আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বাচন ২০০৮



বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে আওয়ামী জোট ২৬২টি আসন ও চারদলীয়জোট ৩২টি আসন পেয়েছে। আওয়ামী মহাজোটের এই বিজয় অপ্রত্যাশিত না হলেও অনেকই এটাকে বিস্ময়কর বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। নির্বাচন পূর্বে এটা ধারণা করা হয়েছিল যে নির্বাচনে মহাজোট বা চারদলীয়জোট এর মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হবে। জোট-মহাজোট কে কতটি আসন পেতে পারে এই নিয়ে বিভিন্ন জরিপে বিভিন্ন ধরনের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোন জরিপের ফলাফলই সঠিক মনে হয়নি।

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়ারমত কোন কিছু না ঘটলে মহাজোট এর মহাবিজয়কে বিস্ময়কর বলা হতোনা। নির্বাচনে চারদলীয়জোটের মাত্র ৩২টি আসনে জয়লাভ শুধু চার-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীই নয় আওয়ামীজোটের অনেকের কাছেও অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয় মনে হয়েছে। অনেকরই ধারণা খোদ শেখ হাসিনাও ভাবেননি যে তিনি এত বিপুল বিজয় লাভ করবেন। । (Click This Link) এই কথা ঠিক যে, খেলার মাঠে জয় পরাজয় আছে।

পরীক্ষায় পাশ-ফেল আছে। নির্বাচনেও জয়-পরাজয় আছে। আর এই জয়-পরাজয় খেলোয়াড়দের মত রাজনৈতিক ময়দানের খেলোয়াড়দেরকেও মেনে নিতে হয়। তবে আম্পায়ারের পক্ষপাতমূলক আচরনের কারণে খেলার মাঠে কোন এক পক্ষ জয়ী এবং আরেক পক্ষ বিজয়ী হলে যেমনি বিতর্ক সৃষ্টি হয় অনুরপভাবে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলের নিরপেক্ষ ভূমিকা না থাকলে উক্ত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে কেউ কেউ ‘মহাজালিয়াতি’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এবং আবার কেউ কেউ এটাকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোটারদের নীরব বিপ্লব’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

আমার মনে হয় এই সম্পর্কে ভবিষ্যতে অনেক গবেষণা হবে এবং এরমাধ্যমে স্পষ্ট হবে যে, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে কিনা? হলে কিভাবে হয়েছে? এটাকি শুধু জালিয়াতির ফসল না জালিয়াতের সাথে জনরায়ও যোগ হয়েছে? না এটা শুধু জনরায়ের প্রতিফলন? তবে আমি মনে করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে সুসংহত করার জন্য নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রশ্নমুক্ত রাখারক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় রয়েছে তা খোলামন নিয়ে চিন্তা করা দরকার এবং উক্ত অন্তরায়সমূহ দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এই কথা ঠিক যে, নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রদান করেছেন। এই কথাও বাস্তব যে, ভোটারদের বিরাট একটি অংশ নানা কারণে চারদলীয় জোটের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণের রাজনৈতিক কালচার গড়ে উঠা আবশ্যক। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট দেয়া হলেও ইলেকশানের ফলাফল কয়েকটি কারণে অস্বাভাববিক ও অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে।

পরিকল্পিতভাবে একটি প্রভাবশালী মহল এই নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে অনেকরই ধারনা। এরফলে নির্বাচনকেন্দ্রীক কিছু প্রশ্ন ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচনের ফলাফল কিভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে এই সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয় নিম্নে উল্লেখ করছিঃ ১. ইতোপূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডঃ শামসুল হুদা জাতিকে ৭০ সালের মত নির্বাচন উপহার দেয়ার কথা বলেছেন এবং সত্যিই তিনি ৭০ সালের মত নির্বাচন উপহার দিয়েছেন । ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগ একচেটিয়া বিজয় পেয়েছিল এবং এইবারও একতরফা বিজয় লাভ করেছে। ১৯৭০ সালে একতরফা বিজয়ে অবশ্যই জনরায় সম্পৃক্ত ছিল।

তবে এইবার জনরায় ছাড়া আর অন্য কোন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল কিনা এবং থাকলে তা কিভাবে হয়েছে এই সম্পর্কে অনেকরই প্রশ্ন রয়েছে। এই কথা সত্য যে, হয়তোবা অন্য কোন ইঞ্জিনিয়ারিং না হলেও আওয়া‌মীজোট সরকার গঠনের মত সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেতো এবং চারদলীয় জোট সন্মানজনক আসনে জয়লাভ করে একটি ব্যল্যান্সড পার্লামেন্ট গঠন হতো। কোন দেশের গনতান্ত্রিক ধারা মজবুত করার জন্য পার্লামেন্টে সরকারীদল ও বিরোধীদলের মধ্যে ভারসাম্য থাকা দরকার। ইতোমধ্যে অনেকই অভিমত পোষণ করেছেন যে, এক তরফা সংসদ গনতন্ত্রের ভিত মজবুত করার জন্য সহায়ক নয়। ২. নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুসারে এই নির্বাচনে ৮৭.১৬% ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

এরমধ্যে ৮৮টি আসনে ৯০-৯৫.৪৩% ভোট কাস্ট হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পাবনা ১ আসনে ( নিজামী সাহেবের) ৯৩% ভোট , চাপাইনবাবগঞ্জ ২ আসনে ৯৫.২৬%, নওগাঁ ২ আসনে ৯৫.৪২%, নওগাঁ ৩ আসনে ৯৫.০৬% এবং রাজশাহী ৫ আসনে ৯০.৪৩% ভোট কাস্ট হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে ৮,১০, ৫৮, ৬৯৮ জন ভোটারের মধ্যে ৭,০৩, ৫৭, ৪৪৯জন ভোটার সারাদেশের ১,৭৭,২৭৭ টি পোলিংবুথে ভোটাধিকার প্রদান করেছেন। পরিসংখ্যান অনুসারে প্রত্যেক ভোটার গড়ে ৭২ সেকেন্ড সময় পেয়েছেন। কোথাও কোথাও আরও কম সময় পেয়েছে।

যেমন প্রত্যেক ভোটার মুন্সিগঞ্জ ১ অসনে ৫৯ সেকেন্ড, জামালপুর ৩ আসনে ৬১ সেকেন্ড, গাজীপুর ১ ও ৩ আসনে ৬৩ সেকন্ড সময় পেয়েছে। (http://www.newagebd .com/2009/ jan/03/front. html#11) নির্বাচনোত্তর সাংবাদিক সন্মেলনে ভোটের এই হারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করেছেন। উপরন্তু নির্বাচনের দিন সকাল বেলা নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে দুপুরের মধ্যে ৫০% ভোট পড়েছে । পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিকাল বেলা অনেক কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। তারপরও সব মিলিয়ে গড়ে ৮৭% ভোটার উপস্থিতি কি বাস্তবে ঘটেছে? আরেক পরিসংখ্যান অনুসারে রাজশাহী ৫ আসনের কালিগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১০৫.৩২% ভোট পড়ে।

তাই জনমনে প্রশ্ন কিভাবে কিছু কেন্দ্রে ১০৫% ভোট কাস্ট হতে পারে ? ( সুত্রঃ Click This Link) ২৯শে ডিসেম্বর ০৮ এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আমি অনেক সাংবাদিক, ভোটার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীর এবং দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী অনেকর সাথে মতবিনিময করেছি। বাংলাদেশের প্রায় সকল পত্রিকা ও বিদেশী কয়েকটি পত্রিকা মনোযোগ সহকারে পড়ার চেষ্টা করেছি। আমি লক্ষ্য করেছি যে, জনসাধারণের এক বিরাট সংখ্যা মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল একটি রাজননৈতিক দলের অনুকুলে নেয়ার জন্য বিগত সাত বছর ধরে বিশেষত গত দুই বছর যাবত নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং এই ধরনের ফলাফল হওয়ার ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক কারণ ও কৌশল কাজ করেছে। সংক্ষেপে তার কয়েকটি নিম্নরূপঃ ক. Ghost Vote জনগণের ভোটের সাথে অত্যন্ত গোপনে , সুক্ষভাবে কিছু আসনের নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে Ghost Vote প্রদান করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দিনাজপুরে একটি কেন্দ্রে একটি বে ১০০% নৌকার পক্ষে ভোট দেখে নির্বাচন এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকই হতবাক হন।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে উপস্থিত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক জোটের এজেন্ট রহস্যজনকভাবে এই ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ জানায়নি। খ. কালোটাকার প্রভাবঃ নির্বাচনের অনেক আগেই মহাজোট ভোট কিনে ফেলেছে। এমনকি প্রতিপক্ষের কিছু এজেন্টকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মহাজোটের পক্ষে কাজ করার কথাও কোথাও কোথাও প্রচারিত হচ্ছে। মহাজোটের বিরুদ্ধে কালো টাকার ছড়ানোর অভিযোগ প্রশাসন আমলে নেয়নি । অপরদিকে নির্বাচনের পূর্ববর্তী দুই দিনে চারদলীয়জোটের বিরুদ্ধে কালোটাকা ছড়ানোর অভিযোগ অমলে নিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবঙ মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়।

এমনকি দিনাজপুরে পুলিশ প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তি ৭ হাজার টাকা জামাতের জনৈক কর্মীর পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে কালো টাকার বিলির অজুহাতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অথচ মিথ্যা অজুহাতে গ্রেপ্তারের কারণে পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দেয়ার সংবাদটি প্রচার করা হয়নি। গ. কেন্দ্র দখলঃ যেমন চৌদ্দগ্রাম আসনে ( ডাঃ তাহেরের আসন) চারদলীয় জোটের প্রার্থী ডাঃ তাহেরের উপর আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে হামলা করা হয় এবং ৬টি কেন্দ্র জোরপূর্বক দখল করে নিয়ে যাওয়া হয়। সারাদেশে ব্যাপকভাবে কেন্দ্র দখল না হলেও কিছু কিছু আসনের কিছু কেন্দ্র দখল করার ঘটনা ঘটেছে। ঘ. নির্বাচনে প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণঃ এই বিষয়ে কর্ণেল অলি অভিযোগ করেছেন যে চট্টগ্রাম ১৩ নির্বাচনী এলাকায় নিযুক্ত আর্মির জনৈক অফিসার মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি বিষয়টি জিওসিকে অবহিত করেন এবং উক্ত অফিসারের শাস্তি দাবী করেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

আওয়ামীজোট জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অনবরত প্রচার প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। অথচ আওয়ামীলীগ ২৮শে অক্টোবর ২০০৬ -এ ঢাকায় লঠি বৈঠার তান্ডবতা চালিয়ে কিভাবে মানুষ হত্যা করেছে সেই সিডি জনগনকে দেখানোর ক্ষেত্রে পুলিশ বাধা দিয়েছে। এরফলে জামায়াত জনগনের মাঝে আওয়ামীলীগ বিরোধী সেন্টিমেন্ট গড়ার ইস্যুটি কাজে লাগাতে পারেনি। অথচ আওয়ামীলীগ ও সেকটর কমান্ডারস ফোরাম জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে অব্যাহতভাবে প্রচারণা চালিয়ে জনগণের একটি অংশের মাঝে জামায়াত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তারা জামাতের বিরুদ্ধে নানা রং বেরংয়ের রঙিন পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করে।

নির্বাচনী আইন অনুসারে রঙিন পোস্টার ছাপানো বেআইনী হলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। ঙ. জাতীয় পরিচয় পত্র থাকা সত্বেও ভোটার লিস্টে অনেকর নাম না থাকাঃ অভিযোগ উঠেছে যে, কোন কোন ভোটার ২-৩ কেন্দ্রে ঘুরাঘুরি করেও ভোট দিতে পারেনি। এইভাবে কয়েক হাজার ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রদান করার সুযোগ পান নাই বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। চ. ৭২টি নির্বাচনী আসন পূণর্বিণ্যাসঃ অভিযোগ রয়েছে যে , ৭২টি নির্বাচনী আসন এমনভাবে পুণর্বিন্যাস করা হয় যাতে অওয়ামীলীগের সুবিধা হয়। বি•এন•পির পক্ষ থেকে উক্ত অসন বিন্যাসের বিরুদ্ধে অদালতে মামলা দায়ের করা হয়।

কিন্তু মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ায় বি•এন•পি ও চারদলকে নির্বাচন কমিশনকর্তৃক বিন্যাসকৃত আসন মেনে নিয়েই নির্বাচন করতে হয়েছে। নতুন সীমানা নির্ধারনের কারণে বি,এন, পি- জামাতের ভোট ব্যাংক এলোমেলো হয়ে গেছে। ছ. আওয়ামী ভাবাপন্ন অফিসারদেরকে নির্বাচনের ফিল্ড লেবেলে নিয়োগঃ চারদলীয জোট সমর্থক বলে পরিচিত কিছু প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ সম্পর্কে মিডিয়াতে খবর প্রকাশের পর তাদেরকে পরিবর্তন করা হয়। এরঅর্থ হচ্ছে, এছাড়া বাকীরা মহাজোট সমর্থক ছিল । কিন্তু মহাজোটের সমর্থক বলে পরিচিতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার পরও তাদেরকে প্রত্যাহার করা হয় নাই।

ফিল্ড লেবেলে মহাজোট সমর্থক অফিসার থাকার কারনে চারদলীয জোট নেতা কর্মীরা আগ থেকেই হতাশ ছিল এবং কেউ কেউ আতংকগ্রস্থ ছিল। এরফলে নির্বাচনের সময় ভোট কেন্দ্রে চারদলের দূর্বল অবস্থান ছিল। গ্রেফতারের ভীতির কারণে নির্বাচন কেন্দ্রে তাদের সরব উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ ধরণের ভীতির সুযোগ গ্রহণ করে মহাজোট। এতে সাধারণ লোক মনে করেছে মনেহয় মহাজোট জিতবে।

কারণ কেন্দ্রে এদের প্রভাব বেশী দেখা যাচ্ছে । ‘চারদল জিতবেনা তাই ভোটটি পঁচানো ঠিক হবে না’ মনে করে সাধারন মানুষ এর এক অংশ মহাজোটকেই ভোট দেয়। উপরিউক্ত কয়েকটি বিষয় ছাড়াও দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মহলের ভূমিকা নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবান্বিত করতে ভূমিকা পালন করেছে। যেমনঃ নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতমূলক আচরণঃ নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই বি•এন•পি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা জনমনে দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিএনপির সংস্কারপন্থীদেরকে অমন্ত্রন জানিয়ে নিরপেক্ষতা ভংগ করেছে।

বিভিন্ন সময় বিএনপি ও জামাত সম্পর্কে অশোভন অনেক উক্তি করেছে এবং তা মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। এ থেকে এই বিষযটি পরিষ্কার যে, নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই একটি রাজনৈতিক জোটকে জিতিয়ে আনার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ডিসেম্বর মাসে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন এর বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস। দুদকের ভূমিকাঃ দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি দমনের পবির্তে রাজনীতি দমনের চেষ্টায় অবতণীর্ণ হয়। সত্যিকার দুর্নীতীবাজদের দমনের ক্ষেত্রে দেশের জনগন একমত থাকলেও এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।

দুদক মূলত রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের দমনে সচেষ্ট হয়। এরফলে দল হিসাবে বি•এন•পি সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জামাতকে দুর্নীতর সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরফলে অন্য ইস্যু দিয়ে তাদেরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়। দুদুকের সার্বিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দুদক একটি বিশেষ মিশন নিয়েই কাজ করেছে এবং এরফলে একটি জোট উপকৃত হয় এবং আরেকটি জোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশেষত নির্বাচনী জোয়ারে সারা দেশ যখন ভাসছিল সেই মুহুর্তে সিংগাপুরে কোকোর একাউন্টে এগার কোটি টাকা পাওয়ার বিষযটি ফলাও করে প্রচার করে নির্বাচনী জোয়ার একটি পক্ষে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। উক্ত টাকা আসলেই কি কোকোর না অন্য কারো এটা তদন্তের ব্যাপার। আমি এই বিতর্কে যেতে চাইনা। তবে এতটুকু বলা সমীচিন মনে করি যে, এই টাকা কোকোর হলেও তা আরও অনেক আগে কিংবা নির্বাচনের পরেও প্রকাশ করা যেতো। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহুর্তে এটা ফলাও করে প্রচার করে ভোটারদেরকে প্রভাবান্বিত করা হয়েছে বলে ব্যরিষ্টার রফিকসহ অনেকই মন্তব্য করেছেন।

তত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকাঃ তত্বাবধায়ক সরকারকে শেখ হাসিনা তাদের আন্দোলনের ফসল অখ্যা দেন এবং তাদেরকে বৈধতা দানের অগ্রিম ঘোষনা দেন। শুরু থেকেই একটি কথা প্রচারিত হয়েছে যে, বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকার একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যই কাজ করছে। তত্বাবধায়ক সরকার এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয়কেই কারাবন্দী করলেও শেখ হাসিনাকে গোপন চুক্তির মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তি দেয়। এরফলে তিনি অনেক আগ থেকেই নির্বাচনী পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের সুযোগ পান। অপরদিকে খালেদা জিয়াকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি।

এমনকি চারদলীয় জোটের দাবীপুলনের ব্যাপারে তাদের সাথে কোন ধরনের সমঝোতা ছাড়াই নির্বাচনের তারিখ ঘোষনা করার ফলে চারদল নির্বাচনে যেতে দ্বিধা-দ্বন্ধে ছিল। বিশেষভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষনার মুহুর্তে নিজামী, মুজাহিদ, সাইফুর প্রমুখদেরকে জেলে পাঠানো সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণের বহিপ্রকাশ বলেই অনেকই মনে করেন। আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহলের পছন্দ ছিল মহাজোটঃ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশী প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ এর কথা সকলেরই জানা রয়েছে। ১/১১ থেকেই তারা বিভিন্নভাবে তাদের পছন্দের লোকজনকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে। শেখ হাসিনা মুক্তি লাভের পর আমেরিকায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে তার কযেক দফা মিটিং হয় এবং এর মাধ্যমে বিদেশী স্বার্থরক্ষার গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকরই ধারনা।

এছাড়া ভারতের প্রভাবশালী মহল আওয়ামীলীগকে যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতা স্থাপনে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পালন করেন। তার প্রমান হচ্ছে গত ৩রা জানূযারী দৈনিক মানব জমিনে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, এরশাদ ভারতের বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখ্যার্জীকে ফোন করেন এবং তাকে চুক্তি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট বানাতে শেখ হাসিনাকে ফোন করার জন্য অনুরোধ করেন। অপরদিকে শেখ হাসিনাও প্রণব মুখার্জীকে মন্ত্রীপরিষদ গঠনের সময় উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ভারতে সফরের সময় তাকে ৬টি ঘোড়া উপহার দিয়ে ভারত ” ঘোড়া রাজনীতি” করার পিছনে যে তাদের দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থসিদ্ধ অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তা সকলের কাছে পরিষ্কার। পাকিস্তানের সাথে চলমান পরিস্থিতির কারণে ইন্ডিয়ার জন্য বাংলাদেশে তাদের একান্ত বিশ্বস্ত সরকার প্রয়োজন।

এই ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই যে তাদের প্রধান চয়েস তাতে কোন সন্দেহ নাই। হয়তবা আওয়ামীজোট বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকলে তারা বিকল্প হিসাবে জেনারেল মঈনকে বেছে নিতো। এই কথা ঠিক যে, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী মহলের বিশেষ আকর্ষন রয়েছে। আর এই আকর্ষন যে কত বেশী তা আমেরিকার নির্বাচনের মাত্র অল্প কয়েকদিন পরই ম্যাককেইন, জাতিসংঘ মহাসচিবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের ঢাকা সফর থেকে বুঝা যায়। মিডিয়া ক্যুঃ বাংলাদেলের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টেড মিডিয়া পর্যবেক্ষন করলে দেখা যা্‌য় প্রায় সকল মিডিয়ার টার্গেট ছিল চারদলীয়জোটকে পরাজিত করা।

মহাজোটের বিজয়ের পর কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, ”এটা মহাজোটের বিজয় নয়- মিডিয়া ক্যু” । মিডিয়াতে অব্যাহত অপপ্রচারে ভোটাররা একটি জোটের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। তাদের বক্তব্য মিডিয়াতে প্রচার করা হয় নাই। এই বিষয়ে চারদলীয় জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়া হলেও তারা মিডিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয় নাই। সবগুলো ইলেক্টনিক মিডিয়া ও সংবাদপত্র চারদলের বিপক্ষে জোর প্রচারণা চালানো চারদলের শোচনীয় পরাজয়ের অন্যতম কারণ।

এনজিওদের ভূমিকাঃ বাংলাদেশে এন•জিওদের ভূমিকা সকলের কাছে স্পষ্ট। অনেক গরীব নারী-পুরুষ এনজিওদের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। এন•জিওরা ২০০১ সালের পর থেকেই একটি দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য বিশেষভাবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘ঋণ পেতে হলে অমুক মার্কায় ভোট দিতে হবে’ এই ধরনের প্রচারণার ফলে এন•জিওদের দ্বারা প্রভাবিত লাখো নারী-পুরুষ বিশেষ একটি জোটের পক্ষে ভোট দেয় বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। বাংলাদেশের জনগনের ঝোঁক প্রবনতাঃ বাংলাদেশে একই দল পরপর দুইবার ক্ষমতাসীন হওয়ার নজীর নেই।

বাংলাদেশের জনগন ত্বড়িত সিদ্বান্ত গ্রহন করে এবং তাতক্ষনিক ফলাফল চায়। তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাহিদা মেটাতে সরকার ব্যর্থ হলে রাতারাতি মুখ ফিরিয়ে নিতে কার্পন্য করেনা। বাংলাদেশের যেসব জনগণ ১৯৭০ সালে একচেটিয়া অওয়ামীলীগকে ভোট দিযেছিল তারা রক্ষীবাহীনী, মুজিব বাহিণী ও আওয়ামী বাকশালীয় একদলীয় শাসন দেখে মাত্র ৫বছরের ব্যবধানে অওয়ামীলীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর জাতীয়তাবাদী শক্তি অতি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠে । ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ বিজয়ী হবে বলে ধারনা করা হলেও বিএনপি ১৪০ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে।

কিন্তু বিএনপি মানুষের প্রত্যাশা পুরণে ব্যর্থ হলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামীলীগের হাজারী, তাহের, শামীম গংদের অত্যাচারে মানুষ অতীষ্ঠ হয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয়জোটকে দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী করে। কিন্তু চারদলীয়জোট অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রত্যাশা পুরণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। চারদলীয়জোট এর প্রতি মানুষের সমর্থন প্রত্যাহারের পিছনে যে কয়েকটি বিষয় মৌলিকভাবে কাজ করেছে তা হচ্ছেঃ ১. দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধিঃ চারদলীয়জোট সরকারের সময় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উবর্ধ গতির কারণে এইবার সাধারণ মানূষ একচেটিয়া আওয়মীলীগকে ভোট দেয়। আওয়ামীজোট ১০ টাকা কেজি চাল, বিনামূল্যে সার, বি•এ পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা, প্রতি পরিবার থেকে একজনকে চাকুরীদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মানুষ তা বিশ্বাস করেছে।

কারণ হচ্ছে বর্তমান সময়ের চেয়ে হাসিনার শাসনের সময়ে মানুষ তুলনা মূলক কমদামে জিনিস পত্র পেয়েছে। তবে সে সময় বাংলাদেশের রিজার্ভ ফান্ড যে একেবারে খালি করে গিয়েছে তা সাধারণ মানূষের হিসাব করার কথা নয়। কারণ তাদের যে কোন সরকারের কাছে চাওয়া খুবই সীমিত । তারা চায় ”কম দামে চারটা ডাল,ভাত খেতে” । এটা যে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে সাধারণ মানূষকে চারদল তা বুঝাতে পারেনি।

বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জিনিসপত্রের দাম অনেক বৃদ্ধি পেলেও জনগনের কাছে অওয়ামীলীগ এই কথা প্রচার করেছে যে , বর্তমানে চারদলের বানানো প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিন ক্ষমতায়। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জিনিস পত্রের দামবৃদ্ধির জন্যও সাধারণ জনগণ চারদলকেই দায়ী মনে করেছে ২. দুর্নীতির ব্যাপক প্রচারণাঃ তারেক, কোকোসহ চারদলীয় জোটের মন্ত্রী এমপিদের দূর্নীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তারা দুর্নীতি করেছে কিনা তা নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা বিশ্লেষণ করার কথা নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই কথা প্রচারিত হয়েছে যে, ” খালেদা জিয়া ভাল হলেও সে তার ছেলেদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেননি।

সাইফুর রহমান যোগ্য হলেও সে তার ছেলের কারণে জনগণের শ্রদ্ধা হারিয়েছে”। ৩. ক্ষমতার অপব্যবহারঃ দুই হাজার এক সালে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় পাঁচ বছরের শাসনামলে চারদলের কিছু নেতা কর্মী বেশ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে বলে ভোটারদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ ছিল। ৪. বিদ্যুৎ বিপর্যয়ঃ চারদলীয় জোটের শাসনামলে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। সচেতন ভোটারদের একটি অংশ মনে করে চারদল বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ৫. জংগীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের প্রশ্রয়দানঃ যদিও শাইখ আব্দুর রহমান এর জে•এম•বির জন্ম হয়েছিল আওয়ামী শাসনের শেষ সময়ে।

কিন্তু তারা ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট একযোগে সারা দেশে বোমা বিস্ফোরন ঘটিয়ে দেশে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। বিএনপি, জামায়াতসহ সকল ইসলামী দল ও জনগণ এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নিন্দা জানায় এবং চারদলীয় জোট সরকার তাদেরকে গ্রেপ্তার করে বিচারের সন্মুখীন করে। কিন্তু তারপরও আওয়ামীজোট এর প্রচারণার ফলে ভোটারদের একটি অংশ জংগীবাদের প্রশ্রয়দানের জন্য চারদলের কোন কোন নেতাক দায়ী করে। ৬. দেশের প্রতিটি জেলায় সেক্টর কমান্ডাররা জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে প্রচার করে তরুণ প্রজন্মকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। এইবার ভোটারের প্রায় ৩১শতাংশ তরুণ নতুন ভোটার ।

৭১ ইস্যুতে জামায়াত এর বক্তব্যে সাধারণ ভোটারগণ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। উপরিউক্ত কয়েকটি বিষয় ছাড়াও আরও কিছু কারণে চারদল পরাজিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। সংক্ষেপে তা হচ্ছেঃ ১. তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থতাঃ এই কথা ঠিক যে, তরুণরাই সমাজের সবচেয়ে বেশী সচল ও উদ্যোমী জনশক্তি। অওয়ামীজোট ’ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া” সহ তরুণদের সামনে অনেক স্বপ্ন পেশ করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে চারদল তরূনদেরকে আকৃষ্ট করার মত কোন কর্মসুচী পেশ করতে পারেনি।

আওয়ামীলীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো তরূনদেরকেই উৎসর্গ করেছে। তরুণরা ইমেইল, ইন্টারনেটসহ অধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশী। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচারণার ৯৯%ই ছিল মহাজোটের পক্ষে। ২. বি•এন•পির সাংগঠনিক দূর্বলতাঃ ২০০১ সালের পর বি,এন পিতে তিন তিন বার ভাং‌গন হয়। এরফলে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো খুবই দূর্বল ছিল।

অনেক স্থানে নির্বাচনী কমিটি পর্যন্ত ঠিকমত ছিলনা। ফলে খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মাঝে ঢেউ তোলার মত সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থাপনা ছিলনা। এই কথা ঠিক যে, খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে অনেক জনপ্রিয়। তিনি রাত, দিন পরিশ্রম করে জনগনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু উক্ত ফসল ঘরে তোলার মত সাংগঠনিক কাঠামো ছিলনা।

নির্বাচন পরিচালনায় অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের উপরই তাকে নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। ৩• কিছু বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রার্থী মনোনয়ন দানঃ বিএনপি এমন কিছু ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দান করে যাদের সম্পর্কে শুধু সাধারণ জনগন নয় বিএনপির অনেক নেতা কর্মীই ক্ষুব্ধ ছিল। এর ফলে কর্মীদের একটি অংশ নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করেনি। আর আরেকটি অংশ ” না” ভোট দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। আর একটি অংশ ভোট দিতেও বিরত ছিল।

এছাড়া অনেক জায়গায় অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হয়। সংস্কার ইস্যুতে বেশ কিছূ জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন না দেয়ায় মাঠে ৩৯ জন বিদ্রোহী নেতা সক্রিয় থাকার কারণে সাধারন মানুষের মধ্যে বি•এন•পির বিজয় লাভ সম্পর্কে আস্থার সংকট ছিল। অপরদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথম দিকে ক্ষোভ থাকলেও শেখ হাসিনা বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতি খোলা চিঠি দিয়ে তাদের এক বিরাট অংশকে নির্বাচনী লড়াই থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে যে, কিছু আসনে বি•এন•পির কতিপয় নেতা খালেদা জিয়ার অগোচরে অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দিতে গিয়ে অরাজনৈতিক ও জনবিচ্ছিন্ন দুর্বল প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। যার খেসারত হিসেবে ওইসব আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় দেখতে হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডকে।

বি•এন•পি বিতর্কিত প্রাথীদেরকে মনোনয়ন দান করে জনগনের মাঝে আস্থাসৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ৪. অপ্রস্তুত অবস্থায় বি,এন,পি নির্বাচনে অংশ গ্রহণঃ বিএনপি অপ্রস্তুত অবস্থায় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়েও দলের ভেতর নানা মত ছিল। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক কালবিলম্ব হয়েছে। এতে জনগণ প্রায় ধরে নিয়েছিল যে, বিএনপি হয়তো এবারের নির্বাচনে অংশ নেবে না।

এতে বিএনপিকে বাদ রেখেই বিকল্প চিন্তাভাবনা করেছেন অনেকে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দিকে ঝুঁকে গেছেন অনেক ভোটার। আবার সময়ের স্বল্পতার কারণে বিএনপির হাইকমান্ড এবং প্রার্থীরাও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারেননি। দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থেকে অনেক প্রার্থী মাত্র এক সপ্তাহ নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সময় পেয়েছেন। অন্যদিকে মহাজোটের প্রার্থীরা কয়েক মাস আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছেন।

নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয়ের পর নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমানসহ বি•এন•পির একটি অংশ ও জামায়াতের চাপËেক দায়ী করে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন । কিন্তু বি•এন•পি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করলে বিকল্প কি হতো এবং তার ফলে কতটুকু লাভবান হতো এটাও পর্যালোচনার দাবী রাখে। কেননা নির্বাচনে অংশ গ্রহনের পক্ষে চাপ সৃষ্টিকারীদের যুক্তি ছিল মূলধারার বি•এন•পি নির্বাচনে অংশ না করলে দুটি বিকল্প হতো পারতোঃ ক• সামরিক শাসন জারী এবং তার সুদৃুরপ্রসারী ফল কি হতো তা পর্যালোচনা করা দরকার খ• মান্নান ভূইয়ার নেতৃত্বে বি•এনপির সংস্কারবাদী অংশ সংগঠিত হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতো এবং এর মাধ্যমে মূল বি•এন•পিকে আরও দূর্বল করে দেয়ার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতো। ৫. দূর্বল নির্বাচনী প্রচার প্রচারণাঃ ঢাকা শহরের অনেক ভোটার আমাকে বলেছেন যে, নৌকার শ্লোগান যতবার শোনা গেছে তার ২০ ভাগের একভাগও ধানের শীষের শ্লোগান শুনা যায়নি। এছাড়াও নির্বাচনী প্রচারণার সমন্বিত কোন পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়নি।

৬. চারদলের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকাঃ চারদলের মাঝে ২০০১ সালে যেই ধরনের কার্যকর সমন্বয় ছিল এইবার সেই ধরনের সমন্বয় ছিলনা। ৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে বেশী প্রচারণাঃ বি•এন•পি তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে এত বেশী প্রচারণা চালিয়েছে জনগনের কাছে মনে হয়েছে যে, চার দলের কাছে তত্বাবধায়ক সরকারই যেন প্রতিপক্ষ। এরফলে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসনযন্ত্রেও চারদল ভীতি কাজ করেছে। কেননা তারা মনে করেছে , কোনভাবে চারদল ক্ষমতায় আসলে তাদের আর রক্ষা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করায় প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

৮. জনগণের মনের কথা বুঝতে ব্যর্থতাঃ চারদলীয়জোট জনগণের মনের কথা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। কিভাবে এবং কোন কথা বললে জনগণ খুশী হবে তা উপলব্ধি করতে পারেনি। অপরদিকে খালেদা জিয়া নির্বাচনে সর্বশেষ সমাবেশে দেশবাসীর কাছে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেও তা অনেক বিলম্বে করা হয়েছে বলে অনেকরই ধারণা। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই খালেদা জিয়া দেশবাসীর সামনে অতীতে থেকে কি শিক্ষা নিয়েছেন তা তুলে ধরে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য দিলে জনমনে অনেক আগ থেকেই চারদল সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতো। আমি অনেক ভোটারকে বলতে শুনেছি, ” খালেদা জিয়ার সর্বশেষ বক্তব্য প্রশংসারযোগ্য।

তবে তিনি এত বিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন যে আমার হাতে ক্ষমা করার মত আর সময় নেই। কেননা আমি অনেক আগেই সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলেছি এবং কাকে ভোট দিব সেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আছি”। ৯. বিএনপির অনেক প্রার্থী দীর্ঘদিন জেলে বা আত্মগোপন করে থাকার কারণে সাধারণ জনগন ও নিজ দলের কর্মী ও সমর্থক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এরফলে নির্বাচনের অল্প সময়ে তারা নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি করতে নিজদলের নেতা ও কর্মীদেরকে কাজে লাগাতে পারেননি। ১০. বিএনপির কোন কোন প্রার্থীর উদাসীনতাঃ অভিযোগ রয়েছে বিএনপির কিছু প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করতে হবে এমন ধরনের সিরিয়াসনেস প্রদর্শন করেন নাই।

রহস্যজনক কারণে তারা গাছাড়াভাব প্রদর্শন করেছেন। আওয়ামীলীগ জয়লাভ করার পিছনে আরও কয়েকটি বিষয় কাজ করেছেঃ ১. এইবারের নির্বাচনে ইসলাম প্রিয় সাধারন মানুষের একটি অংশ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন প্রণয়ণ করবেনা বলে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী নেতৃবৃন্দের দেয়া প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতাদের মাঝে শ্লোগানের পার্থক্য ছাড়া বাস্তব খুব বেশী পার্থক্য নেই। ফলে সাধারন মুসলমানদের মাঝ থেকে এই ভয় দূর হয়ে যায় যে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে ”ইসলামের ক্ষতি করবে”। ২. থিংক ট্যাংক এর নির্দেশনাক্রমে সুপরিকল্পিত প্রচারণা ও বক্তব্য উপস্থাপনা।

শেখ হাসিনা সম্পর্কে এই কথা প্রচলিত আছে যে, তিনি অনর্থক কথা বলেন। কিন্তু এইবার সে অত্যন্ত সতর্কভাবে কথা বার্তা বলেছে এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে। এই ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী থিংক ট্যংক গুলোর বিরাট প্রভাব ছিল। বিশেষত হাসিনাপুত্র জয় আমেরিকায় অবস্থান করে বিদেশী প্রভাবশালী মহলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালণ করেছে। অপরদিকে এই ক্ষেত্রে চারদলীয়জোট এর কার্যকর কোন থিংক ট্যন্‌ক এবং বিদেশে লবির কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

৩. আওয়ামীলীগের দিনবদলের শ্লোগান জনসাধারনের একটি অংশের মাঝে পরিবর্তনের যে আকাংখা ছিল তার সাথে মিলে যায়। তারা আওয়ামীলীগের প্রতি অনুরুক্ত না হলেও দিনবদলের কথায় মুগ্ধ হয়ে আওয়ামী জোটে ভোট দেয়। বিশেষত ” নৌকায় ভোট চাই-দশ টাকায় চাল চাই” শ্লোগানটি সাধারণ মানুষকে নৌকার পক্ষে ভোট দিতে ব্যাপকভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছে। ৪. আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি যেইভাবে আস্থাশীল ও ঐক্যবদ্ধ ছিল সে তুলনায় বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা খালেদা জিয়ার প্রতি আস্থাশীল থাকলেও নেতৃত্বের বিরাট অংশ বিএনপির দুঃসময়ে সংস্কারবাদী হয়ে উঠে। এতে সাধারন জনগনের আস্থা নষ্ট হয়।

৫. আওয়ামী জোট দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী সকল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.