেকে । আবেগ যেহেতু একটি ট্রান্সগ্রেসিভ মশলা, তাকে বারংবার, হাপরের মতন, ব্যবহার করেছিলুম পাঠকৃতিটিতে । পাতিবুর্জোয়া চেতনায় একজনের আবেগ আরেকজনের কাছে বিসদৃশ ও অপমানজনক ঠেকে ।
তদানীন্তন পাঠক-পাঠিকাদের এইটেই ঘটেছিল । আমার কাছে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতি ছুতার' ছিল একটি অফুরন্ত আহ্লাদের বহুরৈখিক প্রোজেক্ট, আর, আমার কবিতার কোনো কন্সটিটুয়েনসি তখন আদপেই ছিল না । বাকধারা নিয়ে খেলার অফুরন্ত এলাকা ছিল । খেলেওছি কবিতাটিতে, এবং সেসময়ের অন্যান্য কবিতায় । তা পাওয়া যাবে কবিতাটির স্পিড বা গতি থেকে ।
কবির দ্রোহ নয়, কবিতার দ্রোহ ব্যক্ত করতে চেয়েছে পাঠবস্তুটি । রচনাটির গতি, বলা বাহুল্য, সনাতন গদ্যছন্দকেও নয়ছয় করে ।
পাঠবস্তুটিতে 'আমি' ব্যাপারটি অজস্র জিজ্ঞাসা দ্বারা বিগঠিত । রবীন্দ্রনাথে তো বটেই, তিন থেকে পাঁচের দশক পর্যন্ত কবিতায়, 'আমি' ছিল স্বয়ংসিদ্ধ, সবজান্তা, প্রমাণিত সত্য । তাই 'আমি' প্রতিপাদিত জ্ঞানকে মনে করা হত অকাট্য ।
অথচ অকাটছ ও বিশুদ্ধ জ্ঞান বলে কিছু হব বলে মনে হয় না । 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এর ডিসকোর্সটি , সেহেতু, একযোগে নান্দনিকতার এবং ভাষার সন্ত্রাস হিসাবে রূপায়িত । 'আমি' এই রচনাটিতে প্রান্তিক ও সাবভারসিভ, এবং সেকারণে রাজনৈতিক । প্রগুক্ত রাজনীতির জন্য প্রলেতারিয়েত সেজে নাটুকেপনার দরকার হয় না । গোছানো পদবিন্যাসের প্রয়োজন হয় না ।
পদবিন্যাসকে বাংচুর করাটা এই প্রোজেক্টের অন্তর্ভক্ত ছিল ।
রচনাটিকে অনির্ণেয়তা দেয়া হয়েছিল নারী-যৌনাঙ্গের আরোপিত উল্লেখের সাহায্যে । ক্লিটোরিস ও লাবিয়া ম্যাজোরা শব্দ দুটি সংগ্রহ করে আরোপ করতে হয়েছিল । তার আগে আমি শব্দ দুটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না । শব্দার্থকে মুলতুবি রাখতে সাহায্য করেছে এরা, এবং অন্যাণভ দ্যোতক, যেমন বরাঙ্গ, বীর্য, মূত্রাশয়, সতীচ্ছদ, য়ুটেরাস, যোনিবর্ত্ম, শুক্র, যোনিকেশর, পোঁদ, প্রস্রাব ইত্যাদি ।
আমি জানতুম যে, অভিব্যক্তির এই আধেয় চিহ্ণগুলোর সাংস্কৃতিক স্হিতিস্হাপকতা অসাধারণ, এমনকি তাদের সংকেত ব্যক্তিগত গোপন স্তরে আক্রমণাত্মক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করবে । চিন্তার আগেই, শরীরের রসায়ন যে পাতিবুর্জোয়া বোধকে কাবু করে ফেলবে, তা আমি জানতুম । রচনাটির অনির্ণেয়তা তাই কেবল দার্শনিক স্তরে আটক নেই, তা সাংস্কৃতিক ও নৈতিকও বটে । স্বতঃস্ফূর্ততা, এবং বেছে নেয়া, দুটিকেই কাজে লাগিয়েছিলাম । কবিতায় অহং-এর গরিমা চারয়ে দেয়া হয়েছিল ইউরোপীয় আদলের লিরিকের সন্দর্ভে ।
আমি ওই অহং-চরিত্রের বদল ঘটিয়ে তাকে স্হানিক করে তুলতে চেয়েছিলাম ।
আক্রমণমাত্রেই ক্ষমতার মসনদকে বিস্হাপনের প্রয়াস । 'প্রথম বৈদ্যুতিক ছুতার' প্রথম পংক্তিটি থেকেই আক্রমণাত্মক, আর সেই জন্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক পীড়াটিকে ভাষার আদরায় পেড়ে ফেলতা চায় । রচনাটি লেখার সময়ে আমি থাকতুম পাটনায়, অর্থাৎ লেখক হিসাবেও প্রান্তিক ।
এমন একটি পাঠবস্তু তখন বানাতে চেয়েছিলাম, যা কলকাতার সাহিত্যিক এসট্যাবলিশমেন্ট ও পাতিবুর্জোয়া প্রশাসনের মাথায় থান-ইঁটের মতন লাগবে ।
পাঠবস্তুটির আকস্মিকতা, বিশৃঙ্খলা, লালিকা, এলোমেলোভাব, উন্মাদনা, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা, উদ্বেগ, উদভাবনা---আমার যৌগ-সংস্কৃতি থেকে আসার কারণ হিসাবে রচনাটিতে বুনে-বুনে রাখতে চেয়েছিলাম । মসনদ যে টলে গিয়েছিল, সে-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ । প্রশাসন ও নান্দনিক মসনদ, পশ্চিমবঙ্গে, রক্ষণশীল জাটীয়তাবাদীদের কব্জায় ছিল তখন । অর্থাৎ 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার. ছিল সমাজ-পরিসর ও কৌম-আস্ফালন সঞ্জাত । যে পরিসর ও সময় সম্পর্কিত চেতনা স্ফূরিত হয়েছে কবিতাটির অন্তর্গত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভয়, আশংকা, আনুশোচনা, শোক , পশ্চাত্তাপ ইত্যাদি তড়পানি দ্বারা ।
নান্দনিক আদর্শ, ধর্ম, আইন ও তদানীন্তন নৈতিকতার প্রেক্ষিতটিকে আমি টুঁটি টিপে ধরে নাড়িয়ে দিতা চেয়েছিলাম ।
এই কবিতাটি লেখার আগে-পরে আমার জীবন-যাপন ছিল সীমালঙ্ঘনের, উচ্চ ও নিম্ন সীমা, দুই-ই । সেটাকে বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা মনে করা ভুল হবে । ইউরোপীয় কবিদের মতন জীবনযাপন তাকে বলা যাবে না । বিহার, যেখানে আমি থাকতুম, সেখানে প্রায় প্রতিটি যুবক অমনধারা জীবন আজও কাটান ।
মধ্যবিত্ত বাঙালি চোখে তাকে কেউ-কেউ মনে করতেন, এখনও করেন, বোহেমিয়ান । ব্যাপারটা স্পষ্ট করার জন্য আমি কয়েকটি স্মৃতিকথা লিখেছি, আগ্রহীরা সেগুলো পড়ে দেখতে পারেন : ছোটলোকের ছোটবেলা, এই অধম ওই অধম, অভিমুখের উপজীব্য ; সে-সময়ের উপাদানগুলো আমি কয়েকটি উপন্যাসেও ব্যবহার করেছি: ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ । এগুলো পড়লা সেই সময়ের হদিশ পাওয়া যাবে । যুবসমাজের যে সর্বজনীন মডেলটি স্বীকৃত ছিল, তার প্রেক্ষিতে আমি ছিলাম একেবারে আঞ্চলিক; প্রান্তিক তো বটেই । 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'- এর এথনিসিটি তাই ভিন্ন হতে বাধ্য ছিল ।
উপর্যুপরি দ্রুত ধাবমান ছবিগুলো, যেমন জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়া, কর্টেক্সে কাচ ভাঙা, জন্মমূহূর্তের আলো, রূপালি য়ুটেরাস, তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ, পাঁজরে ঝুরি, হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজ, চিঃ আধবোজা নারী, মাটি ফঁড়ে জলের ঘূর্ণি, বীর্য থেকে ডানা মেলা তিন লক্ষ শিশু, মারমুখি আয়না, এই সমস্ত ও অন্যান্য ছবিগুলো বস্তুত মুহুর্মুহু রাপচার, যা সেসময়ে জীবনযাপনের কারণে অনিবার্য ছিল; এগুলোকে বাকপ্রতিমা বা চিত্রকল্প মনে করা ভুল হবে । ঘৃষ্টধ্বনি ও স্পর্শধ্বনির সংঘাত তাতে থাকবেই, তা অনিবার্য, জরুরি । সে-কারণে পাঠবস্তুটি পাঠকের কাছে, নিজে নিজের কাছে, বঙ্গসমাজের কাছে একটি সাংস্কৃতিক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়াছিল, এবং আরও বহুকাল বজায় থাকবে সমস্যাটি, যেমনভাবে রয়েছে বিগত সাড়ে চার দশক যাবত । হাইকোর্টে সেকারণেই জিতে যাই ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।